জলবায়ুগত অভিঘাত

কার্বনের সঠিক সামাজিক ব্যয় নিরূপণ করা কেন জরুরি?

নিকোলাস স্টার্ন, জোসেফ ই স্টিগলিত্জ

জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার বৈশ্বিক কার্যক্রমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করার জন্য প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে অভিনন্দন। আমেরিকার পাশাপাশি গোটা বিশ্বকেই কার্যকর যথাযথভাবে পরিবর্তন মোকাবেলায় সাড়া দেয়া উচিত। তাছাড়া বাইডেনের পক্ষ থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাসের সামাজিক ব্যয়ের ওপর একটি ইন্টারএজেন্সি ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের নির্বাহী আদেশ জারির বিষয়টি নিঃসন্দেহে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপও বটে।

নতুন দলটির কাজ হবে বায়ুমণ্ডলে নির্গত প্রতি টন কার্বন ডাই-অক্সাইড অথবা অন্যান্য গ্রিনহাউজ গ্যাসের সামাজিক (এবং বিশ্বব্যাপী) ব্যয়কে আরো ভালোভাবে ডলারের মূল্য নিরূপণ করা। এটি কার্বনের সামাজিক ব্যয় (এসসিসি) হিসেবে চিহ্নিত হবে, যা ক্ষতিকর কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন রোধে তৈরি করা বিধিবিধান প্রকল্প মূল্যায়ন কিংবা কোনো প্রকল্প বা প্রবিধান, যা পরোক্ষভাবে কার্বন নির্গমনকে প্রভাবিত করতে পারে, সেটি সম্পর্কে নীতিনির্ধারক সরকারি সংস্থাগুলোকে ধারণা দিতে সক্ষম হবে।

ব্যয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে দলটি যদি কম সংখ্যার একটি ঘরে এসে উপনীত হয়, তাহলে কার্বন নিঃসরণ নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন বিধিবিধান অন্য অনেক প্রকল্পই আর সামনে এগোতে পারবে না। কারণ সেক্ষেত্রে ব্যয়ের পরিমাণ অনুমিত জলবায়ু সুবিধাগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। তাই সঠিক সংখ্যাটি পাওয়া জরুরি। তাছাড়া আগের নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে নতুন সংখ্যাটি বেশি হওয়া উচিত। 

খোলাখুলিভাবে বললে, ব্যয় নিরূপণের দুটি পন্থা আছে। একটি বারাক ওবামার আমলে প্রবর্তিত হয়েছিল। পদ্ধতিটি হচ্ছে সরাসরি অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ভবিষ্যৎ ক্ষতির মাত্রা নিরূপণ।

দুর্ভাগ্যবশত, পদ্ধতি প্রয়োগের বিষয়টি ব্যাপক জটিল। ওবামা প্রশাসন যেভাবে এটিকে প্রয়োগ করেছিল, যেখানে ব্যাপক ত্রুটি-বিচ্যুতি লক্ষণীয়। তাছাড়া তাদের নিরূপিত কার্বনের সামাজিক ব্যয়ের মানও ছিল খুব কম। ২০৩০ সাল নাগাদ টনপ্রতি ৫০ ডলার। এমনকি ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট পদে বসার আগে থেকেই গোটা বিশ্ব, বিশেষ করে আমেরিকা জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে খুব কমই কাজ করতে শুরু করে। 

সমস্যাটি ছিল ওবামা প্রশাসনের সমন্বিত মূল্যায়ন মডেলটির ব্যবহার। মডেলটির নামেই বোঝা যায়, পরবর্তী শতাব্দী বা তারও পরে অর্থনীতি জলবায়ুর গতি-প্রকৃতি গণনা করতে অর্থনীতি এবং পরিবেশ বিজ্ঞানকে একীভূত করা হয়েছে। এটি অর্থনীতি পরিবেশকে সংহত করার বিশেষ ধারণাটি তৈরি করে। তবে মূল বিষয়টি আরো গভীরে নিহিত। নির্দিষ্ট অনুমানের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীলএমন অনুমানের ব্যাপ্তি তৈরি করে মডেলগুলো নিজেই প্রকাশ করে যে এগুলো পুরোপুরি নির্ভরযোগ্য নয়।

উদাহরণস্বরূপ, মডেলগুলোর জনপ্রিয় একটি সংস্করণ থেকে প্রাপ্ত ফলাফল নির্দেশ দেয় যে প্রাক-শিল্প স্তরের সঙ্গে তুলনা করে বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা বর্তমানে দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখা উচিত, যা কিনা ২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তিতে গৃহীত দশমিক থেকে ডিগ্রি সেলসিয়াসের তুলনায় অনেক বেশি। এমনকি জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত আন্তঃসরকারি প্যানেল থেকে জোর দিয়ে বলা হয়েছে যে দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াসের তুলনায় বৈশ্বিক উষ্ণতার পরিমাণ যদি বৃদ্ধি পেয়ে ডিগ্রি সেলসিয়াসও হয়, সেক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রা অনেক বেশি বেড়ে যায়। তাই দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় অবশ্যই ঝুঁকির পরিমাণ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পাবেএটাই স্বাভাবিক। 

মডেলটিতে বৈশ্বিক উষ্ণতার পরিমাণ দশমিক ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যে রাখার যে অনুমান করা হয়েছে, তা মূলত জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আমাদের পরিবেশ, জীবন অর্থনীতিকে চূড়ান্ত ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে, সেটি গুরুত্ব সহকারে বোঝাতে অক্ষম। উপরন্তু, সমন্বিত মূল্যায়ন মডেলগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিপরীতে উদ্ভাবনের সম্ভাব্য ভূমিকা গৃহীত পদক্ষেপের গুরুত্বগুলো যথাযথভাবে চিহ্নিত করে না।

ওবামা প্রবর্তিত পদ্ধতির আরো একটি অসুবিধা হচ্ছে, এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুবিধাবঞ্চিত করে। নিজেদের প্রশ্ন করতে হবে যে আমরা আমাদের সন্তান এবং তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে নিয়ে কতটা চিন্তা করি। উত্তরটা যদি হয়, আমরা খুব বেশি চিন্তা করি না, সেক্ষেত্রে তাহলে আমাদের তেমন কিছুই করার নেই। কিন্তু যদি সত্যিকার অর্থেই তাদের কথা চিন্তা করি, তাহলে তা অবশ্যই আমাদের কাজে প্রতিফলিত হওয়া উচিত।

আনুষ্ঠানিকভাবে ওবামার সময়ের পদ্ধতিটি পরিবেশগত প্রভাব সম্পর্কিত কিছু বিষয় বাদ দিয়ে যেভাবে একটি অনুমানে পৌঁছেছে, সেখানে বর্তমান বছরের তুলনায় পরের বছর (এবং তার পরের বছর) এক ডলারের মূল্যমান কতটা কম হবে তা চিহ্নিত করে। ওবামা প্রশাসন বার্ষিক ছাড়ের হার নির্ধারণ করেছে শতাংশ, যা ইঙ্গিত করে আগামী ৫০ বছরে ডলার বাঁচাতে আজ আমরা মাত্র ২২ সেন্ট এবং ১০০ বছরে সেন্টেরও কম ব্যয় করতে আগ্রহী। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণের লক্ষ্যে এত কম গুরুত্ব দেয়ার কোনো নৈতিক যৌক্তিকতা নেই। তাছাড়া আমরা যদি একবার ঝুঁকির বিষয়টি আমলে নিই, তাহলে অর্থনৈতিক যুক্তিগুলোও টেকে না। 

আজ আমরা বীমার কিস্তি পরিশোধ করছি কিন্তু ভবিষ্যৎ ক্ষতির কথা বিবেচনায় নিয়েই। অন্য কথায়, আমরা ঝুঁকি প্রশমন করছি। ভবিষ্যতে ডলার পাওয়ার জন্য বীমা প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমরা বতর্মানে দশমিক ২০ ডলার পরিমাণ কিস্তি দিচ্ছি। কারণ আমরা আমাদের প্রয়োজনের সময় বীমা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ পাব। বিশেষ করে গাড়ি দুর্ঘটনা কিংবা বাড়িতে আগুন লাগার মতো ঘটনার ক্ষেত্রে। ভবিষ্যতের ঝুঁকি হ্রাস করে এমন ব্যয়সহ উপযুক্ত ছাড়ের হার কম বা নেতিবাচক হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, যখন সম্ভাব্য প্রভাবগুলো বড় ধরনের ধ্বংসের কারণ হতে পারে। 

তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ভবিষ্যৎ প্রভাব মোকাবেলার বিরুদ্ধে বর্তমান সময়ে অর্থ ব্যয় করাটা অনেকটা বীমার পলিসি ক্রয়ের মতো, কারণ এটি ভবিষ্যতের জলবায়ু ঝুঁকির মাত্রা প্রশমন করবে। সুতরাং ঝুঁকি মূলত কম ছাড়ের হার উচ্চ কার্বন মূল্যে পরিবর্তিত হয়।

বর্তমানে বাইডেন প্রশাসন বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা দশমিক থেকে ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে। তাই তাদের আরো বেশি নির্ভরযোগ্য পদ্ধতিতে কার্বনের সামাজিক ব্যয় নির্ধারণ করা উচিত। আমাদের মনে রাখতে হবে বর্তমানের ব্যয়টি মূলত ভবিষ্যতে গোটা বিশ্বকে বিপজ্জনক মাত্রায় উষ্ণায়ন থেকে রক্ষার লক্ষ্যে কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর মূল্য।

এটি সেই মূল্য, যা কম মাত্রায় কার্বন নির্গত হয় এমন প্রকল্পে বিনিয়োগে উৎসাহিত করার পাশাপাশি আমাদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক নতুন নতুন উদ্ভাবনে উৎসাহিত করবে। একই সঙ্গে আমাদের শহরকে যানজট জনবহুল হওয়া থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। লক্ষ্যে প্রয়োজন পড়বে সরকারি বিনিয়োগ বিধিবিধানসহ আরো অনেক পরিপূরক নীতির। আন্তর্জাতিক কার্বন-প্রাইসিং কমিশনের প্রতিবেদন অনুসারে, কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ কমানোর জন্য আমাদের গৃহীত নীতিগুলো যত সফল হবে, ভবিষ্যতে কার্বন ব্যয়ের পরিমাণ তত কম হবে। তবে যতদূর সম্ভব মনে হয়, ২০৩০ সাল নাগাদ কার্বনের সম্ভাব্য সামাজিক ব্যয় ওবামা প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত ( শতাংশ ছাড়ে) টনপ্রতি ৫০ ডলার নয়, বরং ১০০ ডলারের কাছাকাছি হবে।

তাই ২০১৭ সালে আমরা ৫০ ডলার থেকে ১০০ ডলার পরিসীমার মধ্যে কার্বনের সামাজিক ব্যয়ের যে পরামর্শ দিয়েছিলাম, তা যথার্থই ছিল। তাছাড়া এটি প্যারিস চুক্তি অনুসারে লক্ষ্যমাত্রা পূরণের বিষয়গুলোকে অনেক বেশি উচ্চাকাঙ্ক্ষী করেবিশেষ করে বৈশ্বিক উষ্ণতা দশমিক ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে ধরে রাখাসহ ২০৫০ সাল নাগাদ শূন্য কার্বন নিঃসরণের লক্ষ্যমাত্রার দিকে অগ্রসর হতে। 

এক্ষেত্রে অবশ্য মনে হতে পারে যে কারিগরি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে বরং বিশেষজ্ঞদের শরণাপন্ন হওয়া ভালো। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের অনেকেই জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির মাত্রা, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কল্যাণ জলবায়ু পরিবর্তনের পক্ষে গৃহীত কাজের জন্য প্রয়োজনীয় প্রণোদনা প্রদানের বিষয়গুলো নিয়ে খুব একটা সচেতন নন।

বাইডেন প্রশাসনকে অবশ্যই কার্বন দূষণের বিপরীতে উচ্চমূল্য নির্ধারণ করতে হবে। আর তাদের কাজটি করতে হবে আমেরিকার নাগরিকদের পাশাপাশি বিশ্বের কাছে কার্বন নিঃসরণের বিপরীতে তারা যে প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছিল, তা পূরণে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপগুলোকে উৎসাহিত করতে। পৃথিবী নামক গ্রহের ভবিষ্যৎ অনেকটা এর ওপর নির্ভর করছে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্টসিন্ডিকেট
]

 

নিকোলাস স্টার্ন: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ আন্তর্জাতিক হাই-লেভেল কমিশন অন কার্বন প্রাইসের সহসভাপতি।

জোসেফ স্টিগলিত্জ: নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ 

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন