শস্য ফলনে প্রাচুর্য আনে ব্রি ধান ২৮ ও ২৯

সাইদ শাহীন

মাসেই পূর্ণ হচ্ছে স্বাধীনতার ৫০ বছর। মুক্তির সুবর্ণজয়ন্তীর কালে এসে দেশের নানা সফলতা, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি চ্যালেঞ্জ নিয়ে নিয়মিত আয়োজন থাকছে বণিক বার্তায়। আজকের উপস্থাপনাটি আয়োজনেরই অংশ

খাদ্যনিরাপত্তার অভাব সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অনেক বড় সংকট হয়ে দেখা দিয়েছিল। খাদ্যশস্যের উৎপাদনশীলতা ছিল অনেক কম। স্বাধীনতার পর প্রথম অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদন হয়েছিল মোটে ৯৮ লাখ টন। ব্যক্তি খাতের অংশগ্রহণের সুযোগও ছিল একেবারেই সীমিত। ফলে সংকটের মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে তাত্ক্ষণিক ক্রয়ের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানেরও পথ হয়ে পড়েছিল সীমিত। দেশের খাদ্য সরবরাহ খাত হয়ে পড়েছিল অনেকটাই অনুদাননির্ভর।

স্বাধীনতার পর পাঁচ দশকের মাথায় এসে পুরোপুরি ভিন্ন চিত্র দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে। দেশে এখন দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে প্রায় সোয়া কোটি টন। এর মধ্যে শুধু চালই উৎপাদন হচ্ছে কোটি ৬০ লাখ টন। শস্য উৎপাদন খাতে প্রাচুর্যের পথপ্রদর্শক বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট উদ্ভাবিত ব্রি ধান ২৮ ২৯। দেশে চাল উৎপাদনে রীতিমতো বিপ্লব এনে দিয়েছিল ব্রি উদ্ভাবিত জাত দুটি। এখনো দেশে দানাদার খাদ্যশস্য উৎপাদনে দুই জাতের ধানই নেতৃস্থানীয় অবদান রেখে চলেছে। দেশে প্রধান খাদ্যশস্য চালের মোট উৎপাদনের প্রায় এক-চতুর্থাংশই পূরণ করছে ব্রি ধান ২৮ ২৯।

স্বাধীনতার পর শস্য উৎপাদনে সংকটমুখর পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে শুরুতেই কৃষি খাতে ধানের উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনে মনোযোগ দিয়েছিল সরকার। ১৯৭৩ সালে অনুমোদন পায় ব্রি উদ্ভাবিত জাত বিআর ৩। বিপ্লব নামে পরিচিত জাতটি বাজারে খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। এক্ষেত্রে ধানের ফলনশীলতা বৃদ্ধিই ছিল সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

হেক্টরপ্রতি প্রায় সাড়ে ছয় টনের সমান ফলন দিতে সক্ষম জাত প্রথম আসে ১৯৮০ সালে। ওই সময় আমন মৌসুমে শস্য হিসেবে অবমুক্ত করা হয় বিআর ১০ বিআর ১১ নামের দুটি জাত। এর মধ্যে বিআর ১১ জাতটি টিকে যায়, যা মুক্তা নামে পরিচিতি পায়। তবে এসব জাত দীর্ঘদিন জনপ্রিয়তা ধরে রাখতে পারেনি। এর পরও স্বল্প সময়ের জন্য বেশকিছু ভালো জাত এলেও তেমন কোনো সফলতা আসেনি।

ধানের জাত উদ্ভাবনের দিক থেকে সবচেয়ে বড় সফলতা আসে ১৯৯৪ সালে। অবমুক্ত হয় ব্রি ধান ২৮ ব্রি ধান ২৯। এর আগ পর্যন্ত দেশের মোট ধান উৎপাদনে প্রাধান্য ছিল আমন ধানের। কিন্তু জাত দুটি উদ্ভাবনের পর বড় পরিবর্তন আসে। উচ্চফলনশীল জাত দুটি উচ্চতায় খাটো। পোকামাকড়ের আক্রমণও প্রতিরোধ করে অন্যান্য জাতের চেয়ে বেশি। ফলে কৃষকদের মধ্যে সহজেই জনপ্রিয়তা পায় জাত দুটি। এখনো বোরো মৌসুমে ধান আবাদের জন্য দুটি জাতই সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। দুই জাতের ওপর ভর করেই ১৯৯৯ সালে খাদ্যে প্রথম স্বয়ম্ভরতা অর্জন করেছিল বাংলাদেশ।

সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, মোট চালের উৎপাদনে বোরো ধানের অবদান বাড়তে থাকে মূলত নব্বইয়ের দশকেই। আর ১৯৯৯ সালে দেশে প্রথম খাদ্যে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এসেছে তার পেছনে ব্রি ধান ২৮ ব্রি ধান ২৯ জাতের ধান বড় ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এখন দেশের মোট ধানের অর্ধেকই জোগান দিচ্ছে বোরো মৌসুম। গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরেও দেশে চালের উৎপাদন হয়েছে প্রায় কোটি ৬৪ লাখ টন। সেখানে বোরো ধানের অবদান ছিল প্রায় ৫৪ শতাংশ।

বিষয়ে ব্রির মহাপরিচালক . মো. শাহজাহান কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশে ধানের উৎপাদনে বড় পরিবর্তন শুরু হয় ১৯৭৩ সালে অনুমোদিত বিআর জাতের মাধ্যমে। হেক্টরপ্রতি এক থেকে চার টন পর্যন্ত ফলন দিয়েছিল জাতটি। এজন্য জাতটি বিপ্লব হিসেবে পরিচিতি পায়। এরপর বিআর ১১ জাতটি দেশে জনপ্রিয়তা পেলেও সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদে জনপ্রিয় হয়েছে ব্রি ধান ২৮ ব্রি ধান ২৯ জাত দুটি। গত কয়েক দশকে চালের উৎপাদনে ধারাবাহিকতা থাকায় দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় স্বস্তি এসেছে। তার পেছনে বড় অবদান রয়েছে জাত দুটির। তবে দেশের খাদ্যনিরাপত্তা আরো টেকসই করতে শুধু দুটি জাতের ওপর নির্ভর করলে হবে না। এজন্য এখন বেশকিছু বিকল্প জাত উদ্ভাবন সম্প্রসারণে মনোযোগ দিয়েছে ব্রি। দেশের খাদ্যনিরাপত্তা চলমান রাখতে ব্রির সব ধরনের প্রচেষ্টা চলমান রাখবে।

জাত দুটি উদ্ভাবনে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রেখেছিলেন ব্রির বেশ কয়েকজন ব্রিডার ধান বিজ্ঞানী। সংশ্লিষ্টরা জানান, ধানের জাত উদ্ভাবনে এককভাবে কোনো বিজ্ঞানীর অবদান রাখার সুযোগ খুব কম। তবে এক্ষেত্রে উদ্ভাবনী গবেষণায় নিয়োজিতদের মধ্যে মূলত ব্রিডিং বিভাগই অগ্রগামী ভূমিকা নিয়ে থাকে। সে হিসেবে জাতটি উদ্ভাবনের কালে বিভাগের প্রধান হিসেবে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন . নুর মোহম্মদ মিয়া। এছাড়া ব্রিডিং বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞানী হিসেবে অবদান রাখেন . নাসির উদ্দীন, . তুলসী দাস, . মো. আবদুল আজিজ মিয়া . এম ছালাম। জাত উদ্ভাবনের জন্য তখন আমন বোরো মৌসুম হিসেবে প্রকল্প গ্রহণ করা হতো।

ব্রি ধান ২৮ ব্রি ধান ২৯ জাত দুটি উদ্ভাবনের প্রকল্প প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন . প্রণব কুমার সাহা রায়। তার অধীনে . তানভীর আহমেদ, . খাজা গুলজার হোসেন . কামরুন্নাহার কাজ করেন। জাত দুটির উদ্ভাবন সম্প্রসারণে জনপ্রিয় করতে এদের সবারই সম্মিলিত প্রচেষ্টা ছিল বলে মনে করছেন পরবর্তীকালে ব্রির ব্রিডিং বিভাগের প্রধানের দায়িত্ব পালনকারী . প্রণব কুমার সাহা রায়।

ব্রি সূত্রে জানা গিয়েছে, জাত দুটি উদ্ভাবন থেকে শুরু করে মাঠ পর্যায়ে তত্কালে নিয়োজিত সংশ্লিষ্ট সবারই উদ্যোগ ছিল। সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) জাতটি চূড়ান্ত অনুমোদনের পর কৃষক পর্যায়ে ব্যাপকভাবে প্রদর্শনী করা হয়। এছাড়া বীজ উৎপাদনের জন্য বিএডিসিকে ব্রিডার্স সিড সরবরাহ করা হয়। পাশাপাশি ডিএইও জাত দুটির ব্যাপক প্রচার প্রসারে ভূমিকা নেয়। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে জাত দুটি কৃষকের কাছে জনপ্রিয়তা পায়।

সাম্প্রতিক সময়ে দুটি জাতের বিকল্প বেশকিছু ভালো জাত এলেও কৃষকের কাছে জনপ্রিয়তার ধারেকাছে পৌঁছতে পারেনি। বাংলাদেশে ধান উৎপাদনের অগ্রগতিতে ব্রি ধান ২৮ ব্রি ধান ২৯-এর গুরুত্ব সম্পর্কে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (ইরি) বাংলাদেশ প্রতিনিধি . হুমনাথ ভান্ডারির মূল্যায়ন, ১৯৯৪ সালে জাত দুটি অবমুক্ত হওয়ায় মূলত বাংলাদেশের কৃষি খাতে তা যুগান্তকারী ভূমিকা রেখে আসছে। বিশেষ কিছু কারণে মেগা ভ্যারাইটিতে রূপ নিয়েছে জাত দুটি। বর্তমানে বোরো মৌসুমে যে পরিমাণ ধান চাষ হয়, তার প্রায় ৬০ শতাংশই ব্রি ধান ২৮ বা ২৯ জাতের। আবাদের শুরুর সময়ে প্রচলিত অন্যান্য জাতের তুলনায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি ফলন দেয় জাত দুটি। গত দুই বা তিন দশকে সেচ চাষাবাদ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক উন্নতিকে কাজে লাগিয়ে এই দুটি জাত বাংলাদেশের ধান উৎপাদন বৃদ্ধিতে বিরাট ভূমিকা রেখে চলেছে।

বিষয়ে ব্রির সাবেক মহাপরিচালক কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের (কেজিএফ) নির্বাহী পরিচালক . জীবন কৃষ্ণ বিশ্বাস বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় সবচেয়ে বড় অবদান রেখেছে ব্রি। ব্রির সবচেয়ে জনপ্রিয় জাত হিসেবে কৃষকের কাছে জনপ্রিয় হয়েছে ব্রি ধান ২৮ ব্রি ধান ২৯। ফলন, স্বাদ রোগ প্রতিরোধী হওয়ার পাশাপাশি দীর্ঘদিন ধরেই বিকল্প ভালো জাত না আসায় জাত দুটি মেগা ভ্যারাইটিতে রূপান্তরিত হয়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন