দেশে ব্যাংকিংই সর্ববৃহৎ আর্থিক খাত। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে বিভিন্ন চড়াই-উতরাই পেরিয়ে ব্যাংক খাত বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। বিভিন্ন সময় এ খাতে সংস্কারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আগে সব রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থাকলেও পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের যাত্রা ঘটেছে। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে বড় ভূমিকা রেখেছে এ খাত। সেই সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকাও যথেষ্ট সহায়ক এবং অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডবান্ধব। ইদানীং আমরা ব্যাংকিং খাতে মন্দ ঋণ, অব্যবস্থাপনা, দুর্নীতি, তহবিল তছরুপ, ফান্ড ডাইভারশনসহ নানা ধরনের অনিয়ম দেখতে পাচ্ছি। বিসমিল্লাহ গ্রুপের কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি প্রভৃতি দেখতে পাচ্ছি। ফলে অর্থনৈতিক অগ্রগতিকে ব্যাংক আগে যেভাবে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে সমর্থ হয়েছে, এখন সেভাবে পারছে না। এর মূল কারণ, এখানে দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও পরিবীক্ষণের যথেষ্ট ঘাটতি আছে। সবচেয়ে সংকটজনক বিষয় হলো সুশাসনের অভাব। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার প্রচণ্ড অভাব বিদ্যমান। বিশেষ করে ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও পরিচালকরা কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ বিভিন্ন নীতিমালা পরিপালনে যথাযথ ভূমিকা পালন করছেন না; বরং বহু ক্ষেত্রে ব্যাংকের ব্যবস্থাপনার ওপর প্রভাব বিস্তার করেন কিংবা ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে নানা রকম অন্যায্য প্রভাব খাটান। এতে যথাযথভাবে ঋণ দেয়া সম্ভব হয় না এবং তহবিলও বেহাত হয়।
আমরা অনেক সময় মনে করি, রাজনৈতিক প্রভাবে ব্যাংকগুলো নষ্ট হয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক প্রভাব আছে সত্য; কিন্তু যেটি আমরা প্রত্যক্ষভাবে লক্ষ করি না, তা হলো বোর্ড চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের প্রভাব। ব্যক্তিমালিকানাধীন অনেক ব্যাংকের পরিচালক কিন্তু ব্যবসায়ী। রাজনৈতিক প্রভাব, আমলাতান্ত্রিক প্রভাব এবং ব্যবসায়ীগোষ্ঠীর চাপ—সব মিলিয়ে ব্যাংকের অবস্থা সঙিন। ফলে ব্যাংকিং খাতে দিন দিন নতুন নতুন সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে। নতুন নতুন বিপর্যয়ের আভাস আমরা পাচ্ছি। এটি মোটেই মঙ্গলজনক নয়। এসব সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা। রাজনৈতিকভাবে একটি অঙ্গীকার থাকতে হবে যে ব্যাংক খাত একটি পেশাদারি জগৎ, এখানে কোনো রকম রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা যাবে না। রাজনীতিবিদরা হয়তো একটা নীতিমালা দিতে পারেন কিন্তু ব্যবস্থাপনা কী হবে, কোন কোন ব্যক্তিকে বড় পদে আসীন করা হবে প্রভৃতি খুঁটিনাটি বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা ঠিক নয়। বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে তা-ই হচ্ছে। কাজেই এসব ক্ষেত্রে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে।
মনে রাখতে হবে ভালো নীতিগুলো বাস্তবায়ন করে প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রথমত, রেগুলেটরি প্রতিষ্ঠান; যার একটি হলো বাংলাদেশ ব্যাংক। আর্থিক খাতের সুশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠায় কেন্দ্রীয় ব্যাংককে শক্ত অবস্থান নিতে হবে। স্বাধীনভাবে সংস্থাটিকে কাজ করতে দিতে হবে। এখানে রাজনৈতিক সদিচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। এর পরে আসে ব্যবস্থাপনা। যারা বিভিন্ন ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হবেন, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হবেন, তাদের যথেষ্ট সততা, কর্মদক্ষতা, কর্মতত্পরতা থাকতে হবে। এ সততা থাকতে হবে কোনো ব্যক্তি-রাজনীতি-প্যাট্রনের প্রতি নয়, প্রতিষ্ঠানের প্রতি।
বেসরকারি ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদ ব্যবস্থাপকদের নিয়োগ দিলেও বিদ্যমান আইনে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের সরকার নিয়োগ দিয়ে থাকে। কিন্তু এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শ নিলে ভালো। অথচ তা হচ্ছে না। ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা পরিচালকরা মনে করছেন তারা সরকারের কর্মচারী। তাদের মধ্যে অনেকেরই আর্থিক ব্যবস্থাপনা, ব্যাংকিং, অর্থনৈতিক উন্নয়ন, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি বিষয়ে ট্র্যাক রেকর্ড নেই। আমি বলছি না সবাইকে ব্যাংকার হতে হবে বা অর্থনীতিবিদ হতে হবে। মোদ্দাকথা হলো, যারা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক হবেন, তাদের কিছুটা অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তো ব্যাংকার হন কিন্তু যারা চেয়ারম্যান বা পরিচালক হবেন, তাদেরও অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। চট করে কাউকে চেয়ারম্যান বানানো উচিত নয়। ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার অভিভাবকের কথামতো চলবেন এবং ব্যাংককেও সেভাবে চালাতে চেষ্টা করবেন। রাষ্ট্রায়ত্ত ও ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংক উভয় ক্ষেত্রে দেখা গেছে পরিচালনা পর্ষদে যারা থাকেন, তারা ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট হস্তক্ষেপ করেন। ব্যবস্থাপনাটা পেশাদারি হতে হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক বড় অংকের বেতন পান, নানা রকম সুযোগ-সুবিধা পান, তারাও চেষ্টা করেন বোর্ড অব ডিরেক্টরস বা চেয়ারম্যানের মন রক্ষা করে চলতে। এটা হতাশাজনক। চাকরি বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম আছে, টার্ম অব রেফারেন্স আছে তারা কী করবে, তাদের কীভাবে সরানো হবে, তাদের কীভাবে নিয়োগ দেয়া হবে—এ নিয়ম-নীতিগুলো পরিপালিত হওয়ার কথা। অথচ তা যথাযথভাবে পরিপালিত হচ্ছে না। চেয়ারম্যানরা ইচ্ছামতো বিদায় দিচ্ছেন, ইচ্ছামতো নিয়োগ দিচ্ছেন। বলা চলে পারিবারিক প্রতিষ্ঠানের মতো নিজেদের খেয়ালখুশির ভিত্তিতে কাজ করছেন। এটা করপোরেট সুশাসন, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার পরিপন্থী।
ব্যাংক অন্য যেকোনো প্রাইভেট কোম্পানির মতো নয়। ব্যাংকের প্রুডেনশিয়াল নর্মস থাকে। কীভাবে ঋণ দেবে, কাকে দেবে, কী হারে দেবে কিংবা কী নীতিমালা পালন করবে—বিশ্বব্যাপীই এ ধরনের নিয়ম রয়েছে। কারণ ব্যাংকের বেশির ভাগ অর্থ জোগান দেন আমানতকারীরা। তার মানে এখানে আমানতকারীর স্বার্থ জড়িত, শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ জড়িত, ঋণগ্রহীতাদের স্বার্থ জড়িত। যারা সেবা দিচ্ছেন তাদের স্বার্থ জড়িত। সর্বোপরি দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ জড়িত। অর্থনৈতিক উন্নতির প্রশ্ন এখানে জড়িত। এত সংখ্যক লোকের স্বার্থ যেখানে জড়িত, সেখানে কয়েকজন লোকের চিন্তাধারা বা প্রভাবের ওপর নির্ভর করা যাবে না। সেজন্যই ব্যাংকের জন্য নানা রকম নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। আমাদের দেশের নীতিমালাগুলোও আন্তর্জাতিক মানের। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব কিছু রেগুলেশন আছে, নিয়ম-নীতি রয়েছে। এর ওপর ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং স্ট্যান্ডার্ড (আইএফআরএস) আছে। ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অব অডিটিং আছে। আর্থিক খাতে যেসব আন্তর্জাতিক মানদণ্ড রয়েছে, তার সবই আমরা অনুসরণ করি। আমরা ব্যাসেল-৩ অনুসরণ করছি, যদিও তা পুরোপুরি বাস্তবায়ন করা হয়নি। আইনি কাঠামোয় খুব একটা ঝামেলা নেই কিন্তু ঝামেলা রয়েছে প্রয়োগে। প্রয়োগ যথাযথ না হওয়ায় আইনের ফাঁক গলে অনেকেই বেরিয়ে যাচ্ছেন। প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো আছে, অথচ প্রতিষ্ঠানগুলো খুব বেশি শক্তিশালী নয়। ব্যাংকের গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে আমাদের অর্থনীতি এগিয়ে নিয়ে যেতে পারব না।
এখন দেশের অর্থনীতিসহ নানা ক্ষেত্রে কভিডের প্রভাব পড়ছে। বিশেষ করে ব্যাংক খাতেও এটি দৃশ্যমান। ফলে যেভাবে পারফরম্যান্স করার কথা, সেভাবে হচ্ছে না। যেমন সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের বিষয়টি ধরা যাক। সবাইকে ঋণ দেয়া হলো কিন্তু এসএমই উদ্যোক্তাদের অনেকেই সরকার ঘোষিত প্রণোদনার ঋণ পাননি। ব্যাংকগুলো ইচ্ছামতো বড়দের ঋণ দিয়েছে। ফলে অনেক খেলাপি হচ্ছেন। এ বিষয়গুলোর প্রতি এখনই নজর না দিলে ভবিষ্যতে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বেশি অবদান রাখতে পারবে না ব্যাংক।
এ প্রেক্ষাপটে আমাদের কী করতে হবে। প্রথমত, বাইরের অভিজ্ঞতাগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোয় ব্যাংকের যেসব ডিসক্লোজার ও আর্থিক প্রতিবেদন থাকে, সেগুলো রেগুলেটরি সংস্থা যাচাই-বাছাই করে অতি দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বাংলাদেশেও বাংলাদেশ ব্যাংকের উচিত ব্যাংকগুলোর যে ডিসক্লোজার ও প্রতিবেদন যাচাই-বাছাই করে এর সুপারিশগুলো অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করা। এক্ষেত্রে কোনোভাবে গড়িমসি করা উচিত নয়। বেশকিছু ব্যাংকের আগে থেকে কিছু দুর্বলতা ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকও এর কিছু খুঁজে পেয়েছে। কিন্তু পদক্ষেপ নেয়নি। এখানেই কিন্তু সবচেয়ে বড় দুর্বলতা। তার মানে নিয়ম থাকলেও সেগুলো ঠিকমতো পরিপালন করা হচ্ছে না। পরিপালন নিশ্চিত করার দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকও যথাযথভাবে পালন করছে না। এটা একটা ঘাটতি। এর অর্থ হলো, এখানে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে অত্যন্ত শক্ত অবস্থান নিতে হবে। কর্মতত্পর হতে হবে। অতি দ্রুত দৃশ্যমান পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিংয়ে যুক্ত অডিটরদের ইচ্ছাকৃত-অনিচ্ছাকৃত ভুল আছে। ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মিলেমিশে বিভিন্ন ম্যানিপুলেশনও আছে। যেখানে কোয়ালিফাইয়েড রিপোর্ট দেয়ার কথা, সেখানে আনকোয়ালিফাইড রিপোর্ট দেয়া হয়। স্বাধীন ও স্বতন্ত্র এক্সটারনাল অডিটরদের আলাদা একটা রিপোর্ট দেয়ার নিয়ম, অথচ তা যথাযথভাবে পরিপালিত হয় না। বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ কয়েকটি অডিট ফার্মকে কালো তালিকাভুক্ত করেছে। শুধু তালিকাভুক্ত করলে হবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এখানে কিন্তু আইসিএমইবি ও আইসিএবির একটা ভূমিকা আছে। সদস্যরা উল্টাপাল্টা কাজ করবে, তারা কোনো ব্যবস্থা নেবে না, তা হবে না। তারা অনেক সময় বলে যে আমরা সব দেখছি, আমরা ব্যবস্থা নেব। পরে ব্যবস্থা নেয়া হয় না। তাদের স্বতন্ত্রভাবে মানদণ্ডগুলোর পরিপালনে সোচ্চার হতে হবে। সংগঠনগুলো আইএফআরএস সম্পর্কে যথেষ্ট অবগত। বলা চলে দেশে আইএফআরএস প্রবর্তনে প্রফেশনাল বডিগুলোয় সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। এর যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
তৃতীয়ত, বাংলাদেশ ব্যাংক বা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এক্সচেঞ্জ কমিশনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে ব্যবসায়ী সংগঠন ও ব্যাংক মালিক সংগঠনগুলো যথেষ্ট চাপ দেয়। তারা হয়তো পরামর্শ দিতে পারে কিন্তু প্রত্যক্ষভাবে আবদার করা একদমই অমূলক। অথচ সংগঠনগুলো নীতি গ্রহণের ক্ষেত্রে বিভিন্ন চাপ সৃষ্টি করছে। এটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। তারা আলাপ-আলোচনা করতে পারে টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে টেকনিক্যাল লোকজনের সঙ্গে। কিন্তু এর পরে কী সিদ্ধান্ত নেবে তার এখতিয়ার থাকবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার। ইদানীং লক্ষ করছি তারা বিভিন্নভাবে চাপ প্রয়োগ করে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তাতে তাদেরই দাবির প্রতিফলন ঘটে। মালিকদের, এমডিদের সংগঠনসহ বিভিন্ন সংগঠন ব্যাংক ব্যবস্থাপনার ওপর চাপ সৃষ্টির এ প্রবণতা মোটেই ভালো নয়। আমার মনে হয় না, এটি বিশ্বের খুব বেশি দেশে আছে। ভারতে ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন বিষয় ও দাবি-দাওয়া নিয়ে আলোচনা করেন কিন্তু আমাদের এখনকার মতো চাপ সৃষ্টি করে সিদ্ধান্ত প্রভাবিত করেন না। কভিড-সৃষ্ট অভিঘাত থেকে আমাদের অর্থনীতি আস্তে আস্তে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। কিছু ইতিবাচক দিকও আছে। তবে আর্থিক খাত বা ব্যাংকিং খাতে করপোরেট সুশাসন থাকলে আমরা দ্রুত অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এগিয়ে নিতে পারতাম। বিপজ্জনক ব্যাপার হচ্ছে, এক্ষেত্রে আর্থিক অনেক দুর্নীতি হচ্ছে। চরম অব্যবস্থাপনা রয়েছে। এরপর লোন ডাইভার্ট হচ্ছে। ভালো উদ্যোক্তারা অনেকটা হতাশ। তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য অনেক ক্ষেত্রে নেতিবাচক ধারায় চলে যাচ্ছে। ভালো লোক যদি ব্যবসা না করেন, মুনাফা না পান, তাহলে সাধারণ মানুষের কীভাবে কর্মসংস্থান হবে? আরেকটি বিষয়, যারা অসৎ উপায়ে অর্থ উপার্জন করেন, তারা আবার তা পাচার করে দিচ্ছেন। অর্থ পাচারের দুটো দিক আছে। এক. বিনিয়োগের মাধ্যমে আমাদের যে সক্ষমতা তৈরি হতো, তা হচ্ছে না। দুই. যারা বাইরে টাকা পাঠাচ্ছেন, তাদের দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রতি কোনো উৎসাহ নেই। বরং অসাধু উপায়ে অর্থ উপার্জনের কারণে সমতল ক্ষেত্র বিনষ্ট হয়। এটা একটা উদ্বেগজনক ব্যাপার। এটা কাটিয়ে উঠতে হবে। এমন নয় যে সব ব্যাংক একই রকম। কিছু ব্যাংক আছে বেশ ভালো। তারা আরো ভালো করার চেষ্টা করছে। কিন্তু ডমিনো ইফেক্ট যেটি আছে তা তো আছেই। ফলে কিছু ব্যাংক ভালো করলে চলবে না, সব ব্যাংককেই মোটামুটিভাবে ভালো করতে হবে। খারাপগুলো ঝরে যাক বা মার্জ করুক; কিন্তু বেশির ভাগ ব্যাংক যদি এ রকম কাজ করে তাহলে সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এমনটি হলে সার্বিকভাবে যে উন্নতি হওয়ার কথা, তা হবে না। আমরা বলছি অর্থনৈতিক বৈষম্য, সম্পদ ও আয়বৈষম্য দূর করব। দারিদ্র্য বিমোচন করব। সামাজিক নিরাপত্তা বাড়াব। কভিড মোকাবেলা করে কভিড-উত্তর স্বাস্থ্য ব্যবস্থা আরো ভালো করব। অর্থাৎ সার্বিক আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য আর্থিক খাতের যে অবদান, তা আরো বাড়াতে হবে। এর ভিত্তি এরই মধ্যে রয়েছে, সেটিকে আরো সুদৃঢ় করতে হবে। সময়টা কিন্তু বয়েই যাচ্ছে। এখন যদি আমরা পদক্ষেপ না নিই, তাহলে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে পারব না। কারণ কভিডের কারণে দেশে ভঙ্গুরতা বেড়ে গেছে, অনিশ্চয়তা বাড়ছে। ভবিষ্যৎ যাত্রা কী হবে, তার ব্যাপারে আমরা সবাই উদ্বিগ্ন। এমন এক অবস্থায় আর্থিক খাত যদি এমন হয়, ম্যানেজমেন্ট ও গভর্ন্যান্স যদি এ রকম সমস্যাসংকুল হয়, তাহলে আমাদের সামনে যাওয়ার গতিটা মন্থর হয়ে যাবে। শুধু মন্থর নয়, অনেক সময় হয়তো থমকেও যেতে পারে।
ইদানীং শোনা যাচ্ছে ব্যবস্থাপনা পরিচালকরা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছেন। এমডিদের দায়িত্ব ও ভূমিকা কী হবে, তা নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের টার্মস অব রেফারেন্স রয়েছে। তা কিন্তু তারা যথাযথভাবে পরিপালন করেন না। পরিচালকরাও তাদের ভূমিকা যথাযথভাবে পালন করেন না। কীভাবে যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা, যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে এমডিদের নিয়োগ দেয়া হবে, তার এখতিয়ার পরিচালকদের। সেটি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। অর্থাৎ ওই ব্যক্তির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যে নিয়মনীতি (নর্মস), সেটি পরিপালন করা হয় না। দ্বিতীয়ত, নিজের ইচ্ছামতো কাজ করেন। ভাবখানা এমন, এটা আমার পারিবারিক প্রতিষ্ঠান, আমার ইচ্ছামতো আমি কাজ করব। ফলে এখানে পেশাদারিত্ব যেমন গড়ে উঠছে না, তেমনি অব্যবস্থাপনাও রয়ে যাচ্ছে। আরেকটি বিষয়, অনেক সময় নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়ে এমডিদের হাতে রাখতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, তাদের যে কর্মকৃতি, যোগ্যতা, সেই অনুযায়ী তাদের বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা হয় না। চিন্তা করা হয় তাদের কীভাবে কাজে লাগানো হবে। বলতে গেলে নিজেদের স্বার্থে এমডিদের ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংক পরিচালক ও এমডিদের সম্পদের বিবরণ চেয়েছে। তাদের কেমন সম্পদ আছে, এখন কিছুটা জানা যাবে। এটা ভালো উদ্যোগ।
ব্যবস্থাপকদের চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের মধ্যে রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে আরো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে। সংবাদমাধ্যমে অনেক দাপুটে এমডির দুর্নীতির অভিযোগ উঠে এসেছে। অভিযোগগুলো খতিয়ে দেখে সবার ক্ষেত্রে সমরূপ ব্যবস্থা নিতে হবে। একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিলে আরেকজন উৎসাহ পান। এর একটা ডেমোনেস্ট্রশন ইফেক্ট আছে। কাজেই সর্বজনীনভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সিদ্ধান্ত নেয়া দরকার। ব্যাংকে সুশাসন নিশ্চিত, পরিচালন দক্ষতা বাড়ানো এবং ব্যবস্থাপকদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে এটা জরুরি।
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থনীতিবিদ
সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক; অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়