উচ্চশিক্ষা

বাংলার ব্যবহার বাড়ানো প্রয়োজন

আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন থেকে পর্যন্ত ৭০টি বছর পেরিয়ে গেল। আমাদের স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তি উৎসব চলছে।

আত্মমূল্যায়ন করলে দেখা যায়, বাংলা ভাষার প্রতি যথার্থ মূল্যায়ন করতে আমরা ব্যর্থ হয়েছি।

ইংরেজি ভাষা নির্ভরতার জন্য শিক্ষা গবেষণায় আমরা জাতি হিসেবে পিছিয়ে গেছি। বলা যায় নিজের ভাষায় জ্ঞান বিজ্ঞান উদ্যোগহীনতার ফলে আদৌ উন্নয়ন হয়নি। আমরা শিক্ষিত বাঙালিরা এমন একটি জায়গায় পৌঁছে গেছি যে ৩০ সেকেন্ড বাংলায় কথা বলার যোগ্যতা হারিয়েছি। অনেক মহাপ্রাণ বলিদান হলো, ৩০ লাখ মানুষের প্রাণ গেল, দুই লাখ মা-বোন শারীরিক নিগ্রহের শিকার হলো, বিনিময়ে স্বাধীনতা এল। অথচ নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, যে ভাষার জন্য আমাদের এই সংগ্রাম ত্যাগ, সেই স্বাধীন দেশে নিজের মাতৃভাষাকে সঠিক মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করা সর্বস্তরে ভাষার প্রয়োগের স্বপ্ন অধরাই থেকে গেল।

পরিস্থিতি পরিবেশ এমনই যে অবস্থা থেকে বের হওয়াটা কঠিন হচ্ছে। আমরা ক্রমাগত অন্ধকারে ঘুরপাক খাচ্ছি। আমাদের শ্রদ্ধাবোধ থাকার পরও পরিশুদ্ধ বাংলা বলার ক্ষমতা নেই। দৈন্য এমন একটি পর্যায়ে ঠেকেছে যে আমাদের মাতৃভাষা, মাতৃভূমি দেশপ্রেম নিয়ে কপটতা প্রকাশ পাচ্ছে।  

একুশের চেতনা দিয়েই বাঙালি জাতির শুরু। একুশ থেকে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, যা ১৯৭১ সালে চূড়ান্তভাবে সেই চেতনার বিকাশ লাভ ঘটে। আমরা পাই প্রিয় বাংলাদেশ।

আমরা স্বাধীন দেশ পেলাম কিন্তু আজও আমরা নিজের ভাষার চর্চা না করে অপসংস্কৃতিতে নিমজ্জিত। এই অপসংস্কৃতি, দেশপ্রেমহীনতা দুর্নীতি দৈনন্দিন জীবনের অংশ হয়ে উঠেছে। আমরা এখন বাংলাদেশ ছাড়ছি।

চীন, কোরিয়া, জাপান, জার্মানি, তুরস্ক, সুইজারল্যান্ড, ফ্রান্স, ইরানের মানুষ নিজের ভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করে বিশ্বে নিজেদের অবস্থানকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এসব জাতি দেশপ্রেমের অনবদ্য উদাহরণ তৈরি করেছে। অর্থনীতি, বিজ্ঞান, জ্ঞানে আজ দেশগুলো পরাশক্তি। অন্যের ভাষা শিখে এগোনো বেশ কঠিন। অথচ সহজ রাস্তাটি আজও আমরা নির্ধারণ করতে পারলাম না।

স্বাস্থ্য শিক্ষা, প্রকৌশল নিয়ে একটি বিশ্বমানের বাংলা অনুবাদের বই আজও পাঠ্যপুস্তক হিসেবে পেলাম না। যারা আমরা শিক্ষিত হিসেবে দাবি করি, তাদের জন্য লজ্জার বিষয়।

অনেক রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা। এই ত্যাগের পর সেই ভাষা ৫০ বছরে কতটুকু এগোল, প্রশ্ন রাখাই যায়। ইংরেজি শিখে কতটুকু এগোলাম আমরা? ইংরেজি-হিন্দির মিশ্রণে অনেকটা গোঁজামিলে মিশ্রিত সংস্কৃতিতে আমরা, ভাষার প্রতি সেই শ্রদ্ধাবোধ অটুট থাকেনি। অটুট থাকেনি দেশপ্রেম। মাতৃভাষার প্রতি যেমন প্রেম নেই, তেমনি প্রেম নেই দেশ মাতৃভূমির প্রতি। তাই অবক্ষয় আমাদের শক্তিহীন করে তুলছে। অবক্ষয়ের ভয়াবহতা নিয়ে বলার কিছু নেই। আমাদের প্রত্যয় হোক একুশের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে যথার্থ কাজটি দ্রুত সমাপ্ত করা।

বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩৮ থেকে ৪০ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ। আমরা জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা বাংলা চাই অথচ নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি ভালো বাংলা বই প্রকাশ করি না। এটা স্ববিরোধিতা। 

ঘুরে দাঁড়ানো ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই। নিঃশেষিত পরাজয় নিশ্চয়ই কোনো সমাধান হতে পারে না। অতিদ্রুততার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানো আমাদের প্রধান দায়িত্ব। হয়তোবা একটি সামাজিক বিপ্লব দরকার সুস্থ পরিবর্তনের। আত্মার শান্তি প্রার্থনা করছি, নিবেদন করছি শ্রদ্ধাবনত চিত্তে সালাম, রফিক, জব্বার, বরকতসহ সব বীর ভাষা শহীদদের।

প্রসঙ্গত, বাঙালি জাতি প্রাচীনকাল থেকে ভাষাপ্রেমী। ভারত ভাগ হয়েছিল ধর্মের ভিত্তিতে কিন্তু দেশের মানুষের প্রধান চেতনা ছিল ভাষা। অস্বাভাবিক আবেগ অনুভূতির বিষয় ভাষা; যা চূড়ান্তভাবে দেশপ্রেম সৃষ্টি করে। মা, মাতৃভূমি মাতৃভাষা যেকোনো মানবের জীবনে সেরা সম্পদ।  মানবসন্তানের তিনটি বিষয় নিয়ে কোনো অবহেলা কোনো মানুষ সহ্য করে না। এটা অপ্রতিরোধ্য একটি চেতনা। জিন্নাহকে পূর্ব বাংলার মুসলমানরা ৪৮ সালেও দেবতুল্য সম্মান করত।  লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান স্লোগান দিত।

প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত দুটি ভূখণ্ডের দুটি ভিন্ন ভাষার জাতিসত্তাকে মিলিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম থেকেই সমস্যা। এই ভাষা আন্দোলনকেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টির পথে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মনে করা হয়। স্বাধীন দেশে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো দিনটিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ঘোষণা করার আগ পর্যন্ত বাংলাদেশে দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করা হতো। ইতিহাস বাংলাদেশের অনেকেরই জানা। কিন্তু আন্দোলনের প্রেক্ষাপট তৈরির পেছনে রয়েছে আরো অনেক সংগ্রামের ইতিহাস। সেই সংগ্রামের চেতনা কিন্তু আজও বাস্তবায়ন হয়নি।

১৯৪৮ সালের প্রথম ভাষা আন্দোলনের সময়েই ২৪ মার্চের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের কনভোকেশনের ভাষণে পাকিস্তানের বড় লাট মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করা হবে, কথাটা উচ্চারণের পরপর সব ছাত্রর উচ্চকণ্ঠের প্রতিবাদ না, না ধ্বনিত হয়েছিল। মনে হলো বাংলা মায়ের সন্তানরা বুকে আঘাত পেয়েছে, আমরা বায়ান্নতে রুখে দাঁড়ালাম। সেই চেতনার ওপর দাঁড়িয়ে আমরা স্বাধীনতাকে ছিনিয়ে আনলাম ১৯৭১ সালে। মূল চেতনাই বাঙালি, বাংলা ভাষার চেতনা।

আজও কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা চালু হয়নি। একুশের চেতনা বলতে আমরা কী বুঝি। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে জাতিরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাই হয়েছে সেই জাতির মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা জাতীয় জীবনের ভাষা হিসেবে গ্রহণ জীবিকার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট করার মাধ্যমে। আমরা আজও পিছিয়ে আছি। আমরা বিদেশী ভাষা চর্চা করব প্রয়োজনে কিন্তু নিজের ভাষাকে সমৃদ্ধ করব সবার আগে।

নিজের ভাষার সবকিছুকে গতিশীল করা যত সহজ। গবেষণা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় নিজের ভাষায় মানুষ উত্কর্ষে পৌঁছতে পারে। আজও নিজের ভাষায় বিশ্বমানের জ্ঞানচর্চার উপকরণ তৈরি করতে না পারা চরম অবক্ষয়, অপমান।

ফিরে দাঁড়ানো ছাড়া আমাদের কোনো গত্যন্তর নেই। নিঃশেষিত পরাজয় নিশ্চয়ই কোনো সমাধান হতে পারে না। অতিদ্রুততার সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ানো আমাদের প্রধান দায়িত্ব। উচ্চশিক্ষায় বাংলা ভাষার ব্যবহার বাড়াতে প্রয়োজন একটি সামগ্রিক সামাজিক উদ্যোগ।

 

আবু ইউসুফ মো. আব্দুল্লাহ: প্রাবন্ধিক-গবেষক

চেয়ারম্যান, নর্দান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ ট্রাস্ট

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন