বাড়ছে শ্রবণ সমস্যা

শব্দদূষণ রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করা হোক

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সাম্প্রতিক প্রতিবেদন বলছে, বর্তমানে বিশ্বের ১৬০ কোটি মানুষ শ্রবণ সমস্যায় ভুগছে। ২০৫০ সালে যা ২৫০ কোটিতে উন্নীত হবে। অর্থাৎ উল্লিখিত সময়ে বিশ্বের প্রতি চারজনের একজন শ্রবণ সমস্যায় ভুগবে। বৈশ্বিক চিত্রের বাইরে নয় বাংলাদেশও। শ্রবণজনিত সমস্যায় আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে এখানে। এক পরিসংখ্যানমতে দেশে ৫৭ লাখ ৬০ হাজার মানুষ কোনো না কোনো ধরনের শ্রবণ সমস্যায় ভুগছে। মোট জনসংখ্যার যা প্রায় দশমিক শতাংশ। বলা চলে, বধিরতা দেশে এখন অন্যতম বড় জনস্বাস্থ্য সংকট হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। সংকটের ব্যাপ্তি বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্যসংশ্লিষ্টদের দ্রুত সক্রিয়তা প্রয়োজন। 

শ্রবণজনিত সমস্যার পেছনে রোগ, জন্মগত, বয়স পরিবেশগত ফ্যাক্টর রয়েছে। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে পরিবেশগত ফ্যাক্টরই এখন দেশে মানুষের শ্রবণশক্তি হ্রাসের প্রধান কারণ হচ্ছে। জীবন-জীবিকার প্রয়োজনে মানুষ শহরমুখী হচ্ছে। যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্ন উচ্চ আওয়াজসম্পন্ন হর্নের ব্যবহার, জনসভা, মাইকের ব্যবহার, শিল্প-কারখানার শব্দ, লাউডস্পিকারের শব্দ প্রভৃতি মিলিয়ে শহরগুলোয় শব্দদূষণ অনিয়ন্ত্রিত। সংগত কারণে শহর এলাকার মানুষ শ্রবণজনিত সমস্যায় ভুগছে বেশি। এক জরিপ মতে, দেশে শব্দদূষণের কারণে প্রায় সাড়ে ১০ শতাংশ, মধ্যকর্ণের প্রদাহের ( সিএসওএম) কারণে সাড়ে শতাংশ এবং মধ্য কর্ণে পানি জমায় (ওএমই) শতাংশ মানুষ কানে কম শোনে।  এর বাইরে বয়সের কারণে কানে কম শোনা মানুষের হার সাড়ে ৩৫ শতাংশ। কানের রোগ বাদ দিলে শব্দদূষণই বড় মাত্রায় শ্রবণ সমস্যা বাড়িয়ে তুলছে বৈকি। বেড়ে চলা অপরিকল্পিত নগরায়ণের প্রভাবে সমস্যা যে আরো প্রকট হবে, তা অনুমেয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে জাতীয় পরিসরে সমস্যা খুব একটা গুরুত্ব পাচ্ছে না। তার প্রমাণ অনেক দেশের মতো বাংলাদেশে কান শ্রবণসেবা এখনো জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় ভালোভাবে একীভূত হয়নি। স্বাস্থ্যবিষয়ক তথ্য ব্যবস্থায় সমস্যা যথাযথভাবে নথিভুক্ত করা হয় না। তদুপরি, বধিরতার চিকিৎসার ক্ষেত্রে প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতার ঘাটতিও বিদ্যমান। দেশে ইএনটি সার্জনের (নাক, কান, গলা চিকিৎসক) সংখ্যা মাত্র ৬০৪, অডিওলজিস্ট মাত্র ১০ এবং শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষক ১০৬ জন। অথচ ভারতে আট হাজার ইএনটি সার্জন, প্রায় চার হাজার অডিওলজিস্ট এবং শ্রবণপ্রতিবন্ধীদের জন্য ১৮ হাজারের বেশি শিক্ষক রয়েছেন। বড় ব্যাপার হলো, উল্লিখিত জনবল বড় শহরেই অনেকটা কেন্দ্রীভূত। ফলে দেশে কানের রোগে ভোগা শ্রবণশক্তি হারানো মানুষদের জন্য চিকিৎসাপ্রাপ্তি বেশ চ্যালেঞ্জিং।

সন্দেহ নেই, মানুষের জন্য শ্রবণ একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবেদনক্ষমতা। পারিপার্শ্বিক পরিবেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার ক্ষেত্রে এটি অপরিহার্য। শ্রবণক্ষীণতা বধিরতা মানুষকে সমাজে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। বধিরতার সমস্যা শিশুর ভাষাশিক্ষা, লেখাপড়া সামাজিক যোগাযোগ ব্যাহত করতে পারে। ব্যক্তির মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্ক বজায় রাখার সক্ষমতার ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সর্বোপরি, জীবন-জীবিকার ক্ষেত্রেও ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারে। সুতরাং এটিকে শুধু স্বাস্থ্য ইস্যু হিসেবে দেখলে হবে না, অর্থনৈতিক সামাজিক প্রভাবের দৃষ্টিকোণ থেকেও দেখাটা জরুরি। নইলে যথাযথভাবে সংকটের ভয়াবহতা ব্যাপকতা উপলব্ধি করা সম্ভব নয়। 

বধিরতা একটি উদীয়মান জনস্বাস্থ্য সমস্যা হলেও দেশের জাতীয় স্বাস্থ্য পরিকল্পনায় এখনো কান শ্রবণসেবাবিষয়ক হস্তক্ষেপগুলো যথাযথভাবে অঙ্গীভূত করা হয়নি। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার অংশ হিসেবে এটিকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থায় যুক্ত করার ওপর তাগিদ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এটি আমলে নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার সময় এসেছে। শ্রবণক্ষীণতা বধিরতা অনেকটাই প্রতিরোধ করা সম্ভব। এজন্য পরিবেশগত সমস্যাগুলো সমাধানে উদ্যোগ নিতে হবে। শহরে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। যানবাহনে হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধে হাইকোর্ট বেশ আগেই নির্দেশনা দিলেও শহরে তা বন্ধ করা যায়নি। এখনো উচ্চ শব্দের হর্ন বাজিয়ে ছুটছে গাড়ি। এটি বন্ধ করা চাই। শুধু আইন বা নীতিনির্দেশনা থাকলে হবে না। তার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। শ্রবণশক্তি হ্রাস কানের রোগ প্রতিরোধের ক্ষেত্রে প্রাথমিক ধাপ হলো শুরুতে সমস্যা নির্ণয় করা। এরপর যথাযথ চিকিৎসা নেয়ার মাধ্যমে তা প্রতিরোধ করা। এতে শ্রবণশক্তি হ্রাসের শঙ্কা অনেকটাই কমে  আসে। এজন্য শিশুদের টনসিল, এডেনইড, সাইনাসের প্রদাহ এবং নাক গলার অ্যালার্জির চিকিৎসা করানোর পাশাপাশি প্রতিটি মানুষের শ্রবণমাত্রা নিয়মিত পরীক্ষা করার পরামর্শ চিকিৎসকদের। এক্ষেত্রে ব্যক্তিসচেতনতা বাড়িয়ে তোলা প্রয়োজন। আজকাল প্রযুক্তির কল্যাণে কিছু ব্যয়সাশ্রয়ী, কার্যকর সমর্থনমূলক পুনবার্সনমূলক থেরাপি উদ্ভাবিত হয়েছে, যা থেকে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই সুফল পেতে পারে। তার মধ্যে একটি হলো হিয়ারিং এইড (কৃত্রিম শ্রবণসহায়ক যন্ত্র) ভারতে বিনা মূল্যে হিয়ারিং এইড দেয়া হয়। বাংলাদেশে মধ্যস্বত্বভোগীর কারণে যন্ত্রটির দাম অনেক বেশি পড়ে যায়। ফলে সীমিত আয়ের মানুষ তা কিনতে পারে না। এটা সহজলভ্য করা উচিত। ষাটোর্ধ্ব বয়সীদের ডিভাইসটি সরকারের পক্ষ থেকে বিনা মূল্যে সরবরাহের কথা বলছেন কেউ কেউ। এটা আমলে নেয়া যেতে পারে। ট্রাফিক পুলিশ, গাড়িচালক, হেলপার, কলকারখানার শ্রমিকসহ সুনির্দিষ্ট কিছু পেশার কর্মীরা শ্রবণ সমস্যায় বেশি ভুগছে। তাদের চিকিৎসা নিশ্চিতের পাশাপাশি সহায়ক যন্ত্র সরবরাহ করতে হবে। পর্যাপ্ত বিশ্রাম যেন নিতে পারে, সেদিকে নজর দিতে হবে।

গতকাল পালিত হওয়া বিশ্ব শ্রবণ দিবসে সরকারি মেডিকেল কলেজগুলোয় অডিওলজি বিভাগের উন্নয়ন, সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্জদের সংখ্যা বাড়ানো, জাতীয় পর্যায়ে গবেষণা বৃদ্ধি, শ্রবণসহায়ক প্রযুক্তি সাশ্রয়ী সুলভ করা, আগামী পাঁচ বছরের জন্য বধিরতা  রোধে জাতীয় পর্যায়ে কর্মকৌশল গ্রহণ, সর্বোপরি সর্বাত্মকভাবে শব্দদূষণ কমানোর পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে স্বাস্থ্য বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন