কভিডকালে ধনী-গরিব সবারই গন্তব্য দুবাই

মনজুরুল ইসলাম

দীর্ঘদিন ধরে দেশের উচ্চবিত্তদের অবকাশ যাপন চিকিৎসার উদ্দেশ্যে সবচেয়ে বড় গন্তব্য হিসেবে বিবেচিত ছিল সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো। তবে কভিড-১৯ সংক্রমণ প্রেক্ষাপটে বদলে গেছে সব হিসাব। ভিসা জটিলতায় প্রচলিত গন্তব্যগুলোয় যেতে পারছেন না উচ্চবিত্তরা। কারণে তারা বিকল্প হিসেবে বেছে নিয়েছেন দুবাইকে। প্রবণতা দেখা যাচ্ছে মধ্য নিম্নবিত্তদের মধ্যেও। যদিও এক্ষেত্রে উদ্দেশ্য ভিন্ন। বিশেষ করে নিম্নবিত্তদের। কর্মহীন স্বল্প আয়ের মানুষগুলো ভ্রমণ ভিসা নিয়ে দুবাই পাড়ি দিচ্ছেন মূলত অবৈধভাবে অবস্থান করে কাজের উদ্দেশ্যে। অভিযোগ রয়েছে, মূলত দালালদের প্রতারণার ফাঁদে পড়েই অবৈধ অভিবাসনের পথে পা বাড়াচ্ছেন তারা।

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের আরিফ হোসেন সম্প্রতি ভিজিট ভিসায় দুবাই গিয়েছেন। শ্রম ভিসায় না গেলেও দুবাই প্রান্তের এজেন্ট তাকে একটি ফুড ডেলিভারি কোম্পানিতে চুক্তিভিত্তিক কাজের সুযোগের কথা জানিয়েছে। তবে এখনো তিনি কাজ শুরু করেননি।

আরিফ হোসেন গতকাল বণিক বার্তাকে জানান, নোয়াখালীর স্থানীয় একটি কলেজ থেকে তিন বছর আগে স্নাতক পাস করেন তিনি। দেশে কোনো কর্মসংস্থান না হওয়ায় বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করেও অর্থাভাবে সম্ভব হয়নি। তবে কয়েক মাস আগে স্থানীয় এক এজেন্ট তাকে খুবই কম খরচে বিদেশ পাঠানোর প্রস্তাব দেয়। এমনকি সেখানে গিয়ে চাকরির ব্যবস্থা করারও দায়িত্ব নেয় ওই এজেন্ট। এজেন্টের সহায়তায় প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচ করে গত সপ্তাহে দুবাই পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন আরিফ।

ভিসা প্রক্রিয়াকরণ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দুবাইয়ে চিকিৎসা সেবাগ্রহীতাদের যাতায়াত শুরু হয় গত বছর আগস্টে। পরবর্তী সময়ে গত অক্টোবর থেকে ভিজিট ভিসা দেয়া শুরু করে দুবাই। সে সময় থেকেই উচ্চবিত্তরা অবকাশ যাপনের জন্য বেছে নিতে শুরু করেন দুবাইকে। তবে ভিজিট ভিসা প্রাপ্তি সহজ হওয়ার সুযোগে প্রতারণায় নেমে পড়ে একশ্রেণীর দালাল চক্র। সাধারণ মানুষকে উন্নত চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিনই ওয়ার্ক ভিসার পরিবর্তে ভিজিট ভিসার মাধ্যমে ইউএইতে পাঠানো হচ্ছে।

মানি এক্সচেঞ্জগুলো বলছে, সাম্প্রতিক সময়ে দুবাইগামী সাধারণ যাত্রীরাই খুচরা বাজার থেকে ডলার কিনছেন। প্রতি যাত্রী ৫০ হাজার টাকা থেকে শুরু করে কয়েক লাখ টাকার ডলার কিনছেন। এর প্রভাব পড়েছে ডলারের বাজারেও। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে ডলারের বাজার আবার ঊর্ধ্বমুখী হতে শুরু করেছে। আমদানি খাত প্রবৃদ্ধির ধারায় ফেরায় ব্যাংক খাতে ডলারের মূল্য বাড়ছে। পাশাপাশি ডলারের দাম বাড়তে শুরু করেছে কার্ব মার্কেটেও। রাজধানীর মতিঝিল, গুলশান বসুন্ধরা সিটির বেশ কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা জানান, মঙ্গলবার প্রতি ডলারের মূল্য ৮৬ টাকা ৭০ পয়সায় বিক্রি হয়েছে। যদিও এক সপ্তাহ আগেও খুচরা বাজারে প্রতি ডলারের মূল্য ছিল ৮৬ টাকার নিচে।

ভ্রমণ ভিসা প্রক্রিয়াকরণে সহায়তাকারী প্রতিষ্ঠান নিউ ডিসকভারি ট্যুরস অ্যান্ড লজিস্টিকসের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইফতেখার আলম ভূইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, বাংলাদেশী উচ্চবিত্তরা নিয়মিত যেসব দেশে চিকিৎসা অবকাশ যাপনে যেতেন তারাই এখন বিকল্প হিসেবে দুবাইয়ে যাচ্ছেন। তবে থাইল্যান্ড মালয়েশিয়ার তুলনায় দুবাইয়ে চিকিৎসা ব্যয়বহুল। তবে এমন যাত্রীও ভিজিট ভিসা নিয়ে যাচ্ছেন তারা হয়তো এর আগে কোনো দেশে ভ্রমণ করেননি।

করোনার কারণে গত বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল আকাশপথে নিয়মিত যোগাযোগ। সেই সঙ্গে বন্ধ হয়ে যায় ট্যুরিজমও। তবে গত জুনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের এয়ারলাইনস বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ফ্লাইট শুরু করে। প্রথমদিকে ট্রানজিট যাত্রী পরিবহন করলেও পরবর্তী সময়ে ভ্রমণ চিকিৎসা ভিসায় বাংলাদেশীদের প্রবেশাধিকার দিতে শুরু করে দুবাই। এর পর থেকেই অবকাশ যাপন চিকিৎসা সেবা নিতে উচ্চবিত্তরা দেশটিতে যেতে শুরু করেন।

উল্লেখ্য, স্বাভাবিক সময়ে ভারত, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর মালয়েশিয়ায় প্রতি বছর প্রায় ১২ লাখ বাংলাদেশী রোগী চিকিৎসার জন্য যায়। ২০১৭ সালেই মেডিকেল ভিসায় ভারতে চিকিৎসা নিয়েছে লাখ ২১ হাজার ৭৫১ জন বাংলাদেশী।

এদিকে মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম শ্রমবাজার সংযুক্ত আরব আমিরাতে (ইউএই) কর্মী প্রেরণে এক রকম স্থবিরতা চলছে ২০১২ সাল থেকে। গৃহকর্মী ছাড়া দেশটিতে বৈধ পথে এখন শ্রমিক ভিসা নেই বললেই চলে। অবস্থায় করোনাকালে ভিজিট ভিসাকেই প্রতারণার অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে বেশকিছু অসাধু জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান ট্রাভেল এজেন্সি। ভিজিট ভিসায় গেলে চাকরির ভিসা পাইয়ে দেয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।

জানা গেছে, বাংলাদেশীদের জন্য সর্বোচ্চ তিন মাস মেয়াদি ভিজিট ভিসা চালু রেখেছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ভিসায় কাজের অনুমতি থাকে না। মেয়াদ শেষে দেশটিতে অবস্থান করলেই আটক জরিমানার বিধান রয়েছে। তবে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের পরিপ্রেক্ষিতে ফ্লাইট চলাচল বন্ধ হয়ে গেলে গত এপ্রিলের শেষ ভাগে ভিজিট ভিসায় এসে আটকে পড়াদের জন্য ভিসার শর্তে সাময়িক ছাড় দেয় ইউএই সরকার। সময় দেশটিতে অবস্থানকারীদের ভিসার মেয়াদ বাড়ানোর সুযোগ দেয়া হয়। একই সঙ্গে ভিজিট ভিসায় আসা প্রবাসীরাও  বিভিন্ন কোম্পানিতে কর্মী হিসেবে সাময়িকভাবে ভিসা পরিবর্তনের সুযোগ পান। বিষয়টিকেই প্রতারণার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে অসাধু চক্র।

জনশক্তি রফতানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) একাধিক নেতা জানান, ইউএইতে একটি ভিজিট ভিসা নিতে খরচ হয় প্রায় ১৫ হাজার টাকা। তবে কাজের আশায় ভিজিট ভিসা নিয়ে যারা যাচ্ছে তাদের সব মিলিয়ে খরচ করতে হয় আড়াই-তিন লাখ টাকা। তারা জানান, একশ্রেণীর অসাধু এজেন্সি, দালাল চক্র বিমানবন্দরের কিছু কর্মচারী মিলে এয়ারপোর্ট কন্ট্রাক্ট নামে ভিজিট ভিসাধারীদের ইউএই প্রবেশের ব্যবস্থা করছে। এজন্য প্রায় জনপ্রতি ৫০-৭০ হাজার টাকা পর্যন্ত লেনদেন হয়। বাকি অর্থ খরচ হয় উড়োজাহাজ ভাড়া অন্যান্য খাতে।

ভিজিট ভিসায় গিয়ে কাজের জন্য থেকে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন ইউএইর বাংলাদেশ দূতাবাসও। সম্প্রতি আবুধাবির বাংলাদেশ দূতাবাস এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বর্তমানে ভিজিট ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাতে এসে ওয়ার্ক ভিসায় পরিবর্তনের সুযোগ নেই। তাই চাকরি বা কাজের উদ্দেশ্যে ভিজিট ভিসা নিয়ে বাংলাদেশ থেকে ইউএইতে না যাওয়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছে দূতাবাস। বিষয়ে কোনো রিক্রুটিং এজেন্ট বা দালালের প্ররোচনায় প্রলুব্ধ না হওয়ার জন্য সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে।

কেবল প্রকৃত পর্যটকরা ভিজিট ভিসায় ইউএইতে ভ্রমণ করতে পারেন উল্লেখ করে দূতাবাসের বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়েছে, ভিজিট ভিসায় যেতে হলে উড়োজাহাজের ফিরতি টিকিট, হোটেল রিজারভেশন অথবা যারা স্বজনের স্পন্সরে গেছে তাদের প্রকৃত তথ্য এবং ভ্রমণকালীন খরচের জন্য কমপক্ষে হাজার দিরহাম সঙ্গে রাখতে হবে। এর পরই ইউএই বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের জিজ্ঞাসাবাদে প্রকৃত ট্যুরিস্ট নয় বলে সন্দেহ হলে তাকে ফেরত পাঠানো হতে পারে। আর ভিজিট ভিসায় গিয়ে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে ফেরত না গেলে ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর প্রথম দিন ২০০ দিরহাম এবং পরবর্তী প্রতিদিনের জন্য ১০০ দিরহাম হারে জরিমানা দিতে হবে।

ইউএইতে বৈধভাবে নতুন কর্মী যেমন যেতে পারছেন না, তেমনি কাজ হারিয়ে প্রতিনিয়ত ফিরে আসতে হয়েছে অনেককেই। গত বছর এপ্রিল থেকে বিভিন্ন দেশের ফেরত আসা কর্মীদের পরিসংখ্যান বলছে, কভিড-১৯ মহামারীতে সৃষ্ট সংকটে ফিরে আসা প্রবাসী কর্মীদের অর্ধেকের বেশি এসেছেন মধ্যপ্রাচ্যের দুই দেশ সৌদি আরব সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) থেকে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন