যশোরের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে করোনার প্রভাব কাটছে

আবদুল কাদের, যশোর

করোনা মহামারীর ধাক্কায় স্থবির যশোর জেলার ব্যবসা-বাণিজ্য সচল হতে শুরু করেছে। কলকারখানাগুলোয় উৎপাদন শুরু হয়েছে। তবে মন্দাভাব এখনো কাটেনি। মহামারীর প্রভাবে যে আর্থিক ক্ষতি হয়েছে তাও পুষিয়ে উঠতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। সংকট মোকাবেলায় সরকারি প্রণোদনার ঋণ সুবিধা আরো এক বছর অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

যশোর শহরের ঝুমঝুমপুরে অবস্থিত বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) শিল্পনগরী। বিসিক কর্মকর্তারা জানান, শিল্পনগরীতে মোট ১১৮টি ইউনিটের ১১৫টিতে শিল্প-কলকারখানা চালু আছে। এসব শিল্প-কারখানায় হাজার ৯১৮ জন শ্রমিক কর্মরত আছেন। এর মধ্যে পুরুষ শ্রমিক হাজার ৯৩২ জন নারী শ্রমিক হাজার ৯৮৬ জন।

বিসিক শিল্পনগরীতে অবস্থিত গাড়ির যন্ত্রাংশ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এনায়েত ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানার স্বত্বাধিকারী আকতার হোসেন বলেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে কোনো ক্রেতা ছিল না। অর্ডার না থাকায় যন্ত্রাংশ উৎপাদন বন্ধ রাখা হয়। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে বিক্রি শুরু হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এক বছরের মধ্যে আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে পারব বলে আশা করছি।

বিসিকের এমইউসিইএ ফুডসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শ্যামল দাস বলেন, আমরা ১৯টি দেশে হিমায়িত চিংড়ি রফতানি করি। করোনার কারণে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়। ফেব্রুয়ারি থেকে রফতানি চালু হয়েছে। পর্যন্ত পাঁচটি দেশে চিংড়ি রফতানি করেছি। ব্যবসা সচল হলেও আমাদের ঘুরে দাঁড়াতে কমপক্ষে আরো এক বছর লাগবে।

যশোর বিসিক শিল্পনগরী মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ মোস্তফা আলী বলেন, বিসিকের সব প্রতিষ্ঠান কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বছর প্রতিষ্ঠানগুলো সচল হতে শুরু করেছে। কিন্তু বিসিক কর্তৃপক্ষ আমাদের পাশে দাঁড়ায়নি। কোনো ধরনের চার্জ তারা মওকুফ করছে না। এতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিকরা বেকায়দায় পড়েছেন।

দেশের চামড়া খাতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে যশোরের অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়ায় অবস্থিত এসএএফ লেদার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড। বছরে ৪০০ কোটি টাকার চামড়াজাত দ্রব্য রফতারি করে থাকে চারবারের জাতীয় রফতানি ট্রফিজয়ী প্রতিষ্ঠানটি।

এসএএফের জেনারেল ম্যানেজার আবুল ইসলাম বলেন, করোনা মহামারী সব শেষ করে দিয়েছে। বিদেশীরা আসতে না পারায় এখনো আমাদের ব্যবসা মন্দাভাব কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আশা করছি চলতি মাস থেকে অর্ডার আসা শুরু হবে।

যশোরের আরেকটি বড় বাণিজ্যখাত মোটর মোটরসাইকেল যন্ত্রাংশের বাজার। শুধু বেনাপোল কাস্টমস খাত থেকে বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকার রাজস্ব পায়।

শহরের ফারিয়া মোটরসের মালিক রেজোয়ান আহমেদ মুরাদ বলেন, আমি বড় গাড়ির ইঞ্জিন ভারত থেকে আমদানি করে বিক্রি করি। সারা দেশের ক্রেতারা আসেন আমাদের এখানে। আগে প্রতিদিন দুয়েকটি করে ইঞ্জিন বিক্রি হতো। কিন্তু গত এক বছরে কোনো ক্রেতা ছিল না। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে যন্ত্রাংশ আমদানি শুরু করেছি। ক্রেতারা আসতে শুরু করলেও ব্যবসায় গতি নেই।

যশোর মোটরপার্টস ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শাহিনুর হোসেন ঠাণ্ডু বলেন, দেশের সবচেয়ে বড় মোটর যন্ত্রাংশের বাজার যশোরে। জেলায় খাতে বছরে কমপক্ষে হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়। মহামারীতে খাত ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ব্যবসায়ীরা ব্যাংক ঋণ নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন। আরো এক বছর সরকারি ঋণ সুবিধা পেলে তারা উপকৃত হবেন।

যশোরের আবাসিক হোটেল ব্যবসায় চলছে চরম মন্দাবস্থা। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গুরুত্বপূর্ণ জেলায় পাঁচতারকাসহ বিভিন্ন মানের হোটেল রয়েছে। চলতি বছরের শুরু থেকে গ্রাহক পেতে শুরু করলেও হোটেলগুলোয় করোনায় সৃষ্ট মন্দাভাব কাটেনি। সিটিপ্লাজা হোটেলের স্বত্বাধিকারী ইয়াকুব আলী বলেন, জানুয়ারি থেকে কিছু গ্রাহক পাওয়া যাচ্ছে। তবে সংখ্যা খুবই নগণ্য।

যশোর জেলা উইমেন চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি তনুজা রহমান মায়া বলেন, করোনা মহামারী নারী উদ্যোক্তাদের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে। জেলায় সাড়ে ৪০০ হস্তশিল্প কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় অন্তত ১০ হাজার শ্রমিক কাজ করেন। প্রায় সব শ্রমিক বেকার হয়ে পড়েছিলেন। বর্তমানে কিছুটা সচল হচ্ছে ব্যবসা।

যশোর চেম্বার অব কমার্সের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, করোনা মহামারীর প্রভাবে জেলার অর্থনৈতিক কার্যক্রম ধসে পড়েছিল। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা পুঁজি হারিয়ে পথে বসে। সব মিলিয়ে জেলায় হাজার কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়। তবে টিকাদান কর্মসূচি চালু করোনায় আক্রান্তের হার কমে আসায় অর্থনীতির চাকা ঘুরতে শুরু করেছে। তবে ক্ষতি পুষিয়ে নিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ভালোভাবে সচল হতে আরো এক বছর সময় লাগতে পারে। এজন্য সরকারকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন