ভিন্ন চিন্তা

অর্থনীতিবিদদের নতুন করে যা ভাবা জরুরি

ডিয়ান কোয়েল

আমেরিকান লোকসংগীত শিল্পী উডি গ্রাথরির একটা গান আছে এমন, দিস ল্যান্ড ইজ ইয়োর ল্যান্ড শিল্পী যেখানে রেডউড ফরেস্ট, গমক্ষেত আর আমেরিকার গোল্ডেন ভ্যালির কথা উল্লেখ করেছেন। উডি তার গানের মাধ্যমে একটি নৈতিক দাবি নিয়ে হাজির হয়েছেন যে জমিতে উৎপাদিত শস্যে ভাগ থাকবে সবার। তার গানটি অর্থনৈতিক যে সত্যকে তুলে ধরে তা হলো, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার সবাইকে প্রভাবিত করে। বিশেষ করে আমরা যদি তা নিঃশেষ করে ফেলি কিংবা দায়িত্বহীনভাবে ব্যবহার করি, তাহলে এর অর্থনৈতিক পরিণতি আমাদের নিজেদের আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে।

মানুষ তার অর্থনৈতিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে প্রকৃতির জোগান দেয়া পরিষেবার ব্যাপক ব্যবহার করে। অ্যাডাম স্মিথ ডেভিড রিকার্ডোর মতো ধ্রুপদী অর্থনীতিবিদ, তারা যখন লিখেছিলেন তখন বর্তমানের তুলনায় অর্থনীতিতে কৃষির অবদান অনেক বেশি ছিল। তারা খুব ভালো করেই জানতেন যে প্রকৃতির পরিসরের মধ্যেই মানুষের কার্যকলাপগুলো সংঘটিত হয়েছে এবং যা প্রকৃতির অনুগ্রহের ওপরই নির্ভর করে। তাদের পর্যালোচনায় তারা সবসময় ভূমিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কিন্তু আধুনিক অর্থবিদরা অর্থনীতির সংজ্ঞা পরিমাপক থেকে প্রকৃতিকে অনেকখানি বাদ দিয়ে গেছেন।

আজ তাই জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে যে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে সবাই বেশ মনোযোগী। এমনকি তালিকায় বিনিয়োগকারীরাও রয়েছেন। তবে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ ঘিরে প্রকৃতির ভূমিকা অন্যান্য দিক আজও অনেকটাই উপেক্ষিত।

উদাহরণস্বরূপ, ধনী কৃষকরা তাদের ফসল বিক্রি করে যে অর্থ উপার্জন করেন, তা জিডিপিতে গণনা হয়। কিন্তু শস্য পরাগায়নে মৌমাছিদের ভূমিকা কিংবা মাটির উর্বরা শক্তির বিষয়গুলো জিডিপিতে ধরা হয় না। অথচ মৌমাছির অভাবে যেমন ফসলের পরাগায়ন বাধাগ্রন্ত হবে, তেমনি জমির উর্বরা শক্তি কমে গেলে তা ফসলের উৎপাদনকে প্রভাবিত করবে। কিংবা বিশুদ্ধ বাতাসের উপকারিতাগুলোকে যেমন প্রচলিত অর্থনৈতিক পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত করা হয় না, তেমনি গণনা করা হয় না দূষিত বায়ুর নেতিবাচক প্রভাবকেও। তবে করোনায় মৃত্যু শ্বাসতন্ত্রের রোগের মধ্যকার যোগসূত্রটি কিন্তু বিষয়গুলোকে স্পষ্ট করে। এমনকি আমরা যদি ভোঁতা কোনো লেন্সও ব্যবহার করি তাহলেও দেখতে পাব এতে মানবসম্পদ ভবিষ্যতের উপার্জন দুটোই হ্রাস পাচ্ছে।

ইউকে ট্রেজারির অর্থায়নে সম্প্রতি আমার কেমব্রিজ সতীর্থ পার্থ দাসগুপ্তের নেতৃত্বে জীববৈচিত্র্যের অর্থনীতির ওপর একটি স্বতন্ত্র পর্যালোচনা পরিচালিত হয়। এটি অর্থনৈতিক বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে প্রকৃতিকে পুনরুদ্ধারের জন্য একটি শক্তিশালী দৃষ্টিকোণ নিয়ে এসেছে। পার্থ যুক্তি দেখিয়েছেন, একটি দেশের প্রাকৃতিক সম্পদকে কোনোভাবেই ব্রডব্যান্ড, ব্রিজ কিংবা দক্ষ জনগোষ্ঠীর মতো উৎপাদনশীল মূলধনের তুলনায় কোনো অংশে কম বলে আমাদের গণ্য করা উচিত নয়। সমাজের ইতিবাচক কল্যাণ বয়ে আনার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের তাই একটি দেশের সম্পদের সার্বিক পোর্টফোলিও পর্যালোচনা করা উচিত। এর অর্থ স্বতন্ত্র সম্পদের অবচয়গুলো বিবেচনায় নিতে হবে, যার মধ্যে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন প্রজাতি বাস্তুতন্ত্র এবং তাদের মধ্যকার পরিপূরক।  

ধরনের কাঠামোর অধীনে, একটি দেশের সরকার দীর্ঘমেয়াদি পোর্টফোলি পদ্ধতি গ্রহণ করে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য ব্যয়বহুল, জ্বালানি-নিবিড় কিংবা দেখতে অসুন্দর কংক্রিটের বাঁধ নির্মাণ না করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে। বরং এর পরিবর্তে কম খরচে বিনিয়োগ করতে পারে বৃক্ষরোপণ জলাভূমি সংরক্ষণে। যেমন কৃষকরা ভালো করেই জীববৈচিত্র্য হ্রাস এবং মৌমাছির সংখ্যা কমে যাওয়ার পরিণতি সম্পর্কে সচেতন। তবে অনুর্বর ভূমি এবং ফসলের কম উৎপাদনের নেতিবাচক পরিণতির বিষয়ে কম সচেতন। আর এর কারণেই তারা ব্যাপকভাবে রাসায়নিক সারের ওপর নির্ভরশীল। একের পর এক প্রকৃতির গহিনে মানুষের অনধিকার প্রবেশ, প্রকৃতির শৃঙ্খলা ভাঙার কারণে ইবোলা, কভিড-১৯-এর মতো রোগের প্রাদুর্ভাব বাড়ছে। এসবের জন্য সমাজ, অর্থনীতি সরকারগুলোকে অনেক বেশি মূল্য চুকাতে হচ্ছে।

তাই এখনো খানিকটা আশা রয়েছে যে সময় নষ্ট হওয়ার আগেই বা চূড়ান্ত ক্ষতিসাধনের আগে অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ নীতিগুলো প্রকৃতিকে নতুনভাবে আবিষ্কার করতে সক্ষম হবে। যাতে প্রকৃতির কাছ থেকে প্রাপ্ত সুবিধাগুলো আমরা নিয়মিত পেতে পারি এবং সবার জীবনযাত্রার মান বজায় রাখা সম্ভব হয়। বিনিয়োগকারীরা এখন খুব ভালোভাবেই জলবায়ু পরিবর্তনের বা পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির ঝুঁকিগুলো সম্পর্কে ওয়াকিবহাল। তারা আরো জেনে গেছেন প্রকৃতির ক্ষতিসাধনের পরিণতি কী এবং কতটা ভয়াবহ হবে। তাই এখন তারা জীববৈচিত্র্য ধরে রাখা, পরিচ্ছন্ন বায়ু দূষণহীন সমুদ্রের গুরুত্ব যে কত বেশি, তা সাদা চোখে দেখতে পারবেন। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যুক্তরাজ্যের পরিবেশ, খাদ্য পল্লীবিষয়ক মন্ত্রণালয় নয়, পার্থ দাশগুপ্ত কমিশনপ্রাপ্ত হয়েছেন অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে। যা- হোক, অর্থনীতিতে প্রকৃতির পরিষেবার ভূমিকা সম্পর্কে জানার জন্য ধরনের পরিসংখ্যানের সংকলন গুরুত্বপূর্ণ।

আমার বিশ্বাস, কাজটি অগ্রগতির পক্ষে ভূমিকা রাখবে। জাতিসংঘ প্রাকৃতিক মূলধন পরিমাপের মান নির্ধারণ করেছে। তাছাড়া জিডিপি এবং অন্যান্য অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান পরিমাপের জন্য ব্যবহূত সংজ্ঞাগুলো সংশোধন করার চলমান প্রক্রিয়াটি তথাকথিত উৎপাদন গণ্ডি মধ্যে বাস্তুতন্ত্রের পরিষেবাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করার একটি সুযোগ।

বর্তমান করোনা মহামারী আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরনো, তবে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা হচ্ছে, মূল্য নির্ধারণের জন্য অর্থ একটি দুর্বল পরিমাপক। হাসপাতালের দারোয়ান থেকে বাড়িতে পণ্য পৌঁছে দেয়া গাড়িচালকদের মতো গুরুত্বপূর্ণ কর্মীদের বেতন প্রায়ই অনেক কম হয়। বর্তমানে লকডাউনের কারণে ঘরে বসে যারা শিক্ষার্থীদের ক্লাস নিচ্ছেন বা তদারক করছেন কিংবা বাড়তি কাজ হিসেবে রান্না করছেন, তারা নিশ্চয়ই গৃহস্থালির কাজের মূল্য সম্পর্কে একটি তাজা উপলব্ধি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন। ২০২০ সালের মার্চ থেকে পার্কে প্রবেশের মূল্য হঠাৎ করে অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। কারণ প্রকৃতি থেকে আমরা যে পরিমাণ পরিষেবা পাই, তার মূল্য বর্তমানে পরিমাপ করা হয় না। আর পরিমাপ করা হলেও তার মূল্যমান খুব কম ধরা হয়। আর অর্থনীতিবিদরা তো তা রীতিমতো উপেক্ষাই করেন।

ধারণা কোনোভাবেই আর টেকসই নয় (কথাটি কিন্তু প্রায়ই ব্যবহার করা হয়, কারণ যা টেকসই নয়, তার স্থায়িত্ব কম) আগামী বছরগুলোয় মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক অনিবার্যভাবে পরিবর্তিত হবে। আর অর্থনীতির নীতিনির্ধারকরা অবশ্যই পরিবর্তনকে প্রভাবিত করবেন। মনে রাখা জরুরি, অজ্ঞতা দিয়ে আত্মরক্ষা হয় না।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

ডিয়ান কোয়েল: কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক পলিসি বিষয়ের অধ্যাপক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন