করোনাকালে কিছুটা পরিস্থিতির অবনমন ঘটলেও বিগত বছরগুলোয় শিশু ও মাতৃমৃত্যু রোধে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখযোগ্য। নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্য খাতে এটি অন্যতম বড় অর্জন। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এক্ষেত্রে বিরাজমান গ্রাম-শহরের মধ্যকার উচ্চবৈষম্য নতুন উদ্বেগ হিসেবে হাজির হয়েছে। বিবিএসের সাম্প্রতিক তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে গ্রামে প্রতি লাখে ১৯২ জনের বিপরীতে শহরে মাতৃমৃত্যু ১২৩ জন। আবার গ্রামে পাঁচ বছরের নিচে শিশুমৃত্যুর হার প্রতি হাজারে ২৯ জন হলেও শহরে ২৬ জন। একইভাবে এক বছরের নিচে শিশুমৃত্যু গ্রামে ২২ জন ও শহরে ২০ জন এবং এক মাসের কম বয়সী শিশুমৃত্যুর হার যথাক্রমে ১৬ ও ১৫ জন। অর্জিত সাফল্য আরো টেকসই করতে হলে উল্লিখিত ব্যবধান কমানোর বিকল্প নেই।
আমাদের স্বাস্থ্য খাতের বড় শক্তির দিক হলো সুবিন্যস্ত অবকাঠামো। দেশে বিভাগীয় শহর থেকে শুরু করে গ্রাম পর্যন্ত স্তরায়িত সুন্দর স্বাস্থ্য অবকাঠামো রয়েছে। তবে উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ের স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় চিকিৎসকের অনুপস্থিতি, সেবিকাসহ অন্য জনবলের দক্ষতার অভাব এবং চিকিৎসা সরঞ্জামের অপ্রতুলতার মতো কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। তার মধ্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোর মাতৃস্বাস্থ্য বিভাগের অবস্থা আরো নাজুক। সেখানে প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সার্বক্ষণিক উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায়নি। আছে যন্ত্রপাতি ও অন্য চিকিৎসাসামগ্রীর ঘাটতিও। ফলে মানসম্মত সেবাদান ব্যাহত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রসবকালে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি—এ দুটিই প্রসূতি মায়ের মৃত্যুর প্রধান কারণ। অথচ এর মধ্যে কোনোটিই জটিল সমস্যা নয়। রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি বন্ধের সুনির্দিষ্ট ওষুধ আছে, যা দুর্মূল্য ও দুর্লভ নয়। সঠিক সময়ে তা প্রয়োগ করলেই মৃত্যু এড়ানো সম্ভব। কিন্তু সমস্যা হলো, গ্রামীণ এলাকার সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রক্তক্ষরণ ও খিঁচুনি বন্ধের ওষুধের সরবরাহ থাকে না। জরুরি মুহূর্তে জীবন রক্ষাকারী এ দুটি ওষুধ পাওয়া না যাওয়ার কারণে অনেক প্রসূতির মৃত্যু হচ্ছে। বিষয়টি হতাশাজনক। সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ে আজকাল বেসরকারি উদ্যোগেও অনেক স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। বাহ্যিকভাবে দেখতে দৃষ্টিনন্দন হলেও হাসপাতাল-ক্লিনিকগুলো সার্বিকভাবে সুসজ্জিত নয়। দক্ষ জনবল, প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের ঘাটতি প্রকট। তদুপরি সেখানে চিকিৎসা ব্যয়ও অনেক বেশি। ফলে বিশেষত দরিদ্র পরিবারের প্রসূতি মায়েরা চিকিৎসার জন্য ওইসব প্রতিষ্ঠানে যেতে চান না। হয়রানি, অবহেলার কারণে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রেও চিকিৎসা নিতে চান না। ফলে বিপুলসংখ্যক প্রসূতি মায়ের ঘরেই প্রসব হচ্ছে এবং জরুরি মুহূর্তকালীন চিকিৎসার অভাবে অনেকেই মারা যাচ্ছেন। এছাড়া গ্রামীণ মেয়েদের মধ্যে শিক্ষার অভাব, স্বাস্থ্য সচেতনতায় ঘাটতি এবং বাল্যবিবাহের প্রাবল্যের কারণেও অনেকেই অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে কিশোরী বয়সে গর্ভবতী হচ্ছে। এ ধরনের প্রসূতি মায়েরা ঝুঁকিতে থাকে বেশি। গ্রামে মাতৃমৃত্যু বেশি হওয়ার এটিও একটি কারণ।
এদিকে শিশু স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও কিছু ঘাটতি রয়ে গেছে। দেশে শিশুমৃত্যুর একটি বড় কারণ নিউমোনিয়া। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা অনুসারে, শিশু চিকিৎসার ক্ষেত্রে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে ১০টি সুবিধা থাকা প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে শৈশবকালীন অসুস্থতার সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, প্রশিক্ষিত কর্মী, শিশুদের ওজন মাপার স্কেল, থার্মোমিটার, গ্রোথ চার্ট (বয়স অনুপাতে ওজন ও উচ্চতার তালিকা), ওষুধ, খাওয়ার স্যালাইন, জিংক ট্যাবলেট/সিরাপ ও এমোক্সিসিলিন সিরাপ। অথচ এক জরিপে উঠে এসেছে গ্রামীণ পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রগুলোর শিশু বিভাগের সার্বিক অবস্থা বেশ খারাপ। মাত্র শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এ ১০টি সুবিধা রয়েছে। বাকি ৯৫ শতাংশ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সব কয়টি প্রয়োজনীয় সুবিধা নেই। বলা চলে, উভয় ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধার অভাবে শহরের তুলনায় গ্রাম পর্যায়ে শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি।
সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যে (এমডিজি) সফলতা দেখাতে পারলেও উভয় সূচকে গ্রাম-শহরের ব্যবধান ঘোচাতে না পারলে এসডিজি লক্ষ্য অর্জন কঠিন। কারণ বৈশ্বিক এ উন্নয়ন লক্ষ্যে অসমতা দূরীকরণে গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। সুতরাং বিষয়টিকে গভীরভাবে বিবেচনায় নিয়ে জুতসই পরিকল্পনা নিতে হবে। এক্ষেত্রে বাইরের অভিজ্ঞতা আমলে নেয়া যেতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে গর্ভকালীন ও জন্মের পর শিশুমৃত্যুর হার কমাতে ভারত নিউ বর্ন অ্যাকশন প্ল্যান নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। এ লক্ষ্যে তারা গর্ভকালীন মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা, রাষ্ট্রীয় আর্থিক সহায়তামূলক কর্মসূচি জননী-শিশু সুরক্ষা কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। ওই কর্মসূচির অধীনে গর্ভবতী নারী সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে বিনা মূল্যে যাতায়াত সুবিধার পাশাপাশি সন্তান প্রসব ও নিখরচায় সিজার সুবিধাপ্রাপ্ত হন। শ্রীলংকা প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি কয়েকটি ধাপে মা ও শিশুর সেবা দিয়ে থাকে। একজন গর্ভবতী নারীকে সন্তান জন্মদানের আগে আগে চারবার পরীক্ষা করার সরকারি নির্দেশ রয়েছে দেশটির নিবন্ধনভুক্ত ধাত্রীদের প্রতি। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বয়স পাঁচ বছর না হওয়া পর্যন্ত স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভিন্ন সেবা দেন তারা, যা সফলভাবে দেশটির মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার কমাতে সাহায্য করছে। এ ধরনের উদ্যোগ ও নীতিগুলো আমাদের এখানেও পর্যালোচনা ও প্রবর্তন করা যেতে পারে।
সত্য যে আমাদের দেশেও শিশু ও মাতৃস্বাস্থ্যসেবায় আগের চেয়ে উন্নতি হয়েছে। সার্বিকভাবে শিশু-মাতৃমৃত্যুর হার কমার বিষয়টি তারই প্রমাণ। এখন গ্রাম পর্যায়ে মানসম্মত সেবা জোগানোই চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় পল্লী ও দুর্গম এলাকায় রোগীর অনুপাতে চিকিৎসক ও অন্য জনবল বাড়াতে হবে। সরকারি-বেসরকারি সব স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের মাতৃ ও শিশু বিভাগের সেবার মান আরো উন্নত করা দরকার। তার জন্য সেখানে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ বাড়ানো চাই। এছাড়া স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় প্রশিক্ষিত ধাত্রীদের উপস্থিতির পাশাপাশি আনুষঙ্গিক সুযোগ-সুবিধাও নিশ্চিত করতে হবে। গ্রাম পর্যায়ের বেসরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোয় স্বাস্থ্য বিভাগের যথাযথ তদারকি নেই। নজরদারি বাড়িয়ে বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থারও আমূল সংস্কার প্রয়োজন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গ্রামে এখনো প্রসূতি মায়ের ৮০ শতাংশই ঘরে প্রসব হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রশিক্ষিত ধাত্রী পাওয়াও দায়। কাজেই প্রশিক্ষিত ধাত্রীর সংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজনে প্রসবের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য বিভাগের সক্রিয়তায় গ্রাম পর্যায়ে মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত হবে বলে প্রত্যাশা।