শ্রদ্ধাঞ্জলি

রাইট মিলস থেকে আবুল মকসুদ : জীবনীর মাঝে সমাজের খোঁজে

আব্দুল্লাহ শহীদ

সমাজবিদ্যায় ‘তথ্য তত্ত্ব কী’, তা যথেষ্ট তর্কসাপেক্ষ। ধরেন, আপনিডিডাক্টিভগবেষণা পদ্ধতিতে প্রশিক্ষিত। আপনি জানতে চান একটি এলাকায় লোকজন কোন স্বাদের কফি বেশি পছন্দ করে। তথ্য সংগ্রহ করতে কাছের কফির দোকানে গেলেন। প্রয়োজনীয় অনুমতি সাপেক্ষে জেনে নিলেন কয়জন খদ্দেরএক্সপ্রেসো কফিআর কয়জনক্যাপাচিনো কফিপান করেছে। এই পর্যবেক্ষণ কয়েক মাস করে প্রস্তাব করলেন লোকজন ক্যাপাচিনো বেশি পছন্দ করে। আরো তথ্য-উপাত্ত জটিল পদ্ধতি ব্যবহার করে দাবি জোরালো করা যায়। তবে ধরনের  অগভীর, গড়পড়তা উপসংহারের বিপক্ষে ছিলেন সমাজবিদ্যার অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠাতা জার্মানির ম্যাক্স ওয়েবার। বাহ্যিক আচরণ (যেমন কফি পান) দেখে মানব আচরণের উপসংহারে অনেক জরুরি বিষয় আলোচনার বাইরে থেকে যায়। আমাদের ব্যক্তির একান্ত অনুভূতিও আমলে নিতে হয়, কারণ মানুষের আছে জটিল মনন। যেমন জসিম জামাল একই কফির দোকানে বসে একই সময়ে একই স্বাদের কফি পান করতে পারে। কিন্তু দুজনের কার্যকারণ, অনুভূতি ভিন্ন হতে পারে। অনুভূতির তর্কে সমাজবিদ্যায় নতুন পদ্ধতিগত আঙ্গিক যোগ হলো। প্রসঙ্গত চার্লস রাইট মিলস চলে আসেন। রাইট মিলস ভাবছিলেন মানুষের আচরণ তার অনুভূতির গভীরে যেতে গেলে তথ্য জোগাড় করতে হবে তিন জায়গা থেকেইতিহাসজীবনী, সামাজিক কাঠামো। নিয়ে মিলস বিস্তারিত লিখেছেন তার বই দ্য সোসিওলজিকাল ইমাজিনেশনে (১৯৫৯)

কিন্তু ডিডাক্টিভ সায়েন্সের উত্তরণকালে ব্যক্তির জীবনী ইতিহাসকে আমলে নিয়ে সমাজতত্ত্ব গবেষণা অনেকটা স্তিমিত হয়ে আসে। সেই প্রবণতা দুনিয়ার পুব পশ্চিমে সমানে দেখা গেছে। ব্যক্তিজীবনীকে ডিডাক্টিভ সায়েন্সের আওতায় আনতে গেলে অনেকের ব্যক্তিজীবনকে লম্বা সময় ধরে পর্যবেক্ষণ করে বিভিন্ন সংখ্যায় রূপান্তর করে পরিসংখ্যানের পরীক্ষার উপযোগী করতে হয়। রকম গবেষণা যথেষ্ট সময় ব্যয়বহুল। সম্প্রতি প্রথম সারির সামাজিক, অর্থনৈতিক বিজ্ঞানের জার্নালআমেরিকান ইকোনমিক রিভিউ’, ‘দ্য রিভিউ অব ফাইন্যান্সিয়াল স্টাডিজকোম্পানির নির্বাহীদের জন্মকাল কীভাবে তাদের করপোরেট সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলে তার ওপরে আর্টিকেল প্রকাশ করেছে। থেকে কিছুটা হলেও অনুমান করা যায়, জীবনী থেকে সমাজ বোঝার গুরুত্ব ফিরে আসছে। সমাজবিদ্যা ডেমোগ্রাফিতেলাইফ কোর্স’-এর সঙ্গে মানব আচরণের সম্পর্কের গবেষণার ধারা অনেকদিন ধরেই চালু রয়েছে। তাছাড়া দ্রুত প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের কালেযাপিত জীবনের মাঝে সমাজ গভীরভাবে অনুধাবনগবেষণার গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে।

বাংলাদেশ পশ্চিম বাংলায় জীবনীকে ক্ষেত্র ধরে গবেষণা তেমন ব্যাপক আকার লাভ করেনি। পরিতাপের বিষয় হলো, যারা ধরনের গবেষণা করেছেন, তাদের কাজ নিয়ে একাডেমিক তাত্ত্বিক আলোচনার ব্যাপ্তি গুণ উভয়ই সীমিত। ধারার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ছিলেন সদ্য ইহধাম ত্যাগ করা সৈয়দ আবুল মকসুদ। যদিও মিডিয়া সংবাদকর্মীরা যথাযথ কারণেই আবুল মকসুদের কলামিস্ট অ্যাক্টিভিস্ট ইমেজ নিয়েই শোকগাথা রচনা করছেন, আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই মকসুদের লেখনীর তাত্ত্বিক শিক্ষাগত মূল্য ঢের আছে। তার পুস্তকের পাঠ আলোচনা আমাদের জ্ঞানের ক্ষেত্র প্রসারিত করবে। আবুল মকসুদেরভাসানী’, ‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরবুদ্ধদেব বসুনিয়ে লেখা বইগুলো রাইট মিলসের পদ্ধতিকে আমাদের দেশীয় ক্ষেত্র দিয়ে নতুন আঙ্গিক দিতে পারে বলে মনে করি। তাছাড়া জীবনের মাধ্যমে সমাজ ভ্রমণ, অবলোকন বিশ্লেষণতিন ক্ষেত্রেই আবুল মকসুদের লেখা যথেষ্ট শিক্ষণীয়। এখানে তার লেখা ঢাকার বুদ্ধদেব বসু বইটি নিয়ে আলোচনা করছি।

সত্যের খোঁজে জীবনের পথে

বাংলার অন্যতম বহুবিদ বুদ্ধদেব বসুর ঢাকায় যাপিত জীবন নিয়ে লিখতে গিয়ে আবুল মকসুদ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতেই সত্যানুসন্ধানকে প্রাধান্য দিয়েছেন। তার  কাছে আধুনিকতার মানেই হলো সত্যানুসন্ধান। বুদ্ধদেব বসুর বন্দনার চেয়ে প্রাসঙ্গিক সময় সমাজের নির্মোহ বিশ্লেষণ করেছেন। ঢাকার মফস্বলী সংস্কৃতি যেভাবে বসুর চিন্তাকে সীমিত করেছে, তা বলতে ইতস্তত করেননি। পরিবারের ধর্মাচার (যেমন সংস্কৃত শেখা) কীভাবে বসুর লেখাকে প্রভাবিত করেছে, তাও তুলে ধরেছেন অকপটে। বিশেষ করে বসুর মহাভারতের ওপর লেখা কাব্যগ্রন্থ নাটক তার শৈশবের সংস্কৃতচর্চা দিয়ে সমৃদ্ধ হয়েছে। আরেকটি পদ্ধতিগত বিষয়ে আবুল মকসুদ বেশ সতর্ক ছিলেন। তা হলো, বসুর একান্ত অনুভূতিটাই বসুর নিজ শব্দে প্রকাশ। মকসুদের ভাষা বসুর মুখে তলে দেননিএক চৌকস গবেষকের মতোই কাজ।

কার্যকারণ যোগ

বুদ্ধদেব বসুর লেখায় যে নগ্নতা যৌনতার প্রভাব, তার শিকড় অনুসন্ধান করতে গিয়ে আবুল মকসুদ স্রেফ আনুমানিক বক্তব্যে দায় সারেননি। বরং বসুর একেবারে ইশকুল জীবনের লেখালেখিতে তার চিহ্ন ধরার চেষ্টা করেছেন। ইশকুলের সহপাঠী পর্যায়ে তথ্য জোগাড় করে তার অনুমান প্রস্তাব করেছেন। জীবনী থেকে সামাজিক কার্যকারণ আরোপণের ভিত্তি অনেক নড়বড়ে হয়। সেই বিষয়ে আবুল মকসুদ ছিলেন সজাগ। তাই বিভিন্ন তথ্যসূত্র একাট্টা করে ট্রায়াংগুলেশন তথা বিভিন্ন তথ্য পদ্ধতির সমন্বয়ে ফিরে গেছেন, যতটুকু সম্ভব, যেখানেই সম্ভব। চৌকস অনুসন্ধানী আবুল মকসুদের কাছে আমরা সে রকমই আশা করেছি।

চর্চার ক্ষেত্রের সমাজ, রাজনীতি প্রকৃতি

ঢাকার তত্কালীন সাহিত্যচর্চার অবস্থা সুযোগ স্বাভাবিকভাবেই বসুর সাহিত্য মনকে প্রভাবিত করেছে। কিন্তু সেই সাহিত্যচর্চার সামাজিক অবস্থান তথ্য-উপাত্ত দিয়ে চিত্রিত করা বেশ কঠিন ব্যাপার। কলকাতার সঙ্গে ঢাকার সাহিত্যচর্চার তুলনামূলক চিত্র দিতে গিয়ে আবুল মকসুদ বেশ কাঠখড় পুড়িয়েছেন: ওই সময়ের লেখকদের বিভিন্ন লেখা ঘেঁটেছেন; বই ক্রয়-বিক্রয় প্রকাশনা স্থলের, দোকানপাঠের চিত্র তুলে ধরেছেনহাতে লেখা মুদ্রিত প্রকাশনা (বিশেষ করে সাহিত্য সাময়িকী) সংস্কৃতির বিবরণ দিয়েছেন। এসব তথ্য-উপাত্ত মকসুদের সাবলীল উপস্থাপনায় জীবন লাভ করেছে; চরিত্ররা যেন পাঠকের সামনে হাজির হয়ে তাদের প্রাসঙ্গিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন।

হালের রাজনৈতিক, সামাজিক আন্দোলন সাহিত্যিকদের কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করে। আবুল মকসুদ তার বিভিন্ন দিক অনুসন্ধান করেছেন। তার বিশ্লেষণে বুদ্ধদেব বসুর রাজনৈতিক অনাগ্রহটাই বেশি ধরা পড়েছে। সাহিত্যচর্চায় ধর্ম, এলাকা রাজনীতিকেন্দ্রিক উন্নাসিকতা বসুর অপছন্দ ছিল, তবে তিনি নিজে তা সক্রিয়ভাবে এড়াতে পারেননি।

প্রকৃতি বিভিন্নভাবে সাহিত্যিক মনকে প্রভাবিত করে। ঢাকার আবাসস্থল পুরানা পল্টনের সবুজ গাছগাছালি, পাখপাখালির কিচিরমিচির, বড়লোকের বাগানে বিচিত্র ফুলের সমারোহ সুবাস সবই বসুর রোমান্টিক দিককে পুষ্ট করেছে। পুরানা পল্টনকে বুদ্ধদেব বসু নাম দিয়েছেনঢাকার দার্জিলিং বসুর লেখায় সেই রোমান্টিকতার প্রভাব মকসুদের বিশ্লেষণে এসেছে।

মানুষকেন্দ্রিক সমসাময়িকতা

বসুর লেখায় বিভিন্ন লেখকের প্রভাব খুঁজে পান আবুল মকসুদ। তবে আপাতভাবে মনে হবে বসুর ওপরে রবীন্দ্রনাথ, সত্যেন, নজরুলের প্রভাব দেখাতে গিয়ে আবুল মকসুদ অনেকটা দায়সারাভাবেই কিছু পঙিক্ত আর বানানরীতির ওপর ভর করেছেন। কলকাতা গিয়ে বসুর ক্রিয়াপদ বিশেষ্য ব্যবহারে যে পরিবর্তন আসে তা মকসুদের নজর এড়ায়নি। আবার অন্যভাবে ভাবলে মনে হয় আবুল মকসুদ এই অনুকরণ বিশ্লেষণের দায় সচেতনতভাবেই পাঠকের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন।

বসু সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন, অন্যরা বসুকে কীভাবে মূল্যায়ন করেছেন, উভয়ের তথ্য সৈয়দ আবুল মকসুদ সংগ্রহ করেছেন। শুধু তাই নয়, বসু কীভাবে অন্যদের মূল্যায়নের বিপরীতে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তাও মকসুদের বিশ্লেষণে এসেছে। একজন সাহিত্যিক শুধু তার সমসাময়িক এবং প্রৌঢ়দের সম্পর্ক দিয়ে প্রভাবিত হন না; তাদের ভবিষ্যত্মুখী আশা-আকাঙ্ক্ষা থাকে। তারা তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সঙ্গে বিভিন্ন মিথস্ক্রিয়া করেন। বসুর সেই দিকটিও আবুল মকসুদ তথ্য-উপাত্ত দিয়ে তুলে ধরেছেন।

আবুল মকসুদ আজ নেই। জীবনের মাঝে সমাজের খোঁজ করতে করতে তিনিও সমাজের জীবনীর সঙ্গে মিশে গেলেন। আমার আশা, অদূরভবিষ্যতে সৈয়দ আবুল মকসুদকে আমরা সেই সমাজেই খুঁজে পাব। হয়তো ভবিষ্যতের কেউ আজকের সমাজের খোঁজ করতে গিয়ে আবুল মকসুদের জীবনী বিশ্লেষণ করবেন। সেই বিশ্লেষণে তারা আবুল মকসুদের পদ্ধতিগত সততার আশ্রয় নিতে পারেন।

 

আব্দুল্লাহ শহীদ: পিএইচডি গবেষক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ

কর্নেল ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাষ্ট্র

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন