খাদ্যে ৭৪ লাখ টন ঘাটতির শঙ্কা

ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তার জন্য কৃষির স্থবিরতা কাটাতে হবে

১৯৭২ সালে দেশে খাদ্যশস্য উৎপাদন হয়েছিল কোটি ১০ লাখ টন। সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য যা পর্যাপ্ত ছিল না। স্বাধীনতার ৫০ বছরে মানুষ বেড়েছে দ্বিগুণ, তবে খাদ্যশস্য উৎপাদন হচ্ছে তিন গুণের বেশি। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বখাদ্যশস্যের উৎপাদন যখন গাণিতিক হারে বৃদ্ধি পায় তখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় জ্যামিতিক হারেএকে ভুল প্রমাণিত করেছি আমরা। কেবল উৎপাদন বৃদ্ধিই নয়, হেক্টরপ্রতি ধান উৎপাদনের দিক থেকেও অনেক দেশকে ছাড়িয়ে গেছে বাংলাদেশ। বাংলার কৃষকরা এখানেই থেমে যাননি। একই জমিতে বছরে একাধিক ফসল চাষের দিক থেকেও বাংলাদেশ উদাহরণ তৈরি করেছে। কৃষি উৎপাদন বাড়িয়ে খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করায় জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো বাংলাদেশের সাফল্যকে বিশ্বের জন্য উদাহরণ হিসেবে প্রচার করেছে। কিন্তু একটা পর্যায়ে এসে খাদ্যশস্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার ধরে রাখতে পারছে না বাংলাদেশ। কৃষিতে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজমান। অবস্থায় গতকাল দৈনিক বণিক বার্তায় খাদ্যে ৭৪ লাখ টন ঘাটতির শঙ্কা শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়েছে। যেখানে খাদ্যঘাটতির আশঙ্কাকে তুলে ধরা হয়েছে। তাই বিদ্যমান করোনা পরিস্থিতি অন্যান্য বিষয় আমলে নিয়ে ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তার স্বার্থে কৃষির স্থবিরতা কাটানো জরুরি।

বিভিন্ন সময় সরকার কৃষিতে ভর্তুকি প্রণোদনা দিলেও খাতকে ঘিরে বিনিয়োগ কম। কৃষির আধুনিকায়নে সরকারি ভর্তুকি বরাদ্দ বাড়ানোর পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। উদ্যোগের অংশ হিসেবে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করতে হবে। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক নির্ধারণ করা জরুরি। যেখানে ব্যক্তিখাতের বিনিয়োগকারীদের উৎসাহিত করার জন্য কৃষিতে আকর্ষণীয় বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরির পরিকল্পনা থাকবে। ইন্দোনেশিয়া তানজানিয়া যেমন পলিসি ফ্রেমওয়ার্ক ফর ইনভেস্টমেন্ট ইন এগ্রিকালচারের (পিএফআইএ) অধীনে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা, করনীতি, অবকাঠামো উন্নয়ন, আর্থিক খাতের উন্নয়ন, বাণিজ্যনীতি সংস্কারের পাশাপাশি মানবসম্পদ, গবেষণা নতুন নতুন উদ্ভাবনের মাধ্যমে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। শুধু সরকারি নয়, বেসরকারি বিনিয়োগ বাড়িয়ে কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অনেক দেশই ভবিষ্যৎ খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে।

করোনার অভিঘাতে বিশ্বে খাদ্য উৎপাদন হ্রাসের আভাস মিলছে। অভ্যন্তরীণ খাদ্য সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে কৃষিপণ্য রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে বেশকিছু দেশ। একদিকে দাম বাড়ছে, অন্যদিকে পর্যাপ্ত খাদ্যশস্য মিলছে না। অবস্থায় অর্থ ব্যয় করেও খাদ্য আমদানি সম্ভব নাও হতে পারে। অতীত অভিজ্ঞতায় আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে যে, ২০০৭-০৮ সালের বৈশ্বিক খাদ্য সংকটের সময় ভিয়েতনাম, ভারত, শ্রীলংকা, থাইল্যান্ডসহ খাদ্য উদ্বৃত্ত দেশগুলো অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটাতে রফতানি বন্ধ করে দিয়েছিল। সে সময় অর্থ ব্যয় করেও বিশ্ববাজার থেকে খাদ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি। তাই ভবিষ্যতের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে আমাদেরও অন্যান্য দেশের অভিজ্ঞতাগুলো আমলে নিয়ে অগ্রসর হওয়া চাই।

একই সঙ্গে কৃষির যান্ত্রিকীকরণ জরুরি। চীন যেমন সুপার হাই প্লান্ট ডেনসিটি টেকনিক ব্যবহারের মাধ্যমে শুষ্ক অঞ্চলগুলোতে শস্য উৎপাদনের পরিমাণ বাড়িয়েছে। চারা রোপণ থেকে শুরু করে উন্নত আধুনিক সেচ পদ্ধতি প্রবর্তনের মাধ্যমে তারা শস্য উৎপাদন বৃদ্ধি করেছে। বাংলাদেশেও সরকারের পক্ষ থেকে দিকনির্দেশনা নীতিসহায়তার প্রয়োজন। দূর করতে হবে মানসম্মত বীজের প্রাপ্যতা সংকটও। দেশে ছোট ছোট খামারভিত্তিক চাষাবাদের কারণে প্রায়ই জমিতে যন্ত্র ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে সমবায়ের ভিত্তিতে উৎপাদন কার্যক্রম পরিচালনা করা যেতে পারে। তবে খাদ্যশস্যের অপচয় বিনষ্ট হওয়া থেকে রক্ষায় কার্যকর আধুনিক মজুদ ব্যবস্থাও গড়তে হবে। রিমোট সেন্সিং টুল ব্যবহারের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদন ফসলের ক্ষতিবিষয়ক গবেষণা জোরদার করা প্রয়োজন। আধৃনিক কৃষি যন্ত্রপাতির ব্যবহার ফসল ফসল উত্তোলন-পরবর্তী ক্ষতি কমায় এবং উচ্চমানসম্মত পণ্য উৎপাদনে দ্রুততম সময়ানুগ পরিচালনা নিশ্চিত করে। তাই উচ্চফলন লাভজনক লাগসই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবন অবলম্বনের মাধ্যমে টেকসই কৃষি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

ধান থেকে চাল তৈরিতে বিশ্বের উন্নত প্রযুক্তির চালকল ব্যবহার হলেও আমরা এখনো প্রথাগত চালকল ব্যবহারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। দেশের চালকলগুলোর যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে মাড়াই চালের দুই-তিন কেজি ভেঙে যাচ্ছে। চালকলে উন্নত প্রযুক্তির অভাবেই অপচয় হচ্ছে চালের বড় একটি অংশ। অপচয় রোধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা চাই। কৃষিপণ্যের সহজলভ্যতা, সংরক্ষণকাল বৃদ্ধি করতে সরকারি বেসরকারি পর্যায়ে আধুনিক সংরক্ষণাগার, প্যাকেজিং হাউজ কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনের দিকে জোর দেয়া জরুরি। টেকসই কৃষি ব্যবস্থা তথা খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে কৃষি উৎপাদন, কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ নিরবচ্ছিন্ন বিপণনে বিনিয়োগ বৃদ্ধির বিকল্প নেই। কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কৃষিপণ্য পরিবহনে ভর্তুকি এবং টোল ফ্রি পরিবহন ব্যবস্থা প্রচলন করা যেতে পারে। সরকারি মজুদ ব্যবস্থার দুর্বলতায়ও অনেক সময় অভ্যন্তরীণ বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। এটি নিয়ন্ত্রণে রাখতে সরকারি মজুদ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেটি সিঙ্গাপুর করেছে। খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়েও দেশটি সুষ্ঠুভাবে খাদ্যপণ্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে সমর্থ হয়েছে।

উৎপাদিত ফসলের যথাযথ সংরক্ষণ সুষ্ঠু বাজারজাতের পাশাপাশি উৎপাদন মৌসুমে কৃষকের ন্যায্যমূল্য প্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করার বিষয়টি এখানে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। দেখা যায় যে, সরকারের অভ্যন্তরীণ ধান-চাল সংগ্রহে সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে খুব স্বল্প পরিমাণ ধান কেনা হয়। যেখানে কৃষকের উৎপাদন ব্যয় সঠিকভাবে বিবেচনায় না নিয়ে অনেকটা একতরফাভাবে ধানের সংগ্রহ মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এতে কৃষক ধান চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। অবস্থায় সরকারের পক্ষ থেকে ন্যায্যমূল্যে প্রকৃত কৃষকের কাছ থেকে ধান-চাল সংগ্রহ কার্যক্রম বাড়াতে হবে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্য পরিবহন বিক্রয় নিশ্চিত করা, বিক্রেতার সঙ্গে ভোক্তার সংযোগ স্থাপনে মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য হ্রাস করা জরুরি। বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন পণ্যের উৎসাহজনক দামও নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন