অটোমেশন বীমা খাতের চেহারা বদলে দেবে

মো. জালালুল আজিম প্রগতি লাইফ ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সিইও। কৃষি প্রকৌশলে স্নাতক, পরে এমবিএ ডিগ্রি নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন ইনস্টিটিউট থেকে। কর্মজীবনের শুরু ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোয়। কাজ করেছেন আলিকোর মতো বিশ্বখ্যাত বিদেশী বীমা প্রতিষ্ঠানে। প্রধান নির্বাহী ছিলেন ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স প্রগতি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স লিমিটেডের। সম্প্রতি বীমা দিবস উপলক্ষে খাতটির বর্তমান অবস্থা, চ্যালেঞ্জ সম্ভাবনা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা হয় তার। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন রুহিনা ফেরদৌস

করোনা-পরবর্তী বীমা খাতের কী অবস্থা? কেমন দেখছেন?

করোনা হঠাৎ করেই আসছে, আমরা এটার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। লকডাউনের সময় অফিসের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে সত্যিকার অর্থে এপ্রিল-মে মাসজুড়ে আমরা ঘরেই বন্দি ছিলাম। জীবন বীমা ব্যবসাটা এখন পর্যন্ত ফেস টু ফেস কমিউনিকেশনের মাধ্যমে হয়। উন্নত দেশে আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে বীমা পণ্য বিক্রি এখনো তেমন চালু হয়নি। এপ্রিল মাসে ব্যবসাশূন্য থাকতে হয়েছে। মে মাসে সামান্য কিছু ব্যবসা হয়েছে। তাছাড়া করোনার প্রাথমিক ভীতির কারণে লোকজন কেউ কারো সঙ্গে দেখাও করেনি। এখনো করতে চায় না। তবে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। সব মিলিয়ে ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, আমাদের প্রতিষ্ঠানও মারাত্মকভাবে ক্ষতির মুখে পড়েছে। পরে যখন অফিস খোলার অনুমতি দেয়া হলো তখন আমরা স্বাস্থ্যবিধি মেনে অফিস শুরু করি। তখন থেকে আবার কাজকর্ম শুরু হলো এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভীতিটাও কমে আসে। আমরা ভয় পাচ্ছিলাম ২০১৯ সালে আমাদের যে পরিমাণ ব্যবসা ছিল ২০২০ সালে ততটা হবে না। কিন্তু বছর শেষে আমরা দেখলাম শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে আমাদের। করোনা এখনো আছে, তবে জীবনযাত্রা অনেকটা স্বাভাবিকভাবে চলাতে আমরা ক্ষতিটা পুষিয়ে নিতে পেরেছি। ভ্যাকসিন চলে এসেছে। মানুষেরা টিকা নিচ্ছে। আমার মনে হয়, করোনার আগের ওই প্রভাবটা আর ফিরে আসবে না। তবে দুই-একটা জায়গা ছাড়া করোনা প্রতিটি ব্যবসাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। হাসপাতাল কিংবা স্যানিটাইজার কোম্পানির ব্যবসা হয়তো ভালো হয়েছে। কিন্তু যেহেতু অনেকেই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তার প্রভাব ধীরে ধীরে অর্থনীতিতে পড়বে।

করোনার কারণে আপনাদের ব্যবসায়িক গতিপথ কি পরিবর্তিত হবে?

আমরা যে খুব ভালো ব্যবসা করতে পারবতেমনটা আমি আশা করছি না। ২০২১ সালের পাশাপাশি ২০২২ সালেও আমাদের এটা ফেস করতে হবে। তবে জীবন বীমা কোম্পানির জন্য করোনা খানিকটা ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। ব্যবসায় আমরা মানুষের সঙ্গে যখন আলোচনা করি তখন কিন্তু ঘুরেফিরে জীবন-মৃত্যু সম্পর্কিত কথাবার্তাগুলো আসে। স্বাভাবিক সময় মানুষ মৃত্যু নিয়ে চিন্তা করে না। কিন্তু করোনা এসে আমাদের মধ্যে ভাবনাটা ঢুকিয়ে দিয়েছে। মানুষ এখন মৃত্যু নিয়ে বেশি চিন্তা করছে, তাই জীবন বীমার পাশাপাশি তারা স্বাস্থ্য বীমার চিন্তা করছে। আমি বলব, এটা জীবন বীমা কোম্পানির জন্য ইতিবাচক বিষয়। সাধারণ মানুষকে বীমার গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝাতে সক্ষম হচ্ছি আমরা। এছাড়া ব্যবসায়িকভাবে আমরা উপলব্ধি করতে পারছি যে হিউম্যান ইন্টারঅ্যাকশন ছাড়া আমাদের ব্যবসা করতে হবে। এর মানে আমাদের ডিজিটাল প্রযুক্তির দিকে অগ্রসর হতে হবে। অর্থাৎ অটোমেশন। শুধু লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি নয়, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও আর প্রচলিত পথে ব্যবসা করতে পারবে না। এমন একটা বিকল্প ব্যবস্থা থাকতে হবে, যেখানে ঘরে বসেও আমরা অফিসের কাজ করতে পারি। সে ব্যবস্থা আমাদের করতে হবে। বীমা ব্যবসায় আমাদের চুক্তি অনুসারে ক্ষতিপূরণ দিতে হয়। আগে এখানে হার্ড কপি নেয়া হতো এখন আমরা সফট কপিও নিচ্ছি। কারণ আন্তর্জাতিক বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এখনো নিয়মিত অফিস শুরু করেনি। হোম অফিস করছে। তাদের কেউ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে যাচ্ছে, অবস্থায় ক্ষতিপূরণ দিতে হচ্ছে আমাদের। ডিজিটাল ক্লেইম সেটলমেন্ট পদ্ধতির মাধ্যমে আমরা তাদের দাবি পূরণ করছি।

মাঠ পর্যায়ে তো কিছু কাজ থাকে?

হ্যাঁ, কিছু কাজ তো আর অনলাইনে করা সম্ভব হবে না। সেখানে কিছু ম্যানুয়াল সাহায্য লাগবে। তবে ইন্স্যুরেন্সের নিয়ম হলো দুই বছর পার হয়ে গেলে তখন আর সংবীক্ষণ বাধ্যতামূলক নয়। বিদেশে যেমন এআই (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স) ব্যবহার করে। বাংলাদেশের দু-একটা সংস্থা কিন্তু এটার ব্যবহার করছে। আমরা যেমন ইলেকশন কমিশনের ডাটাবেজ ব্যবহার করতে পারছি। এনআইডির মাধ্যমে আমরা তথ্য যাচাই করতে পারছি। ডিজিটাল পদ্ধতিতে পেমেন্টে, ইএফটিএন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আমরা কাজ করছি।

কভিড-১৯- কারণে মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে। -সংক্রান্ত বীমা পলিসিতে কি আপনাদের হিসাব বা প্রিমিয়ামের কোনো পরিবর্তন হয়েছে?

বীমা পলিসিগুলো মহামারী বা অতিমারীর প্রভাববহির্ভূত। করোনার কারণে মৃত্যু হলে বা অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলে আমরা তাদের অর্থসহায়তা দিচ্ছি। এর জন্য এখনো ইন্স্যুরেন্স পলিসি প্রাইসিংয়ের ওপর তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি। তাছাড়া পলিসি প্রাইসিং বা বেনিফিটের পরিবর্তনসংক্রান্ত বিষয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইডিআরএ (বাংলাদেশ বীমা উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষঅনুমতির প্রয়োজন হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনায় বাংলাদেশে মৃত্যুহার কম এবং এখনো সহনীয় মাত্রায় রয়েছে। ফলে আমরা মূল্য পরিবর্তনের কোনো চিন্তা করছি না।

ইউরোপসহ উন্নত দেশগুলোতে প্রতিটা মানুষের বীমা করা বাধ্যতামূলক। আমাদের এখানে এখনো সে চর্চা তৈরি হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে কি রকম কোনো উদ্যোগ নেয়া উচিত বলে মনে করেন?

কিছু উদ্যোগ রয়েছে, যা সরকারের পক্ষ থেকে নেয়া উচিত। পাশাপাশি শুধু আইন করা নয় বাস্তবায়নও জরুরি। বহুতল কোনো ভবনে আগুন লাগলে ভবনের পাশাপাশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই আমি মনে করি বহুতল ভবন প্রতিটি মানুষের জন্য বীমা বাধ্যতামূলক করা উচিত। যেখানে এক শতাধিক কর্মী থাকবে সেখানে গ্রুপ ইন্স্যুরেন্স বাধ্যতামূলক থাকলেও অনেক কোম্পানি বীমা করে না। বহুতল ভবনের ক্ষেত্রে যদি বীমা করা না হয় তাহলে অনুমোদন দেয়া হবে না বা গ্যাস-বিদ্যুৎ কানেকশন দেয়া হবে না ধরনের আইন করা যেতে পারে।  ট্রেন, বাস দুর্ঘটনা বা লঞ্চডুবির সময় এটা নিয়ে হইচই হয় কিন্তু পরে আর কিছু করা হয় না। সেক্টরগুলোকে বাধ্যতামূলক বীমার আওতায় আনতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি উদ্যোগগুলো নেয়া হয় তবেই বীমার ব্যাপ্তি বাড়বে। আমরা যেমন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে ছাত্রদের স্বাস্থ্য বীমা নিয়ে কথা বলেছি। মুজিব বর্ষ উপলক্ষে এবারই হয়তো প্রতিষ্ঠানটি এটা চালু করবে। বীমা বর্ষ উপলক্ষে আইডিআরএ অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্কুলের শিক্ষার্থীদের বীমার আওতায় আনার পাইলট প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে।  মুজিব বর্ষ উপলক্ষে সবাইকে বীমার আওতায় আনার জন্য আমরা কাজ করতে পারি।

জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান শতাংশও নয়। সরকার বাংলাদেশকে উন্নত দেশে পরিণত করার স্বপ্ন নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। জিডিপিতে তাই বীমা খাতের অবদান - শতাংশ হওয়া জরুরি।  

বীমা কোম্পানির চ্যালেঞ্জগুলো কী?

অনেক কোম্পানি এসেছে। প্রতিযোগিতা বেড়েছে। পাশাপাশি নতুন সুযোগও তৈরি হয়েছে। প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আমাদেরও নতুন নতুন উদ্ভাবনী পণ্য নিয়ে আসতে হবে। ক্লেইম পরিশোধ করে নাইন্স্যুরেন্স কোম্পানিগুলোর এক ধরনের দুর্নাম আছে। অনেকের জন্য এটা সত্যসবার জন্য নয়। দুর্নাম ঘোচাতে হবে। যারা ক্লেইম দেয় না তাদের বাধ্য করতে হবে ক্লেইম প্রদানের জন্য। আর সাধারণভাবে যাতে খুব দ্রুত ক্লেইম দেয়া যায়সে ব্যবস্থাও করতে হবে। সরকারকে আমি বিশেষ ধন্যবাদ জানাই। ২০১৪ সালে জাতীয় বীমা নীতিতে সেক্টরের সমস্যাগুলোকে খুব সুন্দর করে চিহ্নিত করা হয়েছে। কীভাবে সমাধান করতে হবে, কারা করবে, কতদিনের ভেতর করবেতা উল্লেখ করা হয়েছে। দুর্ভাগ্যবশত তার শতাংশও বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারের পাশাপাশি নিয়ন্ত্রক সংস্থাসহ সবার সক্রিয় ভূমিকা থাকলে বীমা খাতের চেহারা বদলে যাবে।

বীমা দিবস নিয়ে পরিকল্পনা...

এবারের বীমা দিবসের প্রতিপাদ্য মুজিব বর্ষের অঙ্গীকার, বীমা হোক সবার গত বছর আমরা শোভাযাত্রার আয়োজন করেছিলাম। এবার স্বাস্থ্যবিধির কারণে ধরনের আয়োজন হবে না। তাছাড়া ঢাকায় যে বীমা মেলা হবে সেখানে সব প্রতিষ্ঠানই বীমা সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করবে। সেখানে সরাসরি বীমা গ্রাহক হওয়ার সুযোগ থাকবে। বীমা দিবস মার্চ মাস ঘিরে সব মানুষের কাছে বীমা সম্পর্কিত বার্তা পৌঁছার প্রচেষ্টা থাকবে কোম্পানিগুলোর।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন