ব্যাংকিংয়ে নীতিনৈতিকতা

অর্থঋণ মামলায় তামাদি বিষয়ে ধোঁয়াশা

ড. এসএম আবু জাকের

ব্যাংকাররা ঋণ আদায়ে যখন ব্যর্থ হন অর্থাৎ ঋণগ্রহীতা যদি ব্যাংকের অর্থ ফেরত প্রদানে গড়িমসি করেন তখন গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করে ব্যাংকের দাবি আদায় করা ছাড়া ব্যাংকারের কোনো বিকল্প থাকে না। তবে মামলাটা কত সময়ের মধ্যে করতে হবে তা নিয়ে কিছুটা ধোঁয়াশা রয়েছে, যে কারণে ব্যাংকের অর্থ আদায়ে কিছুটা ঝুঁকি সৃষ্টি হয়। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে ধোঁয়াশা যেন আরো গভীরতা পায়।

অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩ প্রণীত হওয়ার আগে ব্যাংকাররা মামলা দায়ের সম্পর্কিত সময়সীমা হিসাবের জন্য দ্য লিমিটেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮-এর বিধান অনুসরণ করতেন। আইনের বিধান মোতাবেক গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করার সময়সীমা-বিষয়ক অনেকগুলো অপশন ছিল যেমনলোন গ্রহণের পরবর্তী তিন বছরের মধ্যে, বিল-অব-এক্সচেঞ্জ অথবা প্রমিজরি নোটের তারিখ থেকে তিন বছরের মধ্যে, গ্রাহক শেষবার অর্থ পরিশোধের তিন বছরের মধ্যে, নতুন ডকুমেন্টে দায় স্বীকার করার তিন বছরের মধ্যে, যদি বন্ধকি দলিল থাকে তাহলে বন্ধক প্রদানের ১২ বছরের মধ্যে ইত্যাদি। অর্থঋণ আদালত আইন, ২০০৩-এর ৪৬ ধারায় বলা হয়েছে:

 () দ্য লিমিটেশন অ্যাক্ট, ১৯০৮- ভিন্নতর বিধান যাহাই থাকুক না কেন, কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান সম্পাদিত চুক্তি বা চুক্তির শর্ত অনুযায়ী ঋণগ্রহীতার নিকট হইতে ঋণ পরিশোধ সূচী (Repayment schedule ) অনুযায়ী  ঋণ পরিশোধ শুরু হইবার পরবর্তী

) প্রথম এক বৎসরে প্রাপ্য অর্থের অন্যূন ১০%, অথবা

) প্রথম দুই বৎসরে প্রাপ্য অর্থের অন্যূন ১৫%, অথবা

) প্রথম তিন বৎসরে প্রাপ্য অর্থের অন্যূন ২৫%, পরিমাণ অর্থ আদায় না হইলে উপধারা ()-এর বিধান সাপেক্ষে উহার পরবর্তী এক বৎসরের মধ্যে মামলা দায়ের করিবে।

() আর্থিক প্রতিষ্ঠান উপধারা ()- উল্লিখিত মেয়াদের মধ্যেই  ঋণ পরিশোধের তফসিল পুনঃতফসিল (Reschedule ) করিয়া থাকিলে উক্ত উপধারা ()-এর বিধান, তদনুযায়ী প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে (Mutatis Mutandis ),  নতুনভাবে কার্যকর হইবে।

() উপধারা ()- উল্লিখিত ঋণ পরিশোধ সূচি (Repayment schedule) অনুযায়ী  ঋণ পরিশোধের নির্ধারিত সাকল্য মেয়াদ (তিন) বৎসর অপেক্ষা কম হইবার ক্ষেত্রে উক্ত নির্ধারিত সাকল্য মেয়াদের মধ্যে আদায়ের পরিমাণ ২০% অপেক্ষা কম হইলে, আর্থিক প্রতিষ্ঠান উপধারা ()-এর বিধান সাপেক্ষে উহার পরবর্তী এক বৎসরের মধ্যে মামলা দায়ের করিবে।

() উল্লিখিত মেয়াদান্তে কোনো মামলা দায়ের করা হইলে আদালত অবিলম্বে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীকে লিখিতভাবে অবহিত করিবে এবং কোনো কর্মকর্তার দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার কারণে মেয়াদের মধ্যে উক্ত মামলা দায়ের না হইলে উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ অনুরূপ দায়ী কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করিবে এবং এই উপধারার অধীন অবহিত হইবার ৯০ (নব্বই) দিবসের মধ্যে গৃহীত ব্যবস্থা সম্পর্কে সরকার এবং আদালতকে অবহিত করিবে।

অর্থঋণ আদালত আইনের ৪৬ ধারা মোতাবেক ব্যাংকারদের জন্য অর্থ আদায়ের ক্ষেত্রে তামাদি আইন, ১৯০৮-এর সংশ্লিষ্ট বিধান প্রযোজ্য রইল না। তাহলে একটি প্রশ্ন সামনে এসে যায়ব্যাংকঋণ আদায়ের জন্য কি তাহলে মামলা দায়েরের কোনো লিমিটেশন পিরিয়ড থাকল না?

অর্থঋণ আদালত আইনের ৪৬ ধারা মোতাবেক বিভিন্ন শর্ত ভঙ্গ করলে পরবর্তী এক বছরের মধ্যে ব্যাংকার মামলা করতে বাধ্য। এই এক বছরকে অনেক বিজ্ঞ আইনজীবী তামাদির সময় বলে আখ্যায়িত করেন। আবার কেউ কেউ মনে করেন, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে মামলা না করলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীকে আদেশ দিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে, মামলা কি চলতে পারে, নাকি না পারে, ব্যাপারে আইন যেহেতু নিশ্চুপ, সেহেতু এটা বলা যায় না যে ধারা ৪৬ সম্পূর্ণভাবে আদেশব্যঞ্জক অর্থ প্রকাশ করে ( mandatory implication ),  বরং এটা একটা নির্দেশক বা নির্দেশনামূলক (directory one) সে কারণে মামলা তামাদি দ্বারা বারিত নয় (2009) [14BLC (HC)-11]

যদি কোনো ঋণের পরিশোধ সূচি ১০ বছর মেয়াদি হয় এবং প্রথম পাঁচ বছর যথাসময়ে কিস্তি পরিশোধ করা হলেও পরবর্তী এক বছর কোনো কিস্তি পরিশোধ করা না হয়, ব্যাংক কখন মামলা করতে বাধ্য হবে ব্যাপারে ধারা ৪৬ থেকে স্পষ্ট উত্তর পাওয়া যায় না।

চলমান ঋণ (ওডি, সিসি ইত্যাদি) সাধারণত এক বছরের জন্য দেয়া হয়। ৪৬ ধারা মোতাবেক এক বছরের মধ্যে যদি ওই ঋণের অন্যূন ২০ শতাংশ ঋণ আদায় না হয়, তাহলে ব্যাংক মামলা করতে বাধ্য। যদি ধরে নেয়া হয় যে একজন সিসি গ্রাহক তার এক বছর মেয়াদের মধ্যে ২৫ শতাংশ ঋণ পরিশোধ করে বাকি ৭৫ শতাংশ ঋণ পরিশোধ করলেন না, এক্ষেত্রে ব্যাংক কত সময়ের মধ্যে মামলা করতে বাধ্য তার স্পষ্ট উত্তর ধারা ৪৬ থেকে পাওয়া যায় না।

ইসলামী ব্যাংকগুলো সাধারণত এক বছরের জন্য চলমান বিনিয়োগ সুবিধা (যেমন বাই-মোয়াজ্জেল) দেয়। মঞ্জুরিপত্রে যদি বাই-মোয়াজ্জেল বিনিয়োগ লিমিটের মেয়াদ ৩১ ডিসেম্বর ২০২১ থাকে, ওই সময়ের মধ্যে পণ্য ক্রয়ের জন্য অনেকগুলো ডিলের মাধ্যমে গ্রাহক বিনিয়োগ সুবিধা ভোগ করেন এবং ক্যাশ ফ্লো মোতাবেক সুবিধামতো ডিলগুলো সমন্বয় করেন, ব্যবস্থায় কোনো গ্রাহক যদি ওই মঞ্জুরিপত্রের আত্ততায় ১৫ ডিসেম্বর ২০২১- এক বছর মেয়াদের এক ডিল নিয়ে সে ডিল যদি আর সমন্বয় না করেন তাহলে ৪৬ ধারার বিধান মোতাবেক ব্যাংক কত তারিখের মধ্যে মামলা করবে? লিমিটের মেয়াদ বিবেচনায় ৩১ ডিসেম্বর ২০২২-এর মধ্যে, নাকি ডিলের মেয়াদ বিবেচনায় ১৫ ডিসেম্বর ২০২৩-এর মধ্যে? এক্ষেত্রে বিজ্ঞ আইনজীবীরা নানাজনে নানা মত প্রকাশ করেন। কেউ কেউ বলেন, মঞ্জুরিপত্রের মেয়াদের এক বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। আবার কেউ কেউ বলেন, সর্বশেষ ডিলের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরবর্তী এক বছরের মধ্যে মামলা করতে হবে। ইসলামী ব্যাংকিংয়ের ক্ষেত্রে ধারা ৪৬-এর ধোঁয়াশা একটু বেশিই বলে প্রতীয়মান হয়।

বাংলাদেশে মার্চ ২০২০ থেকে কভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাব চলাকালে দেশের সর্বোচ্চ আদালত থেকে শুরু করে নিম্ন আদালত পর্যন্ত কয়েক মাস বন্ধ থাকে। ওই সময়ের মধ্যে মামলা করার বাধ্যবাধকতা বিষয়ে সুপ্রিম কোর্ট এক আদেশে লিমিটেশনের মেয়াদ বাড়ান। সে অনুযায়ী যেসব মামলা ২৬ মার্চ ২০২০ কিংবা এর পরবর্তী সময়ে রুজু না করলে লিমিটেশনের ঝুঁকিতে পড়বেসেসব মামলা দায়েরের মেয়াদ ৩১ আগস্ট ২০২০ পর্যন্ত বাড়ান। কোনো কোনো বিজ্ঞ আইনজীবী ওই প্রায় পাঁচ মাস সময় ধারা ৪৬- প্রদত্ত সময়ের সঙ্গে যোগ করে মামলা দায়েরের সময়সীমা হিসাব করা যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেন। লকডাউনের বিরূপ প্রভাব সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য হিসেবে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কভিড-১৯-এর নেতিবাচক প্রভাব বিবেচনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের বিআরপিডি সার্কুলার ১৭/২০২০-এর মাধ্যমে ঋণ শ্রেণীকরণের বিষয়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছিল যে জানুয়ারি ২০২০-এর ঋণের শ্রেণীমান যা ছিল, তা ৩১ ডিসেম্বর ২০২০ পর্যন্ত সময়ে ওই ঋণ তদপেক্ষা বিরূপ মানে শ্রেণীকরণ করা যাবে না। ২০২০ সালে অর্থঋণ আদালত আইনের ৪৬ ধারা অনুযায়ী ব্যাংকার মামলা করতে যদি বাধ্য হন, তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের ওই নির্দেশনার কারণে ২০২০ সালে ৪৬ ধারা প্রযোজ্য নয় বলে অনেক আইনজীবী মনে করেন। যদিও আইনের বিধান বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রজ্ঞাপনের কারণে পরিবর্তিত হতে পারে না, তথাপি একটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয় যে দেশের সবাই যদি কভিড-১৯-এর অভিঘাতের কারণে শ্রেণীকরণ কিংবা বিলম্ব পরিশোধের সুবিধা পায়, তাহলে ধারা ৪৬-এর বিধান ওই সময়ের জন্য রহিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। কারণ ৪৬-এর বিধানকে প্রাধান্য দেয়া হলে একটি ঋণ ২০২০ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনার কারণে খেলাপি না হয়েও মামলাযোগ্য হয়ে পড়বে। যেহেতু এটা সাধারণ ধারণা যে একটি ঋণ ওভার ডিউ হওয়ার পর শ্রেণীকৃত হবে, এরপর মামলাযোগ্য হবে। কিন্তু কভিড-১৯-এর কারণে শ্রেণীকরণ থেকে রেহাই পাওয়ার সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েও মামলার আওতায় চলে আসাটা অস্বাভাবিক নয় কি?

অর্থঋণ আদালত আইন-২০০৩-এর আগে ব্যাংকাররা খেলাপি গ্রাহকের বিরুদ্ধে মামলা করার জন্য সর্বোচ্চ ১২ বছর সময় পেতেন। কারণে মামলা কম হতো এবং অর্থও কম আদায় হতো। সমস্যা নিরসনের লক্ষ্যে বর্তমান আইনে মামলা দায়ের সম্পর্কিত বিশেষ বিধান সময়সীমা আরোপ করে একদিকে যেমন ব্যাংকারদের দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে অর্থ আদায়ের তাগিদ দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে মামলা না করার কারণে রাষ্ট্রের আর্থিক ক্ষতি থেকে সুরক্ষা দেয়া হয়েছে বলে মনে করা হয়। কিন্তু বাস্তবে বিপরীতটা ঘটেছে বলে প্রতীয়মান হয়। এক বছরের মধ্যে মামলা করতে ব্যাংকাররা বাধ্য বলে আদালতে মামলার স্তূপ বিশাল থেকে বিশালতর হয়েছে। অন্যদিকে মামলা করার পর অধিকাংশ গ্রাহক ব্যাংকারদের সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন এবং উভয়ের মধ্যে একটি বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি হওয়ায় মামলার শেষ পরিণতি না দেখে গ্রাহকরা দায় পরিশোধে এগিয়ে আসেন না। ফলে একদিকে খেলাপি ঋণ অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে, অন্যদিকে আদায় মামলার নিষ্পত্তিও হয়েছে অত্যন্ত হতাশাজনক পরিমাণ। কারণ একটি মামলা শেষ হতে পাঁচ-দশ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। ওই সময়ে ব্যাংকের মামলাধীন অর্থের Cost of fund হিসাব করলে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে খাজনার চেয়ে বাজনা বেশি হয় বলে মনে হয়। তাই মামলা দায়েরের জন্য এক বছর সময় মোটেও যুক্তিসংগত নয় বলে প্রতীয়মান হয়। আর মামলা দায়েরের সময়সীমার যে ধোঁয়াশা রয়েছে, তা নিরসন করা সময়ের দাবি।

 

. এসএম আবু জাকের: ব্যাংকার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন