জাতীয় বীমা দিবস

বীমার ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে

আধুনিক জীবনে ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার অপরিহার্য অনুষঙ্গ এখন বীমা। সমকালীন আর্থিক ব্যবস্থার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ খাত এটি। দুর্যোগপূর্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশে খাতের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু সম্ভাবনা অনুযায়ী দেশে বীমা শিল্পের প্রভাব আশানুরূপ নয়। বীমার ব্যাপ্তি বাড়ানো এবং এর প্রতি জনসাধারণের ইতিবাচক মনোভাব গড়তে বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এরই অংশ হিসেবে গত বছর থেকে মার্চকে জাতীয় বীমা দিবস ঘোষণা করেছে সরকার। আজ দেশে দ্বিতীয়বারের মতো পালিত হচ্ছে দিবসটি। দিবসটি এমন এক সময়ে পালিত হচ্ছে, যখন এরই মধ্যে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতির চূড়ান্ত সুপারিশ পেয়েছে বাংলাদেশ। দেশের অর্থনীতি যেভাবে বড় হচ্ছে, তার সমান্তরালে বীমার প্রয়োজনীয়তাও বাড়বে বৈকি। অবস্থায় বিদ্যমান প্রতিবন্ধকতা চ্যালেঞ্জ চিহ্নিতপূর্বক খাতের উন্নয়নে সময়োপযোগী কৌশল গ্রহণই প্রয়োজন।

বর্তমানে দেশে বীমা কোম্পানির সংখ্যা ৭৯। এর মধ্যে সাধারণ বীমা কোম্পানি ৪৬টি এবং জীবন বীমা কোম্পানি ৩৩টি। দুঃখজনকভাবে এতসংখ্যক কোম্পানি সত্ত্বেও অর্থনীতিতে খাতের অবদান এখনো অনুল্লেখযোগ্যই বলা চলে। তথ্যমতে, জিডিপিতে খাতের অবদান মাত্র দশমিক ৫৫ শতাংশ, অথচ ভারতে তা শতাংশের মতো। মূলত কিছু অন্তর্নিহিত সমস্যায় কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় বীমার প্রভাব হার (পেনিট্রেশন রেট) বাড়ছে না। এর মধ্যে একটি হলো গ্রাহকের দাবি নিষ্পত্তিতে দীর্ঘসূত্রতা অনীহা। অন্যূন তিন মাসের মধ্যে দাবি নিষ্পত্তির আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও কিছু কোম্পানি অর্থ পরিশোধে অযথা গড়িমসি করে। এমনকি মিথ্যা দাবি সাজিয়ে পূর্বতন তারিখে কাভার নোট ইস্যু এবং অন্য অন্যায্য প্রভাবের মাধ্যমে সুনির্দিষ্ট বীমা গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও আছে কিছু মালিকের বিরুদ্ধে। এতে বীমার প্রতি মানুষের এক ধরনের আস্থাহীনতা তৈরি হয়েছে। সংকট রয়েছে দক্ষ জনবলেরও। এতসংখ্যক কোম্পানি, অথচ সেগুলো পরিচালনার জন্য এমডি দূরে থাক, মধ্য থেকে মাঠ পর্যায় পর্যন্ত ভালো, পেশাদার দক্ষ লোকবল পাওয়া দুষ্কর। আবার এজেন্টরাও পলিসি গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে মানুষকে যথাযথভাবে বোঝাতে পারছেন না। ফলে মানুষ বীমার ব্যাপারে আগ্রহী হচ্ছে না। সমরূপভাবে উচ্চপরিচালন ব্যয়ও একটি সমস্যা। পরিচালন ব্যয়ের ক্ষেত্রে একটি নির্ধারিত সীমা থাকলেও কিছু বীমা কোম্পানি আয়ের তুলনায় বেশি ব্যয় করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। আছে সুশাসনের সংকট। সুনির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে পদ পূরণের আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও উল্লেখযোগ্যসংখ্যক বীমা কোম্পানিতে বর্তমানে সিইও নেই। অনেকটা অ্যাডহক ভিত্তিতে চলছে। তদুপরি রয়েছে পরিবারের নিয়ন্ত্রণ। কোনো কোনো কোম্পানিতে একক বা যৌথভাবে পরিবারের মূলধন বা শেয়ার ধারণ সুনির্দিষ্ট সীমা ছাড়িয়ে গেছে। ফলে প্রতিষ্ঠানগুলোয় পারিবারিক প্রভাব তৈরি হচ্ছে, যা করপোরেট মূল্যবোধ সুশাসনের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। পণ্যে বৈচিত্র্য ঘাটতিও খাতের একটি সমস্যা। এখনো বীমা কোম্পানিগুলো মান্ধাতা আমলের বীমা পলিসি বিক্রি করছে। নতুন প্রডাক্ট নেই বললেই চলে। অর্থনীতির আকার অনুপাতে দেশে বীমা কোম্পানির সংখ্যা অনেক বেশি, অথচ ভারতের মতো বড় অর্থনীতিতে বীমা কোম্পানির সংখ্যা মাত্র ৫২। এটিও প্রভাব হার না বাড়ার কারণ। মোটা দাগে এসবই হলো বর্তমানে বীমা খাতের প্রধান অন্তরায়। এগুলো দূর করতে হবে।

জীবনের সর্বক্ষেত্রে নাগরিকদের জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা সত্ত্বেও উন্নত রাষ্ট্রগুলো বীমাকে অপরিহার্য প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষাকবচ হিসেবে অঙ্গীভূত করেছে। আমাদেরও সেদিকে যেতে হবে। তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাজ্যের জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান ১১ দশমিক শতাংশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে দশমিক , জাপানে দশমিক , হংকংয়ে ১১ দশমিক , ব্রাজিলে দশমিক , চীনে , ভারতে দশমিক সিঙ্গাপুরের জিডিপিতে বীমা খাতের অবদান শতাংশ। অথচ বাংলাদেশে এখনো তা শতাংশেরও নিচে রয়ে গেছে। কী ধরনের নীতি গ্রহণ করে এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় কী ধরনের পরিবর্তন এনে উল্লিখিত দেশগুলো কীভাবে বীমা প্রভাব হার বাড়াতে পেরেছে, সেগুলো অনুসরণ করা যেতে পারে। গ্রাহকের দাবি নিষ্পত্তিজনিত সৃষ্ট আস্থাহীনতা, সুশাসন সংকট দূর করতে আইডিআরএর নজরদারি বাড়াতে হবে। কোম্পানিগুলোর উচ্চপরিচালন ব্যয়ে রাশ টানতে হবে। নতুন নতুন পণ্য ডিজাইনের জন্য পর্যাপ্ত অ্যাকচুয়ারিস্ট প্রয়োজন। দেশে থাকা মাত্র তিনজন ডিগ্রিধারী অ্যাকচুয়ারিস্টের মধ্যে একজনই প্র্যাকটিস করেন। তাদের সংখ্যা বাড়াতেও -সম্পর্কিত পঠন-পাঠনের সুযোগ বৃদ্ধি দরকার। এজেন্টদের জ্ঞান দক্ষতা বাড়াতে ব্যবস্থা করতে হবে প্রশিক্ষণের। বর্তমানে বীমা পেশাজীবীদের প্রশিক্ষণের জন্য বাংলাদেশ ইন্স্যুরেন্স একাডেমি আছে বটে, কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতায় প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। এর পাঠ্যক্রম যুগোপযোগী করে এটিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির মতো কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার পরামর্শ দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

বৈশ্বিকভাবে বীমা খাত বড় ধরনের ডিজিটাইজেশনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, গ্রাহক সেবা সর্বোচ্চকরণে অব্যাহতভাবে ডিজিটাল প্লাটফর্ম এবং স্ট্রিমলাইন প্রসেস সৃষ্টি করছে। কিন্তু অপর্যাপ্তভাবে উন্নয়ন করা ওয়েবসাইট এবং ব্যবহূত অকার্যকর প্রসেসসহ বাংলাদেশে বীমা খাতে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার এখনো কম। এক্ষেত্রে উন্নতি ঘটাতে হবে। বিশেষ করে স্বাস্থ্য কৃষি খাতে আমাদের ঝুঁকি বিপুল। চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেড়ে গেছে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে ব্যক্তির পকেট থেকে যাচ্ছে  মোট খরচের প্রায় ৬৫ শতাংশ। এটা দরিদ্র নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য বেশ ব্যয়সাধ্য। সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিতে স্বাস্থ্যবীমার একটি পাইলটিং করছে সরকার। এটিকে বেগবান করতে হবে, সবখানে ছড়িয়ে দিতে হবে। একইভাবে, বন্যা, খরাসহ নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষি খাতে বিপর্যয় লেগেই আছে। নিয়মিত বিরতিতে কৃষকরা ফসলহানির মুখোমুখি হচ্ছে। সেক্ষেত্রে সীমিত পরিসরে শস্যবীমা প্রবর্তনের  যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তা সর্বজনীন করতে হবে। কৃষকের ঝুঁকি আর্থিক কষ্ট লাঘবে আর কী কী নতুন বীমা পণ্যের উন্নয়ন করা যায়, তার উপায় সন্ধান করতে হবে। নতুন প্রযুক্তি প্রবর্তন, যুগোপযোগী নীতি সঠিক পরিচালন পদ্ধতি প্রভৃতির মাধ্যমে বীমা শিল্পের প্রভাব আরো বাড়বে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন