শ্রদ্ধাঞ্জলি

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের বিদায়ের মর্মব্যথা

ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন

আমাদের সমবয়সী, সহকর্মী অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে উচ্চকণ্ঠ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ চলে গেলেন। দেশের শহর, বন্দর, গ্রামে আনাচে-কানাচে বহু প্রগতিবাদী দেশপ্রেমিক অসংকোচ প্রকাশের দুরন্ত সাহস পথচলাকে আর তার লেখা বা বয়ানে শুনতে পাবেন না। সমাজসংস্কারের অন্যতম সাহসী যোদ্ধাকে হারিয়ে দৈন্য বেড়ে গেল।

৮০ বছরের খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের বর্ণিল কর্মজীবন ঘটনাবহুল এবং ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টিনন্দন ছিল। কম বয়সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার পরিবারের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন তিনি। আলাপচারিতায় শেখ হাসিনা শেখ রেহানার সঙ্গে নানা সময়ে বহু বিষয়ে মতবিনিময়ের কথা বলতেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ তাকে দেশপ্রেম মানবহিতৈষী হিসেবে দীক্ষিত করে। ইব্রাহিম খালেদ ১৯৬৪ সালে মনুষ্যসৃষ্ট দাঙ্গার কথা স্মরণে রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদর্শিত পথে চলেছেন। হয়েছেন স্বাধীনতার অতন্দ্র প্রহরী। জপমাল্য করেছেন বাঙালিত্বের জয়গান। প্রার্থনায় রেখেছেন সমৃদ্ধ সোনার বাংলা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলে স্নাতক আর আইবিএ থেকে এমবিএ পাস করা ইব্রাহিম খালেদ ষাটের দশকে পাকিস্তানের সবচেয়ে গোছালো, স্বচ্ছ এবং দক্ষ হাবিব ব্যাংকের মাধ্যমে দীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনে প্রবেশ করেন। তিনি কালক্রমে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে কাজ করে এই গুরুত্বপূর্ণ খাতটির নাড়ি-নক্ষত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন। মাঝখানে আশির দশকের শেষাশেষি সামরিক লেবাসে অসামরিক শাসনামলে উদীয়মান একটি প্রতিষ্ঠান পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনে মহাব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দারিদ্র্য এর নির্মূলে পল্লীবাংলার ঐতিহ্য সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার বিষয়ে মহামূল্যবান, অভিজ্ঞতা অভিজ্ঞান সঞ্চয় করেন।

১৯৯৬ সালে জনগণের গণতন্ত্র ফিরিয়ে এনে বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ সন্তান জনবন্ধু শেখ হাসিনা সরকার গঠন করেন। বাংলাদেশ ব্যাংক তখন খুবই শক্তিমান হয়ে ওঠে। আমার সঙ্গে তখন তিনজন বড় মাপের ব্যক্তিত্ব জ্ঞানী সোহরাব উদ্দিন, ইব্রাহিম খালেদ রুহুল আমিন ডেপুটি গভর্নর। ফারুকউদ্দিন আহমদ, আল্লাহ মালেক কাজেমী, জিয়াউল হাসান সিদ্দিকী, নজরুল হুদা, মুর্শিদ কুলী খান, আব্দুল মজিদ মোহাম্মদ আলীএই সাতজন দক্ষ নির্বাহী পরিচালক। আর বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) মহাপরিচালক প্রফেসর মইনুল ইসলাম। অর্থাৎ একটি অসাধারণ টিম মিলে ব্যাংকিং সেবা সততা, স্বচ্ছতা দক্ষতার সঙ্গে নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। জোরজবরদস্তি-জেলজুলুমের পরিবর্তে যুক্তিতর্ক দেশের স্বার্থ সম্পর্কে আইনি শক্তিতে বলীয়ান হয়ে বিশেষ করে খেলাপি ঋণের কবল থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে মুক্ত করার কৃতসংকল্প পথচলা সমাজে সপ্রশংস দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ইব্রাহিম খালেদ সাহেব তফসিলি ব্যাংকের আদি-অন্ত জানা একজন বড় মাপের ব্যক্তিত্ব হিসেবে দেশের দশ শীর্ষ ঋণখেলাপির গোপন তালিকা প্রস্তুতে বিশেষভাবে সহায়তা করেন। খেলাপিদের কেউ কেউ প্রথম দিকে খুব উচ্চকণ্ঠ থাকলেও আপিল বিভাগে হেরে গিয়ে চুপসে যান। অবশ্য সরকারি হারের পারিশ্রমিকে কোনো ভালো আইনজ্ঞ পাওয়া যায়নি বলে ব্যক্তিগতভাবে আমি বন্ধুত্ব পরিচিতির সুযোগে শীর্ষস্থানীয় আইনজীবীদের সহায়তা-ধন্য হয়ে শান্তিপূর্ণভাবে আইনের মাধ্যমে জেলজুলুমে না গিয়ে ঋণখেলাপের দুষ্ট ব্যাধি থেকে অর্থনীতি সমাজজীবনকে মুক্ত করতে সক্ষম হই। তবে পরবর্তী সময়ে ঋণখেলাপিদের বিভিন্ন ছলচাতুরি কর্তৃপক্ষের ক্ষমার কারণে তাদের উদ্ধত ফণা সেই যে বিস্তৃত করে, আজ তা আরো শক্তিমান।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর . আতিউর রহমানের সঙ্গে অনেক ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছেন। উন্নয়ন অন্বেষায় তিনি সম্ভবত মুখ্য নির্বাহী ছিলেন। তাকে এবং সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসএ চৌধুরীকে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমিতে (বিবিটিএ) প্রসেফর হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।

২০০০ সালে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ ডেপুটি গভর্নর পদ থেকে অবসর নেন। বেসরকারি খাতের পূবালী ব্যাংক তখন মহাফাঁপরেপ্রবলেম ব্যাংক। ব্যাংকের মালিকদের সুপারিশে আমি ইব্রাহিম খালেদ সাহেবকে ওই ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে যোগ দিতে রাজি করাই। তিনি শর্ত দেন যে তাকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে যেন হস্তক্ষেপ না করা হয়। তিনি পূবালী ব্যাংককে একটি গতিময় দক্ষ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেন এবং লাভজনক করেন।

সাম্প্রতিককালে অত্যন্ত দক্ষ প্রশিক্ষক খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ প্রশিক্ষায়ণের কর্মকাণ্ড এবং প্রশিক্ষণ প্রকাশনার কাজে . সাদত হুসাইনকে বিপুলভাবে সাহায্য করেছিলেন। তবে আমার বিবেচনায় দেশের আগামী দিনের স্বপ্নদিশারী কিশোর-কিশোরীদের চরিত্র ব্যক্তিত্ব গঠনের প্রতিষ্ঠান কচিকাঁচার মেলার সংগঠন, ক্ষমতায়ন, পরিচালনা সম্প্রসারণে খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ অসাধারণ অবদান রেখে গেছেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সুফিয়া কামালের আশীর্বাদপুষ্ট এবং শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন, আব্দুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দিন, হাসি সিদ্দিকী রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই-নূরজাহান আপার কল্যাণপরশে পঞ্চাশের দশকে ইত্তেফাকের পাতায় সূচিত কচিকাঁচার আসর কালক্রমে একটি প্রচণ্ড শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে সমাজ থেকে কলুষ তমসা দূরে ব্রতী রয়েছে। শুরুতে শামসুজ্জামান খান, মাহবুব তালুকদার, আমি, শামসুল হুদা ইব্রাহিম খালেদ রোকনুজ্জামান দাদাভাইকে সঙ্গে থেকে শক্তি-সাহস জোগালেও কালক্রমে ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে এই ব্যতিক্রমধর্মী প্রতিষ্ঠানটি টিকে থেকে বেড়ে ওঠে এবং আশ্চর্যের কথা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়নি। ১৯৭৪ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সরকারপ্রধান হিসেবে কচিকাঁচার মেলায় ছোট্ট সোনামণিদের আশীর্বাদ দেন এবং অনেকক্ষণ ধরে তার প্রিয় কচিকাঁচাদের সঙ্গে সময় কাটান। ইব্রাহিম খালেদের অনেক কীর্তিগাথা মহৎ কর্মের মধ্যে আমি অন্তত কচিকাঁচার মেলায় তিনি যে বিশাল অবদান রেখেছেন, তার জন্য সবচেয়ে বেশি সাধুবাদ শ্রদ্ধা জানাই।

স্পষ্টভাষী, অসম সাহসী, সুন্দরের পূজারি খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ দুই বছর ধরেই শারীরিক দুর্বলতার কথা বলতেন। মনে হয়েছে হয়তোবা নিজের প্রতি যত্ন নিতে তিনি তেমন সতর্কও ছিলেন না। বন্ধু, সহকর্মী এবং কণ্টকাকীর্ণ পথের সহযাত্রী ইব্রাহিম খালেদের মহাপ্রয়াণে একটি শূন্যতার সৃষ্টি করে দিল, যা সহজে পূরণ হবে না। তার পুণ্য স্মৃতির প্রতি আমি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।

 

. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন: অর্থনীতিবিদ; সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক

ইষ্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন