সাম্প্রতিক

ভারতের কৃষি আইনকে যুক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে

কৌশিক বসু

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ভারতে তিনটি নতুন কৃষি আইন বলবৎ হয়েছে। তেমন জন-আলোচনা বা সংসদীয় সংলাপ ছাড়া প্রণীত এসব আইন বৈশ্বিকভাবে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। মোদি সরকার উপরোক্ত আইনকে কৃষকদের জন্য উপহার হিসেবে বর্ণনা করেছে। কিন্তু পাঞ্জাব হরিয়ানার ক্ষুদ্র কৃষকদের নেতৃত্বে কয়েকটি রাজ্যের কৃষকরা সেগুলো প্রত্যাখ্যান করেছেন। ফলে দেশটিতে ইস্যুকে কেন্দ্র করে প্রলম্বিত বহুধা বিভাজিত ক্ষোভ-বিক্ষোভ চলছে।

বর্তমানে চলা অপ্রীতিকর অবস্থা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক, কিন্তু তা একদম নতুনও নয়। কৃষি এমন এক জটিল ইস্যু যা শুধু ভারত নয়, বাজার রাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠায় হিমশিম খাওয়া সব দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হাজির করে।

আমি অনেক আগেই অনুভব করেছিলাম যে ভারতের বিদ্যমান কৃষি আইন পরিবর্তন জরুরি। একই সঙ্গে দেশটির খাদ্যশস্য বাজার আরো উন্মুক্ত হওয়া প্রয়োজন। অন্য সুযোগগুলোর মধ্যে নতুন আইন মান্দি নামে পরিচিত রাজ্য নির্ধারিত জায়াগার বাইরে কৃষকদের শস্য বিক্রি করার সুযোগ দেয়, আগে যা অনুমোদিত ছিল না। আপাতভাবে মনে হচ্ছে, সরকার কৃষকদের অধিক সুযোগ দিচ্ছে। তাহলে কেন এর বিরোধিতা?

প্রশ্নের উত্তর জানতে আমি আইনটির সবিস্তার পড়েছি। পড়ে বুঝেছি, আমিসহ অনেক অর্থনীতিবিদ যা উপলব্ধি করতে পারেননি, তৃণমূলের অনন্যসাধারণ স্বজ্ঞায় তা কৃষকরা উপলব্ধি করেছেন।

সরকার কৃষকদের মান্দির বাইরে নিজেদের পণ্য বিক্রির অনুমতি দিলে নিশ্চিতভাবে তাতে তারাই লাভবান হবেনযদিও মান্দির বাইরের বাজার বেশ অনিয়ন্ত্রিত। আর অন্য সব অবস্থা অপরিবর্তনীয় থাকার পাশাপাশি তারা আরেকটি নতুন সুযোগ থেকেও উপকৃত হবে। কিন্তু অন্য সব অবস্থা অপরিবর্তনীয় থাকবে এই বিশ্বাসের জন্য সরকারের প্রতি কৃষকের আস্থা প্রয়োজন। স্পষ্টভাবে মনে হচ্ছে, বর্তমানে সরকারের প্রতি তাদের কোনো আস্থা নেই এবং তা খুব যুক্তিসংগত কারণেই।

কিছু তথ্য পর্যালোচনা করা যাক, বিশ্বজুড়ে কৃষকরা সরকারি ভর্তুকি পায়। ২০১৯ সালে চীন কৃষি ভর্তুকিতে ১৮৫ দশমিক বিলিয়ন ডলার, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১০১ দশমিক বিলিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ৪৮ দশমিক ভারত ১১ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে। কিন্তু সব দেশ এক রকমভাবে ভর্তুকি দেয় না; বিভিন্ন দেশ বিভিন্নভাবে দেয়। তথ্য থেকে দেখা যাচ্ছে, তুলনামূলক বিচারে রাষ্ট্রীয় ভর্তুকিতে ভারতীয় কৃষকরা অনেকটা তলানিতে।

বর্তমানে ভারতীয় কৃষকদের একটি গ্যারান্টিড মিনিয়াম সাপোর্ট প্রাইসে (এমএসপি) সরকারের কাছে নিজেদের পণ্য, প্রধানত ধান গম বিক্রির অধিকার আছে, পর্যায়ক্রমিকভাবে যা প্রতি বছরই নির্ধারিত হয়। এমএসপি ব্যবস্থা মূলত পারস্পরিক আস্থার ভিত্তিতে পরিচালিত হয়। খুব কম দাম নির্ধারণের মাধ্যমে নীতিনির্ধারকরা এটি কার্যকরভাবে ভেঙে দিতে পারেন, যাতে কোনো কৃষকই পণ্য বেচতে আগ্রহী না হন কিংবা প্রবেশগম্য পণ্য সংগ্রহ কেন্দ্রগুলো ব্যবস্থা না করার মাধ্যমেও এমএসপি অকার্যকর করে দিতে পারেন তারা। একটি উদাহরণ দেয়া যাক। ভারতের অনেক অংশে আজকাল কৃষকদের একটি সুনির্দিষ্ট দামে শস্য বিক্রি করতে বলা হয় বটে, কিন্তু তাদের কাছাকাছি জায়গায় পণ্য বেচার কোথাও সুযোগ নেই।

সংস্কার না করে যদি সরকার এমএসপি ব্যবস্থা ভেঙে দেয়, তাহলে কয়েক মিলিয়ন কৃষক চার-পাঁচটি বড় এগ্রিবিজনেস করপোরেশনের কাছে নিজেদের পণ্য বিক্রি করতে বাধ্য হবেন, জিম্মি হয়ে পড়বেন এবং এটিই খুব সূক্ষ্মভাবে নতুন আইনের চূড়ান্ত কপি প্রকাশ করে বৈকি।

যদি কোনো করপোরেশন কৃষকের সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে, নতুন আইন তা প্রতিকারে আদালতের দ্বারস্থ হওয়া নিষেধ করে। খাদ্যশস্য মজুদের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মাধ্যমে আলোচ্য আইন বড় ব্যবসায়ীকে আরো বেশি সাহায্য করে, মূলত কৃত্রিমভাবে মূল্যবৃদ্ধি নিরুৎসাহিত করা ঠেকানোর জন্যই যা (পড়ুন মজুদদারি) নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।

আমি মনে করি, কৃষিবাজারে বড় করপোরেশনগুলোর উপস্থিতি অবশ্যই প্রয়োজন। একই সঙ্গে এও মনে করি যে নতুন আইন আরো গ্রহণযোগ্য হতো, যদি কয়েক মিলিয়ন কৃষকের জন্য সমতল ক্ষেত্র তৈরিতে একচেটিয়াবিরোধী অবস্থানের প্রতি নীতিনির্ধারকরা আরো সংবেদনশীলতা দেখাতেন, যারা (পড়ুন কৃষক) এখন কয়েকটি বড় কোম্পানি দ্বারা পিষ্ট হবেন। এমনকি কথিত মুক্তবাজারের ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্রেও এরিক পসনার, সুরেশ নাইডু, গ্লেন উইয়েল চাস সুনেস্টেইনের মতো খ্যাতিমান আইনজ্ঞরা বড় করপোরেট ক্রেতাদের মতো একাধিপত্য (মনোপসনি) নিয়ন্ত্রণে প্রতিযোগিতা আইনের প্রয়োজন বিষয়ে তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

ভারতের কৃষি আইনসংক্রান্ত চলমান বিতর্কও এভাবে একটি সম্পর্কিত প্রশ্ন আমাদের সামনে হাজির করে। আর তা হলো, অধিক সুযোগ জোগানো সবসময়ই কাঙ্ক্ষিত কিনা?

স্পষ্টত কিছু ক্ষেত্রে অবশ্যই নয়। যুক্তরাষ্ট্রের লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্য ১৮৫৯ সালে একটি কৃষ্ণাঙ্গদের স্বাধীনতা দিয়ে একটি আইন কার্যকর করেছিল, যাতে তারা স্বেচ্ছায় দাসত্ব বেছে নিতে পারে। চর্চাকে প্রায়ই ওয়ারেন্টিইজম বলে বর্ণনা করা হতো। আজকে চীনের মতো দেশগুলো মৌলিক শ্রম অধিকারের বিনিময়ে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলগুলোয় শ্রমিকদের কাজ করার সুযোগ দেয়। এসব শর্তে কাউকে জোর করে কাজ করানো হচ্ছে না। বিশেষ যুক্তি দেয়া হচ্ছে যে এটি তাদের জন্য বাড়তি সুযোগ মাত্র।

অধিকাংশ লোক এসব বাড়তি সুযোগ গ্রহণে আপত্তি জানাবে। অন্যদিকে ব্যক্তিস্বাধীনতার ওপর সরকারি দমন নীতিও মেনে নেবে না। ধরনের দমন প্রক্রিয়া শুরু থেকেই কঠিন আপত্তির মুখে। সৌভাগ্যক্রমে আমার বই বিয়ন্ড দি ইনভিজিবল হ্যান্ড- আমি যেমনটা দেখিয়েছি, দার্শনিক ডেরেক পারফিটের গবেষণাকর্মে নিহিত জটিল যুক্তিতে আমরা এসব বাস্তব বিশ্বের প্রেক্ষাপট কীভাবে প্রয়োগ করতে পারি।

এটি আমাদের সোরাইটস প্যারাডক্সে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। এক্ষেত্রে কমন সূত্র হলো, এন নামক বালুকণার সমাহার যদি কোনো স্তূপ তৈরি না করে, তাহলে এন+ বালুকণার সমাহারও কোনো স্তূপ তৈরি করতে পারবে না। বিষয় থেকে মূল যে কূটাভাসটি বেরিয়ে আসে তা হলো, আমরা যদি যেকোনো এক বালুকণার সমাহার যুগপত্ভাবে মেশাতে থাকি, তাহলে আমরা শেষ পর্যন্ত স্তূপ তৈরি করতে পারব।

একইভাবে রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে চাকরির বিনিময়ে মৌলিক অধিকার ছেড়ে দেয়ার প্রতিটি ব্যক্তিক সিদ্ধান্তে ব্যক্তি কল্যাণের উন্নয়ন ঘটতে পারে বটে, কিন্তু অনেক কর্মী যদি একযোগে এটি করেন তাহলে সব কর্মীর অবস্থা খারাপ হতে পারে।

সংক্ষেপে বলা চলে, আমাদের যা প্রয়োজন তা বাজার মৌলবাদ নয়, বরং সুগ্রন্থিত আইন দ্বারা নির্ণীত বৃহত্তর প্যারাডাইমের মধ্যে মুক্তভাবে কাজ করতে পারে এমন এক বাজার। ভারত সরকারের নতুন কৃষি আইন অবশ্যই সংশোধন করা উচিত। সযত্নশীল সদিচ্ছামূলক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে অংশগ্রহণমূলকভাবে আইনের মুসাবিদা করা উচিত, যাতে তা যুক্তির পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারে এবং দরিদ্র কৃষক বেশির ভাগ ভোক্তার সুফল নিশ্চিত করতে পারে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ, ভারত সরকারের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন