পাঁচ থানায় কেন্দ্রীভূত ব্যাংকঋণ

কাঠামোগত দুর্বলতার দায় বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে না

নির্দিষ্ট কিছু এলাকায় এবং নির্দিষ্ট কিছু মানুষের মাঝে ঋণ বিতরণ করছে ব্যাংকগুলো। এতে কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে ব্যাংকঋণ। আর ঋণ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন দেশের বিভিন্ন এলাকার কৃষি এসএমই উদ্যোক্তারা। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার মতিঝিল-গুলশান-ধানমন্ডি আর চট্টগ্রামের কোতোয়ালি-ডবলমুরিং থানাকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খাচ্ছে দেশের ব্যাংক খাত। পাঁচটি থানাভুক্ত এলাকায় অবস্থিত ব্যাংকের শাখাগুলোর মাধ্যমে বিতরণ করা হয়েছে প্রায় লাখ কোটি টাকার ঋণ, যা দেশের মোট ব্যাংকঋণের ৬০ শতাংশেরও বেশি। ধনীদের বসবাস ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত এসব এলাকায় বিতরণকৃত ঋণ গেছে মূলত বৃহৎ করপোরেট ট্রেড ফাইন্যান্সে। এতে ব্যাংকের ঝুঁকি বাড়ছে। বড় গ্রাহকদের কাছে ঋণ কেন্দ্রীভূত হয়ে যাওয়ার বিষয়ে গত বছর জুনে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রকাশিত স্ট্রেস টেস্টিং প্রতিবেদনে বলা হয়, ব্যাংকগুলোর শীর্ষ তিনজন গ্রাহক খেলাপি হলে ২৩টি ব্যাংক মূলধন সক্ষমতা হারাবে। আর শীর্ষ সাত গ্রাহক খেলাপি হলে প্রয়োজনীয় মূলধন সক্ষমতা হারাবে ৩৫টি ব্যাংক। শীর্ষ ১০ গ্রাহক খেলাপি হলে ৩৮টি ব্যাংক মূলধন সক্ষমতা হারাবে। ব্যাংকঋণ কেন্দ্রীভূত হওয়ার পেছনে মূল কারণ কাঠামোগত দুর্বলতা। 

বাংলাদেশে ব্যক্তি খাতের বিকাশ ব্যাংক খাতের হাত ধরেই। এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা পালন করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো। বেসরকারি ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের অর্থকরী মূলধন জুগিয়ে প্রতিষ্ঠান বড় করতে সহায়তা জুগিয়েছে। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তা সৃষ্টির চেয়ে করপোরেটদের ব্যবসা সম্প্রসারণ বা উৎপাদন চালিয়ে নিতে অর্থায়নে বেশি আগ্রহী বলে তথ্য-উপাত্ত বলছে। ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প বিকাশে সহায়ক অর্থায়নে তাদের আগ্রহ খুবই কম। এজন্য অবশ্য ঋণের ব্যবস্থাপনা দুর্বলতা ব্যয়ের কথা বলছেন ব্যাংক-সংশ্লিষ্টরা। এমনকি নতুন একাধিক ব্যাংক বাজারে এলেও নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে তাদের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না। অথচ পাশের দেশ ভারত ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পে সহায়তা বা উদ্যোক্তা সৃষ্টির লক্ষ্যে একাধিক ব্যাংক তৈরি এবং তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু বাংলাদেশে ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পে ঋণ দেয়ার জন্য স্বতন্ত্র বিশেষ কোনো বেসরকারি ব্যাংকই নেই। ভারতে এসএমই খাতের জন্য বিশেষায়িত বেসরকারি ব্যাংক রয়েছে একাধিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকার পরও বেসরকারি ব্যাংকগুলো এসএমই কৃষিঋণ দিতে ততটা উৎসাহী নয়। কেন উৎসাহী নয়, তা খতিয়ে দেখা দরকার। উন্নত দেশগুলোয় পুঁজি সংগ্রহের জন্য শেয়ারবাজার থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যম রয়েছে। বাংলাদেশের শেয়ারবাজার এখনো সে আস্থা অর্জনে সমর্থ হয়নি। তাই পুঁজির আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যাংকই শেষ ভরসা। বাংলাদেশেও সরকারি বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে ক্ষুদ্র উদ্যোগকে অর্থায়ন করে। তবে ব্যাংক এগিয়ে আসছে না।

ব্যাংক খাতের ঝুঁকি কমাতে একই খাতে যেন ঋণ কেন্দ্রীভূত না হয়, সেদিকে নজর দিতে হবে। এখানকার ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ উচ্চমাত্রায় রয়েছে। এটি কমিয়ে আনতে হবে। সব ধরনের নীতিমালা অনুসরণ করে দক্ষ ব্যক্তিদের দ্বারা ব্যাংক পরিচালনা করা জরুরি। অভ্যন্তরীণ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ওপর জোর দেয়া আবশ্যক। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের ভালো উদ্যোক্তার মাঝে ঋণের সুফল পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংকেরই উদ্যোগ নিতে হবে। তবে ব্যাংকঋণের সুফল প্রত্যন্ত এলাকায় পৌঁছানোর উদ্দেশ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখা খোলার বিষয়ে শর্তারোপ করেছে। ব্যাংকগুলো নিজেদের ইচ্ছামতো শাখা খুলত। একসময় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের শর্ত অনুযায়ী এখন শহরে একটি শাখার বিপরীতে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রামে একটি শাখা খুলতে হয়। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম মেনে শাখা খুললেও ব্যাংকগুলো লাভজনক এলাকার বাইরে যাচ্ছে না। অনেক ব্যাংক রাজধানীর আশপাশের ইউনিয়নগুলোয় শাখা খুলে অনুপাত ঠিক রাখছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ওই নির্দেশনার পরও ঋণ বিকেন্দ্রীকরণ সম্ভব হচ্ছে না। আইনের এমন দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন। ব্যাংকগুলো আইন পরিপালনে উদাসীনতা প্রদর্শন করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাদের দেখভাল তদারকির দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। ঋণ বিতরণে যেন বৈষম্য না হয়, কৃষি এসএমই খাতে ঋণের প্রবাহ নিশ্চিত করা প্রভৃতির জন্য আইনি বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এসব বাস্তবায়নের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। কিন্তু নিয়ন্ত্রক সংস্থা এক্ষেত্রে উদাসীনতার পরিচয় দিচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। নির্দেশনার ব্যত্যয় কোনোভাবে কাম্য নয়। ব্যাংকিং খাতে কাঠামোগত দুর্বলতার ফলে সৃষ্ট ঝুঁকির দায় বাংলাদেশ ব্যাংক এড়াতে পারে না।

ব্যাংকাররা যান উন্নত অঞ্চলে। একটা অঞ্চল নানাভাবে উন্নত হয়ে পড়েছে। ব্যাংক সেখানেই যায়। ব্যাংক ফলোজ ডেভেলপমেন্ট। আবার প্রতিবেশী দেশসহ অনেক দেশেই ব্যাংক একটা অঞ্চলে গিয়ে সেই অঞ্চলকে উন্নত করছে এবং করেছে। উন্নয়নশীল দেশে এটাই আদর্শ ব্যাংকিং। কিন্তু বাংলাদেশ চলে উল্টো পথে। যে অঞ্চল এরই মধ্যে উন্নত, সেই অঞ্চলেই ব্যাংকগুলো শাখা খোলে। হতাশার বিষয় হলো, গ্রামে শাখার বিস্তার ঘটলেও ব্যাংকগুলো গ্রামীণ পর্যায়ে অর্থায়ন বাড়াচ্ছে না। দেশের অর্থনীতিতে গতি আনতে হলে ব্যাংক ব্যবসায় শহর-গ্রামের বৈষম্য কমিয়ে আনতে হবে। পাশাপাশি যেসব অঞ্চলের মানুষ অবহেলিত, সেসব অঞ্চলের মানুষের মধ্যে ঋণ বিতরণসহ ব্যাংকিং সেবা বাড়াতে হবে। শুধু ঢাকা চট্টগ্রাম শহরকেন্দ্রিক নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাংকিং সেবা সীমাবদ্ধ না রেখে দেশজুড়ে ব্যাংকিং কার্যক্রম সুষমভাবে বিস্তৃত করতে হবে। তাতে গোটা অর্থনীতিতে ভারসাম্য ফিরে আসবে।

পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ব্যাংকগুলোকে তাদের ঋণ বিকেন্দ্রীকরণের বিকল্প নেই। আমাদের ব্যাংকগুলোর রীতি এমন হয়েছে যে আগে একটি ব্যাংক একজনকে ঋণ দিত। এখন সব ব্যাংক ওই একজনকেই ঋণ দেয়। আর নতুন কোনো উদ্যোক্তা ঋণ নিতে গেলে নানাভাবে হয়রানির শিকার হন। ফলে একদিকে যেমন নতুন উদ্যোক্তা তৈরি হচ্ছে না, তেমনি অন্যদিকে নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে বেশি ঋণ থাকায় ব্যাংক খাত ঝুঁঁকির মধ্যে পড়ছে। অল্প কিছু এলাকায় ব্যাংকের ঋণ সীমাবদ্ধ রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতি সম্ভব নয়। উদ্যোক্তা তৈরিতে ব্যাংকগুলো সবসময় বড় ভূমিকা রাখে। যদিও এতে ঝুঁকিও বেশি থাকে। তবে এখন দেখা যাচ্ছে বড় করপোরেটদের ঋণ দিয়েই ঝুঁকিতে রয়েছে ব্যাংকগুলো। এসএমই ঋণে ঝুঁকি কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংক আলাদা তহবিল গঠন করে দিলেও তেমন সুফল মিলছে না। নানা অলিখিত প্রতিবন্ধকতা রয়েছে ঋণ পাওয়ায়। ব্যাংকগুলোও অসহযোগিতা করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি আরো জোরদার করতে হবে। অল্প কিছু এলাকায় ব্যাংকের ঋণ সীমাবদ্ধ রেখে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সম্ভব নয়। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের ভালো উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণের সুফল পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককেই উদ্যোগ নিতে হবে। ঝুঁকি কমাতে নতুন উদ্ভাবনী পণ্যের মাধ্যমে ঋণ বহুমুখীকরণ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন