রেলপথ : অন্তহীন অনিয়মের জনহীন অন্ধকূপ

ড. মো. আদনান আরিফ সালিম

রসিকতা করে জনৈক ব্যক্তি তার বন্ধুদের একদিন প্রশ্ন করলেন, ‘আচ্ছা বল তো দেখি সাধারণ টয়লেট আর বায়ো-টয়লেটের পার্থক্য কী? বন্ধুরা একটু ভড়কে যেতেই তিনি বলতে শুরু করলেন, ‘আরে বুঝিস না সাধারণ টয়লেটে মানুষ স্বাভাবিকভাবে মলমূত্র ত্যাগ করলে সেটা পুরো দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে। তারপর প্রাকৃতিক নিয়মে অদৃশ্য হয়ে যায়। বায়ো-টয়লেটের ক্ষেত্রেও গল্পটা প্রায় একই, যেখানে মলমূত্র ছিটকে পড়ে প্রত্যেকের পোশাক আর শরীরে।’ নির্মম এ রসিকতা মূলত বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন বগিতে সংযুক্ত টয়লেটগুলো নিয়ে। 

প্রখ্যাত এক নগর-পরিকল্পনাবিদ বলেছিলেন, সমাজের মানুষ কতটুকু সভ্য কিংবা অভিজাত সেটা বোঝার জন্য তাদের পয়ঃপ্রণালিতে দৃষ্টি দেয়া জরুরি। আর তাই বাংলাদেশ রেলওয়েতে বিদ্যমান বর্ণনাতীত সমস্যার শুরুটা এর টয়লেট থেকেই শুরু করা যেতে পারে। তারপর একে একে বাংলাদেশের এই সেবা খাতের সব ক্ষেত্রে বিদ্যমান ঘাটতি নিয়ে কথা বলাই যায়। 

আজ থেকে বছর সাতেক আগে বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম দেখে দেশবাসী চমকে উঠেছিল। সেখানে বাংলাদেশ রেলওয়ের নানা স্থানে প্রায় ১৬ হাজার শূন্যপদের কথা জানানো হয়েছে। এরপর পদ্মা-মেঘনায় অনেক ঢল এসেছে। প্রতিটি ফাগুনে আগুনঝরা শিমুল-পলাশ-কৃষ্ণচূড়া ধরে শুকিয়ে ঝরে গেছে, কিন্তু বারবার বাদ্য বাজিয়েও ভাগ্য বদল করা যায়নি বাংলাদেশ রেলওয়ের। নানা সমস্যার পাশাপাশি তাই জনবল সংকটের কারণেও অনেকটা যাত্রীদের প্রয়োজন অনুযায়ী সেবা দিতে পারছে না বাংলাদেশ রেলওয়ে।

বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গিয়েছিল, বাংলাদেশ রেলওয়ের অর্গানোগ্রামে জনবল থাকার কথা  ৪০ হাজার ১১২ জন। বিভিন্ন দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদ থেকে জানা গিয়েছে, এর মধ্যে পদ শূন্য রয়েছে ১৬ হাজার ২৩০টি। এ জনবল সংকটের কারণে গত কয়েক বছরে নানা উন্নয়ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হলেও তার বাস্তবায়ন থমকে গিয়েছে বারবার। 

ভয়াবহ এই জনবল সংকট নিরসনে উপযুক্ত উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হলেও দিনের পর দিন কেবল এই বিদ্যমান লোকবল সংকটই তীব্র থেকে তীব্রতর হয়েছে। জঘন্য এই জনবল সংকট যাত্রীদের ভোগান্তির পাশাপাশি কর্মরত বাংলাদেশ রেলওয়ের কর্মীদের তিক্ত অভিজ্ঞতার প্রহর আরো দীর্ঘ করেছে। বিশেষ করে দেশের নানা স্থানে চলমান ডাবল লেনের কার্যক্রম এগিয়ে নিতে গিয়ে এই ভয়াবহ কর্মী সংকট আরো স্পষ্ট করে দেখা গিয়েছে। সেই ২০১৪ সালের দিকে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকা প্রায় ১৪৭টি স্টেশন নতুন করে চালুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছিল। এর বাইরে আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছিল চারটি স্টেশন। কিন্তু উপযুক্ত জনবল না থাকায় সেখানে বিশ্রী রকম ভোগান্তি দৃশ্যমান।

বাংলাদেশের নানা স্থানে তখন থেকে প্রায় ১৫টি স্টেশন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছিল। ফলে নতুন ও পুরনো স্টেশনগুলোতে কার্যক্রম ধারাবাহিক রাখতে গেলে পর্যাপ্ত কর্মী নিয়োগের বিকল্প ছিল না। তার পরও সদ্যনির্মিত ও  নতুনভাবে সচল হওয়া অনেক স্টেশন পরিচালনা করা সম্ভব হয়নি শুধু স্টেশন মাস্টার, সহকারী স্টেশন মাস্টার, গার্ড ও টেকনিশিয়ান সংকটের কারণে। এক্ষেত্রে যথাযথ কর্তৃপক্ষ বারবার সুপারিশ করার পরও তা আমলে নিয়ে উপযুক্ত লোক নিয়োগ দেয়া হয়নি।

বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে পাওয়া তথ্যগুলো একটু যাচাই করে দেখা যেতে পারে। সেখানে তারা যে তথ্য দিয়েছে তাতে জনবল সংকটের তীব্রতা আঁচ করা যায়। ৫৪৮ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা থাকার কথা থাকলেও সেখানে বর্তমানে কর্মরত ৪১৮ জন। সুতরাং সেখানে ১৩০ জন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার পদ এখনো শূন্য। 

একইভাবে ১ হাজার ৩৫৬ জন দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা থাকার কথা হলেও সেখানে কর্মরত ৭৫২ জন। হিসাব করতে গেলে দেখা যায়, সেখানে প্রায় ৬০৪ জন দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার পদ এখনো শূন্য রয়ে গিয়েছে। একইভাবে ২১ হাজার ৮৭৬ জন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার পদ থাকলেও সেখানে কর্মরত মাত্র ১৩ হাজার ৬২২ জন। অর্থাত্ গাণিতিক হিসাবে ৮ হাজার ২৫৪ জন তৃতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তার পদ এখনো শূন্য রয়েছে।

১৬ হাজার ৪৮৪ জন শূন্য পদের বিপরীতে ১১ হাজার ৩৪৩ জন চতুর্থ শ্রেণীর কর্মজীবী রয়েছেন। ফলে ৫ হাজার ১৪১ জনের পদ এখনো খালি রয়েছে। এখানে সব মিলিয়ে ৪০ হাজার ২৬৪ জনের মধ্যে ২৬ হাজার ১৩৫ কাজ করেন, বাকি ১৪ হাজার ১২৯টি পদ শূন্যই রয়ে গিয়েছে। এই শূন্যপদে কর্মী নিয়োগ প্রায় বন্ধ রয়ে যাওয়ায় প্রতি বছর জটিলতা আরো বাড়ছে।  

বিষয়টি আমলে নিয়ে আজ থেকে প্রায় অর্ধযুগ আগে বাংলাদেশের বিভিন্ন দৈনিক সংবাদ ছেপেছিল। তারা স্পষ্ট করে লিখেছিল, পশ্চিমাঞ্চলের লালমনিরহাট রেল বিভাগ কীভাবে মারাত্মক জনবল সংকটে পড়েছে। সেখান থেকে প্রায় ১৮টি ট্রেন ও ২০টি রেলওয়ে স্টেশন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।  দিনের পর দিন এসব কারণে জনদুর্ভোগ যেমন বেড়ে গিয়েছে তেমনি উপযুক্ত রেলসেবা থেকে বঞ্চিত করতে হয়েছে শত শত মানুষকে।  

প্রকাশিত দৈনিক পত্রিকার সংবাদ থেকে জানা যায়, লালমনিরহাট রেলওয়ে বিভাগের ১৭৬টি স্টেশনমাস্টার পদের মধ্যে ৭৬টিই শূন্য ছিল। বাকি ১০০ জনের সঙ্গে চুক্তিভিত্তিক ২৮ জন স্টেশনমাস্টার কাজ করেছেন। লোকোমোটিভ মাস্টার বা ট্রেনচালকের ৮৩টি পদের ৪৭টি শূন্য থাকায় দিন দিন চালক সংকট ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। অবাক করার বিষয় হলেও সত্য যে ওই পদটিতে চুক্তিবদ্ধ ৭ জনসহ ৪৩ জন কাজ করেছেন মাত্র। পক্ষান্তরে ট্রাফিক বিভাগের পরিচালনাধীন ১১৩টি রেলগেটের মধ্যে মাত্র ৩৬টি পোস্টে গেটম্যান থাকার কথা জানা গিয়েছে। লজ্জার বিষয়, এখানকার প্রতিটি গেটে তিনজন করে মোট ৩৬ স্পটে মোট ১০৮ জন জনশক্তি থাকার কথা থাকলেও রয়েছেন মাত্র ৫৮ জন। 

নিয়োগ সম্পর্কিত জটিলতায় বাংলাদেশ রেলওয়ের উত্তরাঞ্চল যেমন জনহীন অরণ্যের রূপ নিয়েছে তা প্রকৃত অর্থে পুরো বাংলাদেশের খণ্ডচিত্র। বাংলাদেশের যেকোনো স্থানে রেল ভ্রমণ করতে গেলে প্রতিটি পদে পদে জনবল সংকট স্পষ্টত দৃশ্যমান। জনহীনতার সুযোগ নিয়ে প্রতিটি স্থানে নৈরাজ্য ছড়িয়েছেন বর্তমানে কর্মরত কর্মচারী-কর্মকর্তারা। তার প্রভাব হিসেবে বেলা শেষে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ যাত্রীরাই। 

যাত্রীসেবার কথা চিন্তা করলে সম্প্রতি সবচেয়ে বড় দুর্ভোগ হয়ে দেখা গিয়েছে দূরপাল্লার টিকিট বিক্রির আধিক্যের বিপরীতে অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বে যাতায়ানের টিকিট দুর্লভ হয়ে যাওয়া। জনশক্তি না থাকার কারণে বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পাশাপাশি দ্রুততম সময়ে দূরতম গন্তব্যে পৌঁছানোর তাগিদে অনেক ট্রেনের স্টপেজ কমানো হয়েছে। এর মাধ্যমে স্বল্প আয়ের বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষের দুর্ভোগ উঠেছে চরমে। অনেক মানুষের জীবন ও জীবিকা ছিল ট্রেনের ওপর নির্ভরশীল। বিভিন্ন স্টেশনে ট্রেন থামানো বন্ধ হওয়ার পর থেকে তারা এখন বিপন্ন জীবন যাপন করছে। বিশেষ করে ট্রেনের ওপর নির্ভর করে যারা দূর-দূরান্তে বসবাস করেও দাপ্তরিক কাজ সারত তারা পড়েছে মহাবিপদে। 

লাভজনক নাকি সেবা খাত—রেলওয়ে নিয়ে এ প্রশ্ন বারবার ঘুরেফিরে এলেও তার উত্তর মেলে না। তবে সেবার কথা চিন্তা করলে প্রথমে ধরা যেতে পারে এর ভেতরে পরিবেশন করা খাবারের মূল্য ও তার মান নিয়ে। খুব সম্ভবত বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন কোচে পরিবেশিত খাবারের মূল্য বাংলাদেশের যেকেনো রেস্টুরেন্টের চেয়ে বেশি আর মানের দিক থেকে এত জঘন্য খাবার রান্নার জন্যও হয়তো প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। সাধারণ চা-কফি যেটা সব জায়গায় ৫ থেকে ১৫ টাকায় বিক্রি হওয়ার কথা, রেলওয়ের খাবার গাড়ি নিলাম করে নেয়ায় তার মালিকেরা এখানেও হরিলুটের জায়গা তৈরি করেছে। 

তারা নিম্নমানের কমদামি টি-ব্যাগে তৈরি চা বিক্রি করছে প্রতি কাপ ১০ টাকা করে। ১০ টাকা মূল্যে বিক্রি হওয়ার মতো কফি তারা ট্রেনের বগি ও সময় বিচারে ২০-৪০ টাকায় বিক্রি করছে। একইভাবে যে পানির বোতল সারা দেশের সবখানে ১৫ টাকা, রেলওয়ের খাবার গাড়ি সেই পানির বোতল বিক্রি করছে ২০-২৫ টাকায়। দ্রব্যমূল্যের এ আগুন ছুঁয়ে গেছে সব রকম খাবার ও চকোলেটে। এমনকি খাওয়ার অযোগ্য স্যান্ডুউইচ তারা বিক্রি করছে প্রায় দ্বিগুণ দামে। খাবার গাড়ি থেকে অন্য সব স্থানের নৈরাজ্য কমিয়ে আনার জন্য প্রয়োজন উপযুক্ত মনিটরিং। সেজন্য অতিরিক্ত জনবলের বিকল্প নেই। 

অনলাইনে প্রাপ্ত অর্গানোগ্রাম বলছে, বর্তমানে বাংলাদেশ রেলওয়ের মোট জনশক্তি থাকার কথা ৪০ হাজার ২৬৪ জন। এর সঙ্গে বিভিন্ন প্রকল্প ও সেবা যুক্ত হলে জনশক্তি বাড়বে বৈ কমবে না। কিন্ন্তু তার বিপরীতে দেখা গিয়েছে, বিভিন্ন পদ দিনের পর দিন যেমন শূন্য পড়ে আছে তেমনি নতুন করে অনেকে অবসরে যাওয়ার ফলে আরো শূন্যপদ তৈরি হচ্ছে। এই শূন্যপদ ধীরে ধীরে বাংলাদেশ রেলওয়ের জন্য মূর্তিমান অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। 

বাংলাদেশ রেলওয়ের নানা স্থানে অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ নতুন নয়। উচ্চতর পদ থেকে শুরু করে একেবারে নিম্নতর পদে কর্মরত কর্মচারী ও কর্মকর্তার দুর্নীতি নিয়ে যে অভিযোগ তা মোটেও নতুন নয়। এক্ষেত্রে বারবার নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও শুধু জনবলের অভাবে তা থমকে গিয়েছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য প্রতিটি অবকাঠামো একেবারে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। কিন্তু শুরুতেই এমন জনবল সংকট থেকে যদি উত্তরণ ঘটানো না যায় তবে তা প্রায় অসম্ভব। বিষয়টিকে আমলে নিয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত সবার আগে বাংলাদেশ রেলওয়ের বিভিন্ন স্থানে যে জনবল ঘাটতি রয়েছে তা নিরসনের আশু উদ্যোগ নেয়া। তারপর পরিস্থিতি অনুযায়ী সিদ্ধান্ত গ্রহণের মাধ্যমে বিদ্যমান অচলাবস্থা থেকে উত্তরণের উপযুক্ত পথ খুঁজে নেয়া গেলেও যেতে পারে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন