অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা

বিদ্যুতের ১০ শতাংশেরও কম বরাদ্দ জ্বালানিতে

আবু তাহের

সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনায় বরাবরই অগ্রাধিকার পায় বিদ্যুৎ খাত। এর সুফলও পেয়েছে বাংলাদেশ। বেড়েছে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা। বিদ্যুতে অগ্রগতির বিপরীত চিত্র দেখা যাচ্ছে জ্বালানি খাতে। তুলনামূলক উপেক্ষিত খাতটিতে এখন ক্রমেই বরাদ্দ হ্রাস পাচ্ছে। এর প্রতিফলন দেখা গিয়েছে সর্বশেষ অনুমোদিত অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায়ও (২০২০-২৫) এতে বরাদ্দ সবচেয়ে বেশি রয়েছে বিদ্যুৎ খাতে। অন্যদিকে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ রয়েছে বিদ্যুতের তুলনায় ১০ শতাংশেরও কম।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বরাদ্দের দিক থেকে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত খাত দুটিতে অগ্রাধিকারের অসামঞ্জস্যের প্রভাব দিনে দিনে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। জ্বালানি খাতে বরাদ্দ কম থাকায় নিজস্ব গ্যাস অনুসন্ধান-উত্তোলনেও বিনিয়োগ করা যাচ্ছে না। এর বিপরীতে বেড়েছে আমদানিনির্ভরতা। এতে করে তৈরি হচ্ছে আরো নাজুক পরিস্থিতি। অতি আমদানিনির্ভরতায় আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজিসহ অন্যান্য জ্বালানি পণ্যের মূল্যের সামান্য হেরফেরও হয়ে ওঠে সরকারি রাজস্বে রক্তক্ষরণের কারণ।

অন্যদিকে ক্রমাগত বরাদ্দ বাড়িয়ে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো হলেও তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। যদিও এজন্য ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ হাজার হাজার কোটি টাকা গুনতে হচ্ছে সরকারকে। এর মধ্যেই আবারো অতিরিক্ত বরাদ্দ রাখা হয়েছে বিদ্যুতেই। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় বরাদ্দের চেয়েও কম।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় বিদ্যুৎ জ্বালানির গুরুত্ব সমান। যদিও বরাবরই অবহেলিত থেকে যাচ্ছে জ্বালানি খাত। ফলে অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে বিদ্যুতের উন্নয়ন যেমন হয়েছে, তেমনি বিপদও বাড়ছে। অন্যদিকে জ্বালানি খাতে সরকারের নজর কম থাকায় দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কোনো অগ্রগতি নেই। দিনের পর দিন আমদানীকৃত জ্বালানির ওপর ভর করেই এগিয়ে যেতে হচ্ছে।

বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক . ফাহমিদা খাতুন বণিক বার্তাকে বলেন, বিদ্যুৎ জ্বালানি খাত দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমে অনবদ্য ভূমিকা পালন করছে। ফলে বিদ্যুৎ জ্বালানিকে সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত। বরাদ্দের অনুপাতে ভারসাম্যহীন রেখে তাতে সুফল পাওয়া গেলেও নেতিবাচক প্রভাবও রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে অতিরিক্ত বিনিয়োগের ফলে দেশের বিদ্যুৎ সক্ষমতা বেড়েছে কিন্তু অব্যবহূত থাকার ফলে বিদ্যুৎ খাতের লোকসানও বেড়ে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, প্রয়োজনমতো বরাদ্দ রেখে বাকি অর্থ দেশের অন্য খাতেও বিনিয়োগ করা যেতে পারে। এদেশে উন্নয়ন অবকাঠামোয় ব্যালান্স তৈরি হবে।

অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় দেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে। অর্থ আগামী পাঁচ বছরে দেশের বিদ্যুৎ সরবরাহে নিরবচ্ছিন্নকরণ, সঞ্চালন অবকাঠামো উন্নয়ন, স্মার্ট প্রিপেইড মিটারসহ প্রযুক্তির আধুনিকীকরণে ব্যয় করা হবে। এর আগে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ খাতের উন্নয়নে প্রায় ৮৫ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছিল। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার নির্ধারিত লক্ষ্য অনুযায়ী উৎপাদন সক্ষমতা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২১ হাজার মেগাওয়াটে। একই সঙ্গে ৯৭ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে বিদ্যুেসবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। নির্ধারিত সময়ে নতুন নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে এসেছে।

পরিসংখ্যান বলছে, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নকালে দেশের বিদ্যুৎ সক্ষমতা বেড়েছে প্রায় ১২ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুতের বড় অংশ আসছে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। কিন্তু ব্যবহার না হওয়ায় এসব কেন্দ্র বসিয়ে রেখে ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে। গত ১০ বছরে সরকার প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎ কোম্পানিগুলোকে। পরিকল্পনায় বিদ্যুতের দাম সমন্বয় করার কথা বলা হলেও এর পরে দাম বেড়েছে দফায় দফায়। এর বাইরে কয়লাভিত্তিক প্রায় দুই ডজন বিদ্যুৎকেন্দ্র অনুমোদন দেয়া হলেও উৎপাদনে আসতে পারেনি বেশির ভাগ কেন্দ্র। যথাসময়ে কাজ সম্পন্ন না হওয়ায় এরই মধ্যে কয়লাভিত্তিক ১৬টি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ পুনর্মূল্যায়ন করছে সরকার। মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী উৎপাদিত মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে আসার কথা থাকলেও এখনো তা শতাংশেও নেয়া যায়নি।

অন্যদিকে অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জ্বালানি খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে মাত্র ১৪ হাজার ৪০০ কোটি টাকা, যা সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বরাদ্দকৃত অর্থের চেয়েও হাজার কোটি টাকা কম। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় জ্বালানিতে বরাদ্দ ছিল ১৭ হাজার ৫৭০ কোটি টাকা। বরাদ্দ কম থাকার প্রভাবও সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কালে দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।

পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের (জিইডি) সদস্য (সিনিয়র সচিব) . শামসুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, নিয়ম অনুযায়ী জ্বালানি বিভাগে যতটুকু বরাদ্দ পাওয়ার কথা, তারা ততটুকুই বরাদ্দ পেয়েছে। সংশ্লিষ্টদের মতামতের ভিত্তিতেই উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। অতিরিক্ত বরাদ্দ দিয়ে সে অর্থের ব্যবহার না থাকলে পরে তাদের অর্থ ফেরত দিতে হবে।

গত পাঁচ বছরে দেশের স্থল সমুদ্রসীমায় তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান করার কথা বলা হলেও সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। অন্যদিকে মিয়ানমার ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিষ্পত্তির পর সময় পেরিয়েছে ছয় বছরেরও বেশি। সময় মিয়ানমার নিজস্ব জলসীমায় ব্যাপক অনুসন্ধান চালিয়েছে। একইভাবে ভারতও গত পাঁচ বছরে তাদের জলসীমায় ব্যাপক তেল-গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম চালিয়েছে।

অন্যদিকে বাংলাদেশের সমুদ্রসীমানা বিরোধ নিষ্পত্তির পর সমুদ্র ব্লকগুলোকে নতুনভাবে বিন্যস্ত করে ২৬টি ব্লকে ভাগ করা হয়। যার মধ্যে ১১টি অগভীর এবং ১৫টি গভীর। মোট ২৬টি ব্লকের মধ্যে চারটি বিদেশী তেল কোম্পানির অধীনে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে। বাকি ২২টি ব্লক উন্মুক্ত কর্মশূন্য। ২০১৪ সালে পেট্রোবাংলা সাগরে অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রাথমিকভাবে মাল্টি ক্লায়েন্ট সিসমিক সার্ভে করার উদ্যোগ নিলেও আজ অবধি তার কোনো অগ্রগতি হয়নি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, অনুসন্ধান কার্যক্রমে জোরালো যে পদক্ষেপ দরকার, তার জন্য জ্বালানি বিভাগ পেট্রোবাংলার মধ্যে সমন্বয়হীন ছিল। যে কারণে এর আজ অবধি কোনো অগ্রগতি হয়নি। এছাড়া জ্বালানি খাতে যে বরাদ্দ রাখা হয়, সে সীমিত অর্থ দিয়ে ধরনের কার্যক্রম সম্ভব নয়।

দেশীয় কয়লা ব্যবহারে সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার মতো এবারের পরিকল্পনায়ও জোর দেয়া হয়েছে। দেশীয় কয়লা নীতিতে রফতানির যে কথা বলা হয়েছিল, তা শুধু কাগজে-কলমেই থেকে গেছে। বরং ২০১৮ সালের জুলাইয়ে বড়পুকুরিয়া থেকে লাখ ৪২ হাজার টন কয়লা গায়েব করা হয়েছে। কয়লা গায়েবের ঘটনায় সেখানকার বিদ্যুৎকেন্দ্রের দুটি ইউনিট বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া কয়লা সংকটে আরো একটি ইউনিট আজ অবধি বন্ধ রাখা হয়েছে। পিএসএমপি অনুযায়ী, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা চলাকালে কয়লা গ্যাস সংকটে এলএনজির ব্যবহার বাড়ানোর কথা বলা হয়। একই সঙ্গে নেপাল ভুটান থেকে বায়ুবিদ্যুৎ আমদানির মাধ্যমে তেল উচ্চমূল্যের জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ আমদানি কমিয়ে আনার কথা বলা হয়। কিন্তু গত পাঁচ বছরে এলএনজির বিদ্যমান যে সক্ষমতা, সেটিও কমে গেছে। এছাড়া তেল-গ্যাস কয়লাভিত্তিক ৫৫টি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসার কথা থাকলেও -১০টির বেশি বিদ্যুৎকেন্দ্র উৎপাদনে আসেনি।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক . বদরুল ইমাম বলেন, পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাগুলোতে জ্বালানি খাতের বরাদ্দ বরাবরই কম। সরকার এর একটি ধারাবাহিক নিয়ম অনুসরণ করে চলেছে। এর কারণ মূলত জ্বালানি নিয়ে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা না থাকা। বছরভিত্তিক কোথায় অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হবে, জরিপকাজ কীভাবে করা হবেএসব নিয়ে পরিকল্পনা নেই। ফলে জ্বালানি খাতে বরাদ্দ কম হবে এটাই স্বাভাবিক। এছাড়া সরকার বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহূত জ্বালানিতে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ছে। যে কারণে বরাদ্দ বিদ্যুতেই বেশি যাচ্ছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন