লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প

বাস্তবায়ন থেকে সরে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

রাশেদ এইচ চৌধুরী, চট্টগ্রাম ব্যুরো

দেশের বৃহৎ বন্দর চট্টগ্রাম। কনটেইনার কনটেইনারবিহীন (বাল্ক কার্গো) দুই ধরনের পণ্যই ওঠানো-নামানো (হ্যান্ডলিং) হয় বন্দরে। দেশের অর্থনীতি বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে চট্টগ্রাম বন্দরের কার্যক্রম। কিন্তু বাণিজ্যের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাড়েনি সক্ষমতা। এক্ষেত্রে খোলা পণ্য (বাল্ক কার্গো) ওঠানো-নামানোর সক্ষমতা বৃদ্ধি অধিক অবহেলিত থেকেছে। বাল্ক কার্গো পরিচালন কার্যক্রমে গতি আনতে একমাত্র পদক্ষেপ ছিল লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প। পাঁচ বছর নিয়ে বেশ খানিকটা অগ্রসর হয়েও শেষমেশ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন পরিকল্পনা থেকে চূড়ান্তভাবে সরে এসেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। 

চট্টগ্রাম বন্দরের তথ্যমতে, পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েই লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল প্রকল্প থেকে সরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। খোলা পণ্যের বাণিজ্যের (বাল্ক কার্গো) ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও আপাতত বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিংয়ের সক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয়ে আর কোনো পদক্ষেপও দৃশ্যমান নয়। পণ্য ওঠানো-নামানোর জন্য বন্দরের অধীনে বর্তমানে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রয়েছে সেগুলোও কনটেইনারবাহী পণ্য পরিচালন কর্মকাণ্ডকে গুরুত্ব দিয়েই এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। 

লালদিয়া মাল্টিপারপাস প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী (সিভিল) মাহমুদুল হোসেন খান। বণিক বার্তার পক্ষ থেকে তার সঙ্গে ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রকল্পটি থেকে সরে আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তবে এর কারণ সম্পর্কে তথ্য দিতে সীমাবদ্ধতা রয়েছে জানিয়ে কথা বলতে অপারগতা জানান।

লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল প্রকল্প নিয়ে সমীক্ষা থেকে শুরু করে গত প্রায় পাঁচ বছর বিভিন্ন পর্যায়ে কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। ২০২২ সালে টার্মিনাল অপারেশনে যাবে বলেও বন্দর কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে ধারণা দেয়া হয়েছিল। নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় বন্দর কর্মকর্তারা এখন বলছেন, লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল পরিচালনায় যেসব শর্ত সামনে এসেছে তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন থেকে পেছনে সরতে হয়েছে। বর্তমানে বন্দরের জন্য যে ট্যারিফ নির্ধারিত রয়েছে লালদিয়ার ক্ষেত্রে তার ৬০ শতাংশ বাড়ানোর কথা বলা হয়েছে। আবার পিপিপির ভিত্তিতে যে অপারেটর টার্মিনালটি পরিচালনা করবে তাকে প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ের গ্যারান্টি দিতে হবে, যা চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের জন্য অস্বস্তিকর। তবে টার্মিনালটি বাস্তবায়ন না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক কারণের কথা বলছেন কেউ কেউ। সংশ্লিষ্ট স্থানে বসতি উচ্ছেদের বিষয়টি গড়িয়েছে উচ্চ আদালত পর্যন্ত। নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে কয়েকবার সতর্ক নির্দেশনা দেয়া হয়েছে উচ্ছেদ কার্যক্রম দ্রুত সম্পন্ন করতে। 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (প্রশাসন পরিকল্পনা) মো. জাফর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, পিপিপির ভিত্তিতে লালদিয়া মাল্টিপারপাস টার্মিনাল পরিচালনায় যেসব শর্ত মানতে হবে তাতে প্রকল্প নিয়ে আর অগ্রসর না হওয়াই যৌক্তিক মনে হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে গেলে উইন উইন সিচুয়েশন হবে না। সব দিক বিবেচনায় নিয়ে টার্মিনালটি বাস্তবায়ন না করার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরে পণ্য ওঠানো-নামানো কার্যক্রম বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সদ্য শেষ হওয়া বছরে (২০২০) চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে খোলা পণ্য পরিবহন হয়েছে ১০ কোটি ৩২ লাখ টন। ২০১৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ১০ কোটি ৩০ লাখ টন। অর্থাৎ কভিড-১৯ পরিস্থিতিতেও বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিং বেড়েছে। এর বিপরীতে চট্টগ্রাম বন্দরের অধীনে সদ্য শেষ হওয়া বছরে (২০২০) কনটেইনার হ্যান্ডলিং হয়েছে ২৮ লাখ ৩৯ হাজার একক। ২০১৯ সালে পরিবহন হয়েছিল ৩০ লাখ ৮৮ হাজার একক। 

চট্টগ্রাম বন্দরে বর্তমানে ছয়টি জেটি দিয়ে চলছে বাল্ক কার্গো হ্যান্ডলিং কার্যক্রম। একদিনে ছয় জেটিতে অবস্থান নিতে পারে ছয়টি জাহাজ। গত বছর প্রায় তিন কোটি টন খোলা পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে এসব জেটিতে। বাকি সাত কোটি টন বাল্ক কার্গো বহির্নোঙরে হ্যান্ডলিং হয়ে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে চলে গেছে। জাহাজের গড় অবস্থান সময় কমে না আসায় ভুক্তভোগী হচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। 

চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, বাল্ক কনটেইনারবাহী দুই ধরনের জাহাজে করে পণ্য আমদানি হয় বন্দরে। এর মধ্যে মূলত খাদ্যশস্য সাধারণ পণ্য আমদানি হয় বাল্ক কার্গো বা খোলা পণ্যবাহী জাহাজে। দেশের চাহিদা বৃদ্ধির কারণে প্রতি বছরই বাল্ক কার্গো আমদানি বেড়ে চলেছে। তাই সে অনুযায়ী অর্থাৎ কনটেইনারবিহীন পণ্য খালাসে সক্ষমতা বৃদ্ধি নিশ্চিত করা জরুরি।

নৌ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকার ১৪ ১৫ নম্বর খালের মাঝামাঝি লালদিয়ার চরে প্রায় ৭৫ একর জায়গায় একটি টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। নানা আনুষ্ঠানিকতা শেষে ২০১৩ সালের ১১ মার্চ ক্যাবিনেট কমিটি অন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার্স লালদিয়া প্রকল্পের অনুমোদন দেয়। প্রথমদিকে এটাকে শুধু বাল্ক টার্মিনাল করার পরিকল্পনা থাকলেও পরবর্তী সময়ে কনটেইনার জাহাজ হ্যান্ডলিং উপযোগী করে মাল্টিপারপাস টার্মিনাল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এক হাজার মিটার দীর্ঘ জেটি এবং এক হাজার মিটার লম্বা ৩০০ মিটার প্রস্থের ইয়ার্ডসহ এটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। লালদিয়া টার্মিনালে ১০ মিটার ড্রাফটের একই সঙ্গে কমপক্ষে পাঁচটি জাহাজ হ্যান্ডলিং করা যাবে বলেও উল্লেখ করা হয়। ২০২১ সালে প্রকল্পটির নির্মাণকাজ শেষ করে ২০২২ সালে অপারেশন শুরুর করার কথা ছিল। বন্দর কর্তৃপক্ষ টার্মিনালের ব্যাপারে ট্রিপল পি ভিত্তিতে দরপত্র আহ্বান করে। পিপিপির ভিত্তিতে ডাকা ওই দরপত্রে আগ্রহী প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে প্রাথমিকভাবে পাঁচ বিদেশী প্রতিষ্ঠানের একটি শর্টলিস্ট তৈরি করা হয়েছিল। এর মধ্যে ছিল ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্রাইভেট মাল্টি পোর্ট অপারেটর আদানি পোর্টস অ্যান্ড স্পেশাল ইকোনমিক জোন লিমিটেড, দুবাই পোর্ট (ডিপি) ওয়ার্ল্ড, ফ্রান্সের বোলোর, বেইজিংভিত্তিক চায়না হারবার অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড এবং সিঙ্গাপুরভিত্তিক গ্লোবাল পোর্ট সার্ভিসেস। 

দেশের বড় ভোগ্যপণ্যের আমদানিকারক বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী প্রসঙ্গে বণিক বার্তাকে বলেন, পণ্য পরিবহনের ক্ষেত্রে আমাদের চাওয়া হলো চট্টগ্রাম বন্দরের প্রবৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব ধরনের উন্নয়নেই মনোযোগ দেয়া হোক। হিসাব করলে দেখা যাবে, কনটেইনার থেকে তিন গুণ বেশি আসছে কনটেইনারবিহীন (বাল্ক) পণ্য। খাদ্যশস্য কিংবা কাঁচামাল বন্দর থেকে হাতে পাওয়ার ক্ষেত্রে সময় যত কম লাগবে পণ্যের মূল্য তত কম হবে। এতে ভোক্তারাই উপকৃত হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন