রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধের জন্য সরকার যে ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ দিয়েছিল, তা পরিশোধে বাড়তি আরো ছয় মাস সময় পাচ্ছেন শিল্প মালিকরা। গ্রেস পিরিয়ড বা ঋণ পরিশোধে বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্তি দিয়ে এ সময় দেয়া হচ্ছে। তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে গ্রেস পিরিয়ডের সময়সীমা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে চিঠি দেয়া হয়েছে।
করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে সরকার থেকে সবার আগে রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করা হয়েছিল। এ প্যাকেজের আওতায় নেয়া ঋণের জন্য মাত্র ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ নির্ধারণ করে দিয়েছিল সরকার। ১ হাজার ৯৯২ পোশাক শিল্পের ৩৫ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীকে এ তহবিল থেকে ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা ঋণ দেয়া হয়। ঋণ দেয়ার সময় শর্ত ছিল ছয় মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ দুই বছরের মধ্যে ১৮টি সমান কিস্তিতে এ ঋণ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু গ্রেস পিরিয়ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর দাবি তোলে বিজিএমইএ। সংগঠনটির দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই এ ঋণ পরিশোধের গ্রেস পিরিয়ড আরো ছয় মাস বাড়াতে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্মতি দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছে।
অর্থ বিভাগ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে দেয়া চিঠির ভাষ্যমতে, রফতানিমুখী শিল্পের শ্রমিকদের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ প্রণোদনা প্যাকেজের ঋণ দেয়া হয়েছিল। এ ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ১ মার্চ থেকে পরবর্তী ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার অনুরোধ জানানো হচ্ছে। এজন্য প্যাকেজ-সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালায় প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনতেও অনুরোধ করা হয়েছে চিঠিতে।
এ বিষয়ে অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে বলেন, শ্রমিকদের বেতন-ভাতার ঋণের ক্ষেত্রে আগামী ১ মার্চ থেকে পরবর্তী ছয় মাস অতিরিক্ত গ্রেস পিরিয়ড (এ সময় ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না) দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এজন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে বাংলাদেশ ব্যাংককে গত সোমবার চিঠিও দেয়া হয়েছে। এ প্যাকেজের আওতায় রফতানি খাতের শ্রমিকদের গত বছরের এপ্রিল ও মে মাসের বেতন-ভাতা দেয়ার জন্য ঋণ দেয়া হয়। যেসব উদ্যোক্তা এ প্যাকেজ থেকে ঋণ নিয়েছিলেন তাদের ঋণ পরিশোধে গ্রেস পিরিয়ড ছিল গত ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গিয়েছে, এর আগে জারীকৃত নীতিমালা অনুযায়ী জানুয়ারিতে ব্যবসায়ীরা ঋণের প্রথম কিস্তির ২৭০ কোটি টাকা পরিশোধ করেছে। ফেব্রুয়ারি মাসেও দ্বিতীয় কিস্তি পরিশোধ করবে। তারপর মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত তাদের আর কোনো কিস্তি পরিশোধ করতে হবে না। এরপর সেপ্টেম্বর থেকে পরবর্তী ১৮ মাসে ১৬ কিস্তিতে বাকি অর্থ পরিশোধ করতে হবে। বর্তমান নিয়ম অনুযায়ী এ প্যাকেজের ঋণ ছয় মাসের গ্রেস পিরিয়ডসহ পরবর্তী ১৮ মাসে ১৮টি কিস্তিতে পরিশোধ করার বিধান ছিল। অর্থ বিভাগের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ ব্যাংক যদি নীতিমালা পরিবর্তন করে এক বছর গ্রেস পিরিয়ডসহ পরবর্তী ১৮ মাসে ঋণ পরিশোধ করার প্রজ্ঞাপন জারি করে, সেক্ষেত্রে ঋণগ্রহীতারা ঋণ পরিশোধের জন্য দুই বছরের জায়গায় আড়াই বছর সময় পাবেন।
এ প্রসঙ্গে জানাতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বণিক বার্তাকে বলেন, চিঠিটা আমি এখনো দেখিনি। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় যদি এ ধরনের নির্দেশনা দেয় তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক সেটা বিচার-বিশ্লেষণ করে সিদ্ধান্ত নেবে। কিস্তি আদায় করা বন্ধ করে দিলে ব্যাংকগুলো ক্ষতিতে পড়বে, এটাও ভাবার বিষয়। সার্বিক বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যালোচনা করে দেখবে।
অর্থ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, রফতানিমুখী শিল্পে করোনার ক্ষত কাটাতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় সহজ শর্তে শ্রমিকদের বেতন-ভাতা বাবদ সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেয়া হয়েছে। শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে কয়েক দফায় এ ঋণ দেয়া হয়। করোনার সংক্রমণ রোধে গত বছরের ২৬ মার্চ থেকে দেশব্যাপী সাধারণ ছুটি শুরু হয়। এর আগের দিন ২৫ মার্চ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রফতানি খাতের শিল্প-কারখানার শ্রমিকদের বেতন-ভাতা পরিশোধে ৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। তবে এপ্রিল ও মে মাসের বেতন-ভাতা দিতেই ৫ হাজার কোটি টাকা থেকে ৪ হাজার ৯৩৫ কোটি ১৯ লাখ টাকা শেষ হয়ে যায়। সরকারের কোষাগার থেকে জোগান দেয়া এ অর্থের জন্য ২ শতাংশ সার্ভিস চার্জ আরোপ করা হয়।
পরে ব্যবসায়ীদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে জুনের বেতন-ভাতার জন্য ব্যাংক খাত থেকে আরো আড়াই হাজার কোটি টাকার ঋণ দেয়া হয়। আড়াই হাজার কোটি টাকা ঋণের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো ৯ শতাংশ হারে সুদ পাবে। তবে এর মধ্যে গ্রাহক সুদ হিসেবে পরিশোধ করবে মাত্র ২ শতাংশ। বাকি ৭ শতাংশ সুদ ভর্তুকি হিসেবে দেবে সরকার। এরপর জুলাইয়ের বেতন পরিশোধের জন্য রফতানিমুখী খাতকে সরকার ঘোষিত ৩০ হাজার কোটি টাকার আরেকটি প্যাকেজ থেকে ৩ হাজার কোটি টাকা ঋণ সুবিধা দেয়া হয়। এ ঋণের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য সুদহার ৯ শতাংশ, যার মধ্যে গ্রাহক দেবে সাড়ে ৪ শতাংশ, বাকি সাড়ে ৪ শতাংশ ভর্তুকি হিসেবে দেবে সরকার। তবে শুধু ৫ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজের ঋণের গ্রাহকরা অতিরিক্ত ছয় মাসের গ্রেস পিরিয়ড পাবেন। বাকি ঋণের ক্ষেত্রে অন্যান্য প্যাকেজের নিয়ম-নীতি প্রযোজ্য হবে।
তিন দফায় নেয়া এ ঋণের মধ্যে প্রথম দুই দফার সাড়ে সাত হাজার কোটি টাকা ঋণের ক্ষেত্রে গ্রেস পিরিয়ড ছয় মাসের পরিবর্তে এক বছর এবং দেড় বছরে ১৮ কিস্তির পরিবর্তে পাঁচ বছরে ৬০ কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধের সুযোগ চেয়েছিলেন পোশাক শিল্প মালিকরা। বিজিএমইএর এমন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠিও দেয় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ছয় মাস গ্রেস পিরিয়ড বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার।
এ প্রসঙ্গে বিজিএমইএ সভাপতি ড. রুবানা হক বণিক বার্তাকে বলেন, গ্রেস পিরিয়ড ছয় মাস বাড়ানো হচ্ছে এজন্য আমরা প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ। আমরা আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি যে ভ্যাকসিনেশনের ফলে এ সময়ের মধ্যেই পশ্চিমের বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে, আমরাও ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা অর্জন করব। আগামী ছয় মাসে এ খাতে যে অস্থিতিশীলতা থাকবে, সেটা আমরা ভালোভাবে মোকাবেলা করতে পারব। কারণ প্রধানমন্ত্রী আমাদের সব ধরনের সহযোগিতা করে আসছেন।