একজন শামসুল হক, হাজারো তরুণের পথ প্রদর্শক

রেজাউল করিম সিদ্দিকী

রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা তখন উত্তাল। রাজধানীর রাজনৈতিক উত্তাপ ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন জেলা শহরে। সে সময়ের ময়মনসিংহ জেলার সবচেয়ে বড় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আনন্দমোহন কলেজেও আন্দোলনের ঢেউ এসে পৌঁছে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে চলমান আন্দোলনে জড়িয়ে পড়ে ছাত্রসমাজ। ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের সময় এম শামসুল হক ছিলেন কলেজের উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র। আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখায় তাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। দীর্ঘ ছয় মাস কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে তাকে বন্দি করে রাখা হয়। কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি ময়মনসিংহ শহরে প্রথম শহীদ মিনার স্থাপনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ভাষা আন্দোলনে অনবদ্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ বছর মরণোত্তর একুশে পদক পেলেন ভাষা সৈনিক এম শামসুল হক। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে তার অবদানের স্বীকৃতি দীর্ঘদিন পর হলেও আমাদের জন্য এক অনন্য গৌরব আত্মতৃপ্তির বিষয়।

পৃথিবীতে বাঙালি একমাত্র জাতি যারা নিজস্ব ভাষা সংস্কৃতির দাবিতে নিজের প্রাণ বিলিয়ে দিয়েছে। ১৯৫২ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা বাংলার ভাষার দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলন এবং জীবন উৎসর্গ করা পৃথিবীর ইতিহাসে একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ইতিহাসের বিরল ঘটনার একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন ভাষা সৈনিক এম শামসুল হক।

এম শামসুল হক ১৯৩০ সালের ২৯ জানুয়ারি ময়মনসিংহের তারাকান্দা উপজেলার কামারিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অ্যাডভোকেট সমীর উদ্দিন ছিলেন একজন নামকরা আইনজীবী।

ভাষা সৈনিক এম শামসুল হক ১৯৬৬-এর ছয় দফা, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণসহ তত্কালীন সব রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৭০ সালের তত্কালীন পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭৩ সালের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে তত্কালীন ময়মনসিংহ-১৫ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালের তৃতীয়, ১৯৯১ সালের পঞ্চম ১৯৯৬ সালের ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ময়মনসিংহ- আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৮৮ সালে তিনি ফুলপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি ১৯৯৬ সালে বস্ত্র পাট মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি ছিলেন।

তৃণমূল থেকে উঠে আসা ব্যাপক জনপ্রিয় নেতার স্থানীয় জনগণের প্রতি ছিল অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ভালোবাসা। অবিসংবাদিত নেতা বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সব আন্দোলন সংগ্রামে সম্মুখ সারির একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। সাধারণ মানুষকে অতি সহজেই আপন করে নেয়ার এক মোহনী ক্ষমতা ছিল তার মধ্যে।

তার স্ত্রী আম্বিয়া খানম একজন গৃহিণী হওয়া সত্ত্বেও তার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনে ছিলেন নিরন্তর অনুপ্রেরণার উৎস। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন পুত্র তিন কন্যা সন্তানের গর্বিত পিতা। তার পুত্র শরীফ আহমেদ ময়মনসিংহ- (তারাকান্দা-ফুলপুর) সংসদীয় আসন থেকে ২০১৪ সালের দশম ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। ২০১৮ সালের মন্ত্রিসভায় শরীফ আহমেদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। বর্তমানে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গৃহায়ন গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে তিনি ২০১৩ সালে তারাকান্দা উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি দশম জাতীয় সংসদের ডাক, টেলিযোগাযোগ তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

এম শামসুল হকের কন্যা শামসিয়ারা ইয়াসমিন, নাজনীন আহমেদ এবং অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী তুহিন আহমেদ পেশায় গৃহিণী। তার দ্বিতীয় সন্তান (পুত্র) সাঈদ আহমেদ ময়মনসিংহ শহরের একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী ছিলেন। ২০০৪ সালে তিনি হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। শামসুল হকের কনিষ্ঠ পুত্র সাজ্জাদ আহমেদ তারাকান্দা উপজেলার বঙ্গবন্ধু সরকারি ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

২০০৫ সালের ৩০ মে হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ভাষা সৈনিক এম শামসুল হক পরলোক গমন করেন। তারাকান্দা উপজেলার বঙ্গবন্ধু সরকারি ডিগ্রি কলেজ প্রাঙ্গণে চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কীর্তিমান পুরুষ।

তার কীর্তিকে স্মরণ করে ময়মনসিংহ শহরের টাউন হল সংলগ্ন স্থানে ভাষা সৈনিক শামসুল হক মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে। আজীবন সংগ্রামী এবং অধিকার আদায়ে আপসহীন জননেতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা নিরন্তর।

রেজাউল করিম সিদ্দিকী: জনসংযোগ কর্মকর্তা গণপূর্ত মন্ত্রণালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন