সময়ের ভাবনা

ব্যবসা-বাণিজ্যের পরিবর্তনশীল চরিত্র ও ঋণখেলাপের সংজ্ঞা প্রসঙ্গে

ড. আরএম দেবনাথ

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে মোট খেলাপি ঋণ কত? এর উত্তর নির্ভর করে সংজ্ঞার ওপর।খেলাপি ঋণকাকে বলে তার সংজ্ঞা আছে। এর রদবদল করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কম-বেশি করা যায়। সংজ্ঞাটি কঠোরতর অপরিবর্তনীয় করলে খেলাপি ঋণ বাড়বে, বিপরীতে সংজ্ঞাটি শিথিল করলে খেলাপি ঋণ কমবে। সংজ্ঞা অংকের মতো। সংজ্ঞা নির্ধারণ কে করে? অবশ্যই বাংলাদেশ ব্যাংক। বাংলাদেশ ব্যাংক তা ঠিক করে, অনেক সময় পরিবর্তন করে। যারা খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা এবং এর বিপরীতে রক্ষিতব্য প্রভিশন বা সঞ্চিতির নীতিমালার কথা জানেন, তারাই বলবেন সংজ্ঞাগুলো কতমেকানিক্যাল’, অপরিবর্তনীয়। এগুলো বস্তুত অংকের বা বীজগণিতের সংজ্ঞার মতো। এদিক-সেদিক করার কোনো ক্ষমতা ব্যাংকগুলোর নেই। ক্ষমতা আছে বাংলাদেশ ব্যাংকের। সংজ্ঞা কঠোরতর করে তারা ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ৫০ শতাংশ, ৬০-৭০ শতাংশকেই খেলাপি ঋণে পরিণত করতে পারে। আবার তারা চাইলে সংজ্ঞা শিথিল করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ কমাতে পারে। যেমনটা এখন হচ্ছে। কভিড-১৯ সময়কালে খেলাপির সংজ্ঞা পরিবর্তন, প্রভিশনের পরিমাণ যথেষ্ট পরিমাণে কমানো হয়েছে। কভিড-১৯ সময়কালে বলি কেন, এর আগেই ব্যাংক খাতে সুদূরপ্রসারী সব পরিবর্তন আনা হয়েছে। বহু নিয়মকানুনের ওলটপালট করা হয়েছে। আগে আমাদের বলা হতো এসব নিয়ম আন্তর্জাতিক মানদণ্ডমাফিক করা। ব্যাংক অব ইন্টারন্যাশনাল সেটলমেন্ট (বিআইএস) এসব নিয়ম-বিধি করে দিয়েছে। বিশ্বের সব দেশের জন্য। উদারীকরণ, মুক্তবাজার অর্থনীতি বিশ্বায়নের নামে এসব করা। দুনিয়ার সব দেশে একই ইউনিফর্ম পরা বাধ্যতামূলক, নইলে শাস্তি। অথচ কে না জানে একেক দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য, ব্যাংক-বীমা রীতিনীতি একেক রকম। একেক দেশের সমস্যা একেক রকমের। তবু সবাইকে একই আইন মেনে চলতে হবে। কিন্তু এখন সব নিয়মকানুন ওলটপালট। ঋণ পুনঃতফসিলের নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়েছে। তা করতে গিয়ে ঋণ পরিশোধসীমা তফসিল শিথিল করা হয়েছে। ডাউন পেমেন্ট কমানো হয়েছে। নতুন ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। অর্থনীতিবিদরা এসবের সমালোচনা করেছেন। এর আগে অবশ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী বড় একটা পরিবর্তন করে গেছেন। পুনঃতফসিল করা ঋণের টাকা বড় ব্যবসায়ীরা দিতে পারছিলেন না। তিনি ঋণ পুনঃতফসিলের পরিবর্তে নতুন ধারণার জন্ম দেন। এর নামঋণ পুনর্গঠন সুদের হার কমানো, পরিশোধের সীমা বাড়ানো, গ্রেস পিরিয়ড প্রদান ইত্যাদি সুবিধা দিয়ে বড় বড় ঋণগ্রহীতাকে বিরাট সুযোগ-সুবিধা দেয়া হয়। সমালোচকরা বসে থাকেননি। তারা ভয়ংকরভাবে সমালোচনা করেন। তখন যে ঘটনাগুলো ঘটছে তার দুটো দিক। একটা হচ্ছে ঋণখেলাপের সংজ্ঞার দিক এবং আরেকটা হচ্ছে ব্যবসার দিক। অভিজ্ঞতায় দেখা যাচ্ছে ঋণখেলাপের সংজ্ঞা অংকের মতো। মেকানিক্যাল, লেনদেনভিত্তিক। সিকিউরিটির মূল্য এক্ষেত্রে খুবই কম। সংজ্ঞার ভেতরে শিথিলতা দেখানোর কোনো সুযোগ নেই। সংজ্ঞা মেনে ব্যাংকগুলোকে যার যার খেলাপি ঋণের তালিকা করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে পাঠাতে হয়।

অন্যদিকে ব্যবসা-বাণিজ্য অংকের মতো নয়। পুঁজি নিয়ে ব্যবসায় নামলেই লাভ-মুনাফা আপসে চলে আসে না। ব্যবসা-বাণিজ্যে উত্থান-পতন আছে। আজ লাভ কাল ক্ষতি হতে পারে এবং তা নানা কারণে হতে পারে। কারণের শেষ নেই। এই যেমন কভিড-১৯। কে জানত চীনের উহান নগরী থেকে আগত একটি ভাইরাস সারা পৃথিবীকে লণ্ডভণ্ড করে দেবে। ভাইরাস ব্যবসা-বাণিজ্যকে পেছনে ফেলেছে। লক্ষ কোটি লোক বেকার হয়েছে। ব্যবসা বন্ধ হয়েছে, উৎপাদন, আমদানি-রফতানি বন্ধ হয়েছে। এখনো চলছে এর ধকল। স্কুল-কলেজ এখনো বন্ধ। অবস্থায় কী মনে হয়? মনে হয় কি ব্যবসায়ী বাড়ি থেকে টাকা এনে ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবেন? না, তা হয় না। ব্যবসা চলবে, ব্যবসায়ী টাকা পরিশোধ করবেন, আবার নেবেন, দরকারবোধে সুদ মওকুফ হবে, ব্যবসায়ী নতুন উদ্যোগ নেবেন। এটা চলমান প্রক্রিয়া। এতে উত্থান-পতন আছে। চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের দিকে তাকালে বোঝা যায় কত ভালো ভালো ব্যবসায়ী আজ পথে। ঢাকায় বহু ভালো ভালো ব্যবসায়ী আজ পথে। এসব খবর দৈনিক বণিক বার্তা নিয়মিত আমাদের দিয়ে যাচ্ছে। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে ব্যবসায় উত্থান-পতন আছে। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী সংসদে ঋণখেলাপির সংখ্যা কত তার একটা তালিকা দিয়েছেন। সারা ব্যাংকিং এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে মোট খেলাপির সংখ্যা লাখ ৬৫ হাজার। বিভিন্ন আদালতে ঋণের টাকা আদায়ের জন্য সব ব্যাংকের বিচারাধীন মামলার সংখ্যা লাখ ৭৭ হাজার। প্রশ্ন এখানে একটি, এরা কি সবাই ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি? না, তা হওয়ার নয়। ইচ্ছাকৃত খেলাপি কারা ব্যাংকগুলো জানে, সরকারও জানে এবং দেশবাসীও জানে। কিছুসংখ্যক ইচ্ছাকৃত খেলাপিকে ছেড়ে বাকিদের বিচার করা কি যুক্তিসংগত, মোটেই নয়। এরা যে ঋণখেলাপি হলো তার কারণ কী? কারণ এটা অবশ্যই ঋণখেলাপের সংজ্ঞা। ঋণখেলাপের সংজ্ঞার ভেতরে তারা পড়েছে। অতএব তাদের আর গতি নেই। কী সেই সংজ্ঞা? ঋণখেলাপ প্রভিশনিংয়ের ওপর যে সার্কুলার আছে, তার নাম মাস্টার সার্কুলার লোন ক্লাসিফিকেশন প্রভিশনিং। এর অধীনে লোনকে (ঋণ) চার ভাগে ভাগ করতে হয় যথা: . কনটিনিউয়াস লোন, . ডিমান্ড লোন, . ফিক্সড টার্ম লোন . শর্ট টার্ম এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড মাইক্রোক্রেডিট। প্রতিটি ক্যাটাগরির লোনকে দুটো ক্রাইটেরিয়ার নিরিখেশ্রেণীবিন্যাসকরতে হয়। অর্থাৎ খেলাপি ঋণের বিচার শুরু হয়। এই দুটো ক্রাইটেরিয়া হচ্ছে অবজেকটিভ ক্রাইটেরিয়া কোয়ালিটেটিভ জাজমেন্ট। যে কেউ এসব পড়ে দেখতে পারেনকী জটিল এসব বিধিবিধান। আমার তো মনে হয় এসবের নিরিখে বিচার যদি সত্যাসত্য করতে হয়, তাহলে কোনো ঋণ যে খেলাপি ঋণ হবে না তা বলা বড়ই মুশকিল। বস্তুত এসব অংক কষার জন্য বিশাল বিশাল বিভাগ ব্যাংকে ব্যাংকে কর্মরত। আর মজার ঘটনা প্রতিনিয়ত এসব নিয়মে পরিবর্তন আসছে। সার্কুলারের পর সার্কুলার। কোনটার সঙ্গে কোনটা কীভাবে সম্পর্কিত করে কাজ করতে হবে, তা বোঝা অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক যা বলবে তা- হবে। ব্যাংকের মতামতের কোনো মূল্য নেই। নিয়ম অনুযায়ী ব্যাংকগুলো যার যারশ্রেণীবিন্যাসকরণকরবে, সেই অনুপাতে নিয়ম অনুযায়ী ঋণখেলাপি চিহ্নিত করবে। তা যাবে বাংলাদেশ ব্যাংকে। বাংলাদেশ ব্যাংক সেই হিসাব মানতেও পারে, না- মানতে পারে। চলবেদেন-দরবার দিনের পর দিন। এই যে অংক, এটা যেভাবে চলে, যেভাবে অংক করতে হয় ব্যবসা-বাণিজ্য কি সেই অংক মোতাবেক চলে? কখন কোন ব্যবসা, কী কারণে ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে তা কেউ জানে না। অথচ ঋণখেলাপির সংজ্ঞা তার ধার ধারে না।

দুই-তিন দশকের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, ব্যবসা-বাণিজ্যের গতিপ্রকৃতি, পরিবর্তনশীল চরিত্র ঋণখেলাপের অপরিবর্তনীয় সংজ্ঞা ভীষণভাবে সাংঘর্ষিক। এর প্রমাণ অনেক। যেমন পুনঃতফসিলের নিয়মকানুন। এটি এখন বস্তুত একটি অচল প্রক্রিয়া। বারবার পুনঃতফসিল হচ্ছে। প্রতিবার কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যেতে হচ্ছে, তদবির করতে হচ্ছে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একশ্রেণীর কর্মকর্তার মধ্যে অনিয়মের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঋণ পুনঃতফসিলের রীতিনীতি যে অকেজো তার আরেক প্রমাণ হচ্ছেঋণ পুনর্গঠনপ্রক্রিয়া। বারবার ঋণ পুনঃতফসিল করার পরও যখন কাজ হচ্ছে না, তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক আবিষ্কার করল ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়া (লোন রিকনস্ট্রাকশন) নানা ধরনের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ পরিশোধের ব্যবস্থা করা হলো। কোথায় গেলঋণখেলাপেরসংজ্ঞা? শুধু ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ নয়, ঋণখেলাপির তালিকা থেকে অবমুক্তকরণ, ‘লার্জ লোনবিধিনিষেধ শিথিলকরণ, ব্যাংকের ব্যালান্সশিট অনুমোদন, ঋণখেলাপির সংজ্ঞা ব্যবহারে মতদ্বৈধতা ইত্যাদি নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর দেনদরবার চলে অবিরত। আর ওই পর্যায়েই মিডিয়ায় মুখরোচক সব খবর প্রকাশিত হয়, যা পড়লে পিলে চমকে যায়। ঋণখেলাপির সংজ্ঞা ব্যবহার, ক্রমবর্ধিষ্ণু ঋণখেলাপির সংখ্যা, খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধিএসব প্রেক্ষাপটেই আরেক তথ্য হাজির করা হয়। বলা হয় সংজ্ঞা নয়, নিয়মনীতি নয়, ঋণের ওপর সুদের হার মারাত্মকভাবে বেশি। পৃথিবীর কোথাও এত বেশি সুদের হার নেই। মাত্রাতিরিক্ত সুদের জন্যই ব্যবসায়ীরা সময়মতো ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারেন না। ঋণ নিতে নিতেই সুদ, সুদের কারণে পরিশোধতব্য টাকার পরিমাণ সহ্যসীমার বাইরে চলে যায়। ব্যবসায়ীরা ব্যবসা করবেন, না ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করবেন। অতএব সরকার বাংলাদেশ ব্যাংককে অগোচরে রেখে ঋণের ওপর সুদের হার শতাংশে নামিয়ে আনে। কিন্তু কাজ তো শেষ হলো না। ঋণের ওপর সুদের হার শতাংশ করতে হলে আমানতের ওপর সুদের হার কমাতে হয়। যথারীতি তা- করা হলো। আমানতের ওপর সুদের হার করা হলো শতাংশ। সব ব্যাংকে একই সুদের হার। বাজার অর্থনীতি প্রতিযোগিতার যুক্তি চুলায় যাক। বাজার অর্থনীতি, প্রতিযোগিতার কথা বলে কত কিছু করা হয়, কিন্তু ঋণের ক্ষেত্রে, আমানতের ক্ষেত্রে তা অগ্রাহ্য হলো। শুধু তা- নয়, চক্রবৃদ্ধি হারে সুদ গণনা তাও বন্ধ করা হয়েছে। উদ্দেশ্য খেলাপি ঋণ কমানো। এর ফলাফল ভবিষ্যতে বোঝা যাবে। মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে খেলাপি ঋণের সংজ্ঞা, প্রভিশনের নিয়মনীতি, ঋণের টাকা পরিশোধের নিয়মনীতি, সুদের হার ইত্যাদি সবক্ষেত্রে এক লণ্ডভণ্ড অবস্থা। আন্তর্জাতিক মানদণ্ড, বাংলাদেশ ব্যাংকের রীতিনীতি সব ভেঙে গেছে। এর কারণ কী? মুহূর্তের কারণকরোনা-১৯উদ্ভূত জরুরি পরিস্থিতি। এর আগেই অবশ্য খেলাপি ঋণের উল্লম্ফন ঘটে। তা থেকে সৃষ্টি হয় জরুরি পরিস্থিতি। যখনই ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা ঘটে, চাহিদা-সরবরাহে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়, খরা, অতিবৃষ্টি, আন্তর্জাতিক মন্দা, দেশীয় চাহিদায় ঘাটতি, ব্যবসায়িক ক্ষতি দেখা দেয়, তখনই ব্যবসায়ীরা ছকবাঁধা নিয়মের অধীনে ঋণের টাকা পরিশোধ করতে পারেন না। তাই অভিজ্ঞতার আলোকে ভেবে দেখা দরকার অংকভিত্তিক ফর্মুলা ব্যবসা-বাণিজ্যের বাস্তব অবস্থার সঙ্গে কতটুকু সামঞ্জস্যপূর্ণ। ব্যবসা-বাণিজ্য অংক নয় অথচ ঋণখেলাপের সংজ্ঞা অংক। বিপরীতমুখী দুই অবস্থাকে একমুখী করার জন্য এখনই ভাবা দরকার।

 

. আরএম দেবনাথ: অর্থনীতি বিশ্লেষক

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন