আলোকপাত

বাংলাদেশের রূপান্তরে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত

হুমায়ুন রশিদ

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে প্রতিটি ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে দিতে কাজ করে যাচ্ছে সরকার খাতের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অংশীদার। দুর্গম পাহাড় থেকে চরাঞ্চল, খাল-বিল-মাঠ পেরিয়ে এরই মধ্যেই গ্রিড এলাকার শতভাগ মানুষের ঘরে বিদ্যুতের আলো পৌঁছে গেছে। অফগ্রিড যেসব এলাকা রয়েছে, সেখানকার মানুষের কাছে বিদ্যুতের আলো পৌঁছানো এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিগগিরই ভোলা পটুয়াখালীর দুর্গম চরের কয়েক লাখ মানুষ বিদ্যুতের আলোয় আলোকিত হতে যাচ্ছে।

২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত বিশ্ব বিনির্মাণের পথে এগিয়ে চলছে বাংলাদেশ। লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য দেশের জ্বালানি খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। কারণ গ্যাস বিদ্যুতের বিষয়টি নিশ্চিত করা গেলে বাংলাদেশে বেসরকারি খাতের বিনিয়োগ অনেক বেড়ে যাবে। খাতের বিশেষজ্ঞরাও বিষয়ে একমত পোষণ করেছেন। তাদের মতে, বর্তমানে বাংলাদেশে দ্রুত ব্যাপক শিল্পায়নের প্রধান সমস্যা হলো প্রাথমিক জ্বালানির স্বল্পতা। বিশেষ করে বিকল্প জ্বালানির বিষয়টি নিশ্চিত না করার কারণে বাংলাদেশকে মধ্যস্বল্প, মধ্য দীর্ঘমেয়াদি সমাধান খুঁজতে আমদানি করা জ্বালানির ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এক হিসাব অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যবহূত মোট জ্বালানির ৯০ শতাংশ হবে আমদানি করা। আর এজন্য বাংলাদেশকে মোটা অংকের অর্থ জোগান দিতে হবে।

তবে জ্বালানি খাতগুলোর মধ্যে বিগত বছরগুলোতে দেশের বিদ্যুৎ খাতে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছে। সাফল্যের বেশির ভাগ এসেছে ২০০৯-২০ সালে অর্থাৎ মাত্র ১১ বছরে। স্বাধীনতার ৩৯ বছরে (১৯৭১-২০০৯) যেখানে ৪৭ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় ছিল, সেখানে ২০২১ সালের মধ্যে অর্থাৎ মাত্র ১২ (২০০৯-২১) বছরে অবশিষ্ট ৫৩ শতাংশ মানুষ বিদ্যুতের আওতায় এসেছে। এর মাধ্যমে একটি গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক অঙ্গীকারও বাস্তবায়ন হচ্ছে। ১৯৭২ সালে প্রণীত বাংলাদেশের সংবিধানে দেশের সব মানুষকে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় আনার কথা উল্লেখ করা হযেছে।

জ্বালানির প্রধান খাত গ্যাস। তবে বাংলাদেশে গ্যাসের সংকট দিনে দিনে বেড়েই চলছে। সংকট মোকাবেলায় সরকার তরল গ্যাস আমদানি শুরু করেছে। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সংসদে তথ্য দিয়েছেন, উত্তোলনযোগ্য নিট মজুদের পরিমাণ ১২ দশমিক ৫৪ ট্রিলিয়ন ঘনফুট। এটি বছর দুয়েক আগের তথ্য। ব্যবহারের কারণে বর্তমানে গ্যাসের মজুদ আরো কমেছে। বাংলাদেশে এখন গ্যাসের মজুদ ১২ টিসিএফ আছে। প্রতি বছর এক টিসিএফ গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে মজুদকৃত গ্যাস দিয়ে আগামী ১২ বছর চলার কথা। কিন্তু অনেক জ্বালানি বিশেষজ্ঞ মনে করেন, বর্তমানে যে পরিমাণ গ্যাস মজুদ আছে সেটি দিয়ে ১০ বছরের বেশি চলবে না। ফলে এটি পরিষ্কার যে বাংলাদেশে এখন প্রতিদিন যে পরিমাণ গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে সেটি চাহিদা পূরণের জন্য যথেষ্ট নয়। গ্যাস সংকট থেকে মুক্তির জন্য আমাদের নতুন উপায় খুঁজে বের করতে হবে এবং গ্যাস ব্যবহারে সাশ্রয়ী হতে হবে। পাশাপাশি এলপিজির সহজলভ্যতা গ্যাসক্ষেত্র সন্ধান করার বিষয়গুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে। প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকটে গ্যাসের চাহিদা মেটাতে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসই (এলপিজি) বিশেষ সহায়ক ভূমিকা পালন করে। আমাদের দেশে এলপিজি সিলিন্ডারের চাহিদা কারণে ক্রমেই বাড়ছে। তবে এক্ষেত্রে এলপিজি দেশজুড়ে সবার জন্য সহজলভ্য করতে সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবার আরো কার্যকরী উদ্যোগ নিতে হবে।

গ্যাস বা তেলসম্পদ আহরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সমুদ্র বিশ্বে সম্ভাবনাময় এলাকাগুলোর মধ্যে অন্যতম স্থান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ২০১২ ২০১৪ সালে যথাক্রমে মিয়ানমার ভারতের সঙ্গে আন্তর্জাতিক আদালতের মাধ্যমে বাংলাদেশের সমুদ্র সীমানা বিরোধ নিষ্পত্তি হয়। তবে এসব এলাকায় সমুদ্রসম্পদ আহরণের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। কিন্তু মিয়ানমার ভারত সমুদ্র সীমানার ওপারে বড় আকারের গ্যাসসম্পদ আবিষ্কার আহরণের কাজ সার্থকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়নে তরুণরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। কারণ চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে নিত্যনতুন কারিগরি-বিষয়ক দক্ষতা রপ্ত করে তারাই সনাতন ধারণাকে পেছনে ফেলে উদ্ভাবনী প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে খাতের বিকাশের প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে পারবেন। এজন্য যথাযথ শিক্ষা প্রদান গুরুত্বপূর্ণ। দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, অন্যান্য খাতের মতো বাংলাদেশের জ্বালানি খাতেও দক্ষ মানবসম্পদের অভাব রয়েছে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে শিগগিরই বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ ২০৪১ সালের মধ্যে ৬০ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অবকাঠামোগত উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদের প্রয়োজন। স্থানীয় দক্ষ মানবসম্পদের অভাবে জ্বালানি খাতের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, এগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ সামগ্রিক কার্যক্রমে বিদেশীদের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সংকট নিরসনে সঠিক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করতে হবে। 

উন্নত বিশ্বে জ্বালানি খাতে ডিজিটাল রূপান্তরের লক্ষ্যে কাজ করছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। তেল গ্যাস কোম্পানিগুলোর সাহায্য-সহযোগিতায় প্রযুক্তি সেবাদাতা নানা প্রতিষ্ঠান খাতে অগ্রগতিমূলক পরিবর্তন এনেছে। বিশ্বজুড়ে অন্যান্য খাতের মতো জ্বালানি খাতেও ডিজিটাল রূপান্তরের ছোঁয়া লেগেছে। ফাইভজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) বিগ ডাটার মতো অ্যাপ্লিকেশনগুলোর ব্যবহার খাতের প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। আমাদের দেশেও আমরা জ্বালানি শক্তি খাতে প্রযুক্তির অসীম সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-বিষয়ক প্রশিক্ষণ বিগ ডাটা অ্যানালিটিকস বাস্তবায়ন, তেল গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য ক্লাউড ব্যবহার, রোবট ড্রোনের মাধ্যমে পরিদর্শন এবং অগমেন্টেড রিয়ালিটি (এআর) ভার্চুয়াল রিয়ালিটি (ভিআর) অ্যাপ্লিকেশনের ব্যবহার বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে আমাদের জন্য নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করবে।

আগামী ১৫ বছরে ৩০ হাজার হেক্টর জমিতে ১০০ অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। এসব অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে উঠলে অন্তত এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার যে স্বপ্ন দেখছে তা শিল্পায়নের মাধ্যমেই সম্ভব। এক্ষেত্রে শিল্পায়নের বড় উপকরণ গ্যাস বিদ্যুৎ সরবরাহের বিষয়টি নিশ্চিত করাকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

 

হুমায়ুন রশিদ: ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রধান নির্বাহী

এনার্জিপ্যাক পাওয়ার জেনারেশন লিমিটেড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন