সাত-সতেরো

অনলাইন গেমস: এর কোনো শেষ নেই...!

মো. আব্দুল হামিদ

ধরা যাক, প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে বিছানায় গেলেন। ক্ষণিকের মধ্যেই গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলেন। এরপর কেউ যদি আপনাকে না ডাকে, কতক্ষণ ঘুমাবেন? ১০-১২ ঘণ্টা, নাকি তারও বেশি? কেউ বাধ্য না করলেও একপর্যায়ে আপনি উঠবেন, তাই না? কিন্তু আপনার সন্তানের গেমস খেলার ক্ষেত্রে তার প্রিয় ট্যাব বা ফোনটা হাতে দিয়ে যদি ছেড়ে দেন, কতক্ষণ পর স্বেচ্ছায় সেটা রাখবে? নাওয়া-খাওয়া ভুলে সারা দিন শ্রম দেয়, কিন্তু কী অর্জনের জন্য সে এত কষ্ট করে তা জানে না!

শুধু কি ছোটরা? বড়দের ফেসবুক-ইউটিউব বা বিভিন্ন গেমসের প্রতি আকর্ষণ কি কোনো অংশে কম? ক্রমেই এটা তীব্র হচ্ছে। রাস্তায় চলার সময়ও স্ক্রিনে আটকে থাকে। বাধ্য হলে তবেই চোখের সামনে থেকে সেগুলো সরায়। কিন্তু মন সায় দেয় না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ইচ্ছার বিরুদ্ধে সেটা রেখে উঠতে বা ঘুমাতে হয়! কেন এমনটা হয়? ভাবনা থেকেই আজকের নিবন্ধের সূচনা।

সরবরাহ বাড়তে থাকলে স্বভাবতই সেই বস্তুর চাহিদা কমার কথা। ব্যতিক্রম ছাড়া একপর্যায়ে তা শূন্য এমনকি নেগেটিভও হতে পারে। আহার, বিনোদন, ঘুম, যৌনকর্মসহ জীবনের প্রায় সব ক্ষেত্রেই এমনটা হয়। একটা বিশেষ (চূড়ান্ত) পর্যায় অতিক্রম করার পর তার প্রতি আকর্ষণ কমে। কিন্তু হাল আমলে এমন কিছু বস্তু আমাদের জীবনে ঢুকে পড়েছে, যার সত্যিকার অর্থে কোনো শেষ নেই। নগরজীবনে প্রায় অপরিহার্য হয়ে ওঠা অনুষঙ্গগুলো নিয়ে সবাই কষ্টে আছে। কিন্তু উত্তরণের পথ নেই জানা!

একবার টানা তিনদিন শুধু পানি খেয়ে থাকা এক ব্যক্তির সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। প্রচণ্ড গরম ভাতের প্লেট তার সামনে রাখামাত্র তরকারি ছাড়াই সেটা খেতে শুরু করেন। ভাবখানা এমন ছিল যে ক্ষুধার জ্বালায় তার জিহ্বা-গলা বুঝি অনুভূতিহীন হয়ে পড়েছে। অন্যরা গরম ভাতে হাত দিতেও পারছিল না; তিনি দ্রুত খাচ্ছিলেন। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, অন্যদের শেষ হওয়ার আগেই কিন্তু তার খাওয়া শেষ হয়! জোর করেও আরেকটু মাংস বা ভাত সেই ব্যক্তির প্লেটে দেয়া সম্ভব হয়নি।

আবার বিশ্বকাপ ফুটবলে ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা ম্যাচ মানেই ছিল মহাযুদ্ধ। তবু খেলা ৯০ মিনিটের দিকে এগোতে থাকলে দর্শক গ্যালারি ছাড়ার প্রস্তুতি নিত। খেলা চলাকালে বহুবার ম্যাচ ক্লাইমেক্সে ওঠে। কিন্তু দর্শক জানে দেড় ঘণ্টার পর আর এক মিনিটও খেলা চলবে না। ছোটবেলায় মনে প্রশ্ন জাগত, খেলাটা আরো বেশি সময় হলে ক্ষতি কী হতো? ক্লান্ত খেলোয়াড়দের বদলে দিলেই তো হয়।

আসলে সারা দিন কঠোর পরিশ্রমের পর সাময়িক বিনোদনের জন্যই অধিকাংশ খেলার উদ্ভব হয়। কিছু মানুষ খেলে মজা পায়, অন্যরা দেখে। আর সে কারণেই নাকি চীন-রাশিয়ার মতো দেশ ক্রিকেট খেলাকে অগ্রাধিকার দেয়নি! তাদের প্রধান যুক্তি হলো, একটা মানুষ সারা দিন খেলাধুলা করলে কাজ করবে কখন?

সত্যিই তাই। ভারত-পাকিস্তান ক্রিকেট ম্যাচের একদিনে গোটা দুনিয়ায় ঠিক কত কোটি শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়, কল্পনা করা যায়? আমাদের আবেগকে পুঁজি করে এখন শুধু দিন নয়, রাতেও নানা টুুর্নামেন্টের আয়োজন হচ্ছে। খুব সম্ভবত কাজের ফাঁকে বিনোদন নয়, বিনোদনের ফাঁকে কাজ করানোরমহান লক্ষ্যসামনে রেখেই এমনতর আয়োজন হচ্ছে! যদিও ব্রিটিশদের নিজ কলোনিগুলোতে খেলার প্রচলন করার পেছনে অন্য উদ্দেশ্য ছিল।

একসময় টিভি স্টেশন বেলা ৩টার আগে খুলত না। পিক আওয়ার থাকত রাত সাড়ে ৮টা থেকে ১০টা। সেটুকু সময়ের মধ্যে দর্শক বিনোদনের পুরোটা গভীরভাবে অনুভব করত। ধারাবাহিক নাটকের পরের পর্ব দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষার মধ্যেও যে মজা ছিল তা এখনকার দিনে কল্পনাও করা যায়? অথবা মাসে একটা পুরনো সিনেমা দেখার সময় দর্শকের যে গভীর মনোযোগ থাকত, এখন সদ্য মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র দেখেও সেই অনুভুতি হয় না! তখন সময় সীমিত থাকলেও তৃপ্তি ছিল ষোলআনা।

এখন বিনোদনের জন্য বরাদ্দকৃত সময় উপকরণ উভয়ই বহুগুণ বেড়েছে। কিন্তু সেই তৃপ্তি কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। ঠিক দেশী মুরগির তুলনায় ব্রয়লারের মতোসাইজে বাড়লেও স্বাদ হারিয়ে গেছে! হাল আমলে অনেকেই ভোগ্যপণ্যের বিপুল সরবরাহ থাকায় নিজেদের ভাগ্যবান মনে করে। কিন্তু আগের দিনে সামান্য সরবরাহে যে চূড়ান্ত তৃপ্তি হতো, আজ তা মাইক্রোস্কোপ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

যা হোক, এত কথা বলার কারণ হলো স্মার্টফোন-ট্যাব বা ওই-জাতীয় পণ্য আমাদের মূল্যবান সময় মনোযোগ কাড়ছে। সবচেয়ে বড় কথা হলো, জীবনকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। বিশেষত, শিশু-কিশোর-তরুণদের প্রযুক্তিপণ্যে প্রবল আসক্তি তাদের ভবিষ্যেক হুমকির মুখে ঠেলে দিচ্ছে। আগে কার্টুন-নাটক-সিনেমার একটা নির্ধারিত সময় থাকত। শুরুর আগেই জানা যেত যে ঠিক কখন সেটা শেষ হবে। অথচ এখন কয়েক ঘণ্টা দেখার পরও বোঝা যায় না, এখন সে বিনোদনের কোন পর্যায়ে রয়েছে। আর কতক্ষণ পরই বা স্বেচ্ছায় নিজের কাজে মনোযোগী হবে?

অধিকাংশ মা-বাবার প্রধান আলোচ্য বিষয় এটা। একজনের থেকে আরেকজনের অবস্থা আরো খারাপ! বিশেষত দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তারা প্রচণ্ড অসহায় বোধ করছেন। নিজেদের প্রয়োজনে বাইরে যেতে হয়। আর সারাটা দিন, এমনকি গভীর রাত পর্যন্ত সন্তানেরা সেগুলো নিয়ে ব্যস্ত থাকে। বাইরে নানা ভয়-শঙ্কা থাকায় তারা সন্তানকে ঘরে রাখার স্বার্থে সেটা মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু তাতে বিপদ বাড়ছে না কমছে তা বলা সত্যিই মুশকিল।

আগের দিনে বিনোদনগুলো থাকত সাময়িক আনন্দের উপলক্ষ মাত্র। সেগুলো উপভোগ করলে মনমেজাজ ফুরফুরে হতো। নিজ কাজে মন বসানো সহজ হতো। কিন্তু এখন বিনোদনের কবলে পড়ে চোখ মাথা ক্লান্ত হয়ে যায়। তার প্রভাব পড়ে পুরো শরীর মনে। ফলে তারা সেটা থেকে দূরে থাকলেও ক্লান্ত-অবসন্ন অবস্থা থেকে মুক্তি পায় না। কোনো কাজে গভীরভাবে মনোযোগী হওয়া কঠিন হয়। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পারফরম্যান্স খারাপ হতে থাকে। একপর্যায়ে তা আত্মবিশ্বাসে ফাটল ধরায়। এভাবে বিপুলসংখ্যক শিশু-কিশোর-তরুণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু ঠিক কী করণীয় তা বোঝা যাচ্ছে না।

ধমক দিয়ে বা জোর করেও খুব একটা কাজ হচ্ছে না। আর কিশোর-তরুণরা ট্রেন্ড ফলো করবে সেটাই স্বাভাবিক। এমন পরিস্থিতিতে যথার্থ বিকল্প আসা ছাড়া উপায় দেখি না। আবারবিকল্প পণ্যভালোর চেয়ে মন্দ হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। কারণ ক্যাসেট প্লেয়ারকে সরিয়ে এসেছিল টিভি। প্রচলিত টেলিভিশনকে পেছনে ফেলেছিল স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলো। আবার ভিডিও গেমসের জায়গা নিয়েছিল অফলাইন গেমস; এখন সেগুলো চলছে অনলাইনে। পাশাপাশি টিকটক-লাইকি-ভিগো প্রভৃতি তো আছেই। ফলে ভবিষ্যতে যারা এদের পরাজিত করবে, তাদের আকর্ষণ আরো দুর্নিবার হবে বলে অনুমান করা যায়।

তাছাড়া প্রায় সবার ইন্টারনেটে অবাধ প্রবেশাধিকার থাকায় কে কখন কার কথায় কীভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে যায়, সেটাও বোঝা সম্ভব নয়। কারণ নেট দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে ঘৃণার চাষবাস চলে। পাশাপাশি ভালোর মোড়কে অনেকেই উঠতি বয়সীদের দলে ভেড়াতে তত্পর রয়েছে। সরাসরি যাদের সঙ্গে কখনো দেখা-সাক্ষাৎ হওয়া সম্ভব ছিল না, এখন তাদের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ঘটনাও অহরহ ঘটছে। ফলে বহু মা-বাবা হঠাৎ করে সন্তানের আচরণ দৃষ্টিভঙ্গি বদলে খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ছেন।

স্রোত এতটাই প্রবল যে তার বিপরীতে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। সে চেষ্টা করলে অস্থিরতা আরো বাড়তে পারে। তাই মা-বাবাদের বিষয়টা গভীরভাবে উপলব্ধি করা জরুরি। নগরজীবনে সৃষ্ট কৃত্রিম স্ট্যাটাস বজায় রাখতে গিয়ে এখন আর আমরা একক আয়ের উেস সন্তুষ্ট থাকতে পারছি না। ফলে চাকরির পাশাপাশি আরো কিছু করতে উদ্যত হচ্ছি। খরচের অসংখ্য খাত সৃষ্টি করে এখন তা পূরণে ছুটছি। ফলে বাইরের লোকদের জন্য অনেক বেশি সময় মনোযোগ বরাদ্দ থাকছে। অথচ ঘরের সন্তানদের সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বাড়ছে।

নিত্যনতুন মডেলের গাড়ি, অভিজাত এলাকায় বাড়ি, নিয়মিত বিদেশ ভ্রমণ কোনো কিছুই আমাদের স্বস্তি দেবে না, যদি প্রিয়তম সন্তানটি বখে যায় কিংবা বিশেষ কোনো আসক্তিতে জড়িয়ে পড়ে। গাড়ি নিয়ন্ত্রণ হারানোর চেয়েও মানুষের নিয়ন্ত্রণ হারানো অধিক ভয়ংকর। তাই আমরা অনেক কিছু অর্জন করতে গিয়ে খুব সম্ভবত সবচেয়ে দামি বস্তুর প্রতি অমনোযোগী হয়ে পড়ছি। আর সুযোগে তার ওপর দখল নিয়ে নিচ্ছে! আমার সদ্য প্রকাশিতমস্তিষ্কের মালিকানাবইয়ে ব্যাপারে বিস্তারিত বলতে চেষ্টা করেছি।

যখন সত্যিই উপলব্ধি হচ্ছে তখন অনেকেরই বড্ড বেশি দেরি হয়ে যাচ্ছে। আপনার মা-বাবার কোটি টাকার ফ্ল্যাট ছিল না, লেটেস্ট মডেলের গাড়ি ছিল না, লাখ টাকার খাটে ঘুমাতেন না। তবু তাদের মনে শান্তি ছিল, পরিবারে সুখ ছিল। কারণ আপনার মতো সন্তানেরা তাদের চক্ষু শীতল করত, মনে প্রশান্তি আনত। এখন আপনার হয়তো সবই হয়েছে। কিন্তু মনে শান্তি নেই, টেনশনের অন্ত নেই। তবু সিস্টেমের দোহাই দিয়ে অধিকাংশই স্রোতে গা ভাসাচ্ছি।

সন্তানদের নামি-দামি স্কুলে ভর্তি করে কয়েকটা প্রাইভেট টিউটর দেয়াই সব নয়। বরং তাদের যথেষ্ট সময় দেয়া অনেক বেশি দরকার। শহুরে অধিকাংশ পরিবারের সন্তানেরা অভিভাবকদের অপছন্দ করছে। ব্যাপারে মন খুলে কথা বলার মতো পরিবেশও নেই। ফলে নেট দুনিয়াই হয়ে ওঠে তাদের সবকিছু। বন্ধুদের মনে হয় দুনিয়ার সবচেয়ে বুদ্ধিমান, দরকারি উপকারী শ্রেণী। অনেকে রীতিমতো পিতা-মাতাকে শত্রুজ্ঞান করতে শুরু করেছে!

এমন অবস্থায় তাদের ভালো বা মন্দ লাগার অংশীদার হওয়া জরুরি হলেও আমরা সেকেন্ড বা থার্ড সোর্স অব ইনকামের দিকে বিশেষভাবে মনোযোগী হচ্ছি। এক্ষেত্রে অনেকেইআমি তো তাদের জন্যই এত কিছু করছিবলে স্বপক্ষে যুক্তি দেন। কিন্তু সন্তানেরা সত্যিই কি সেটাকে ভ্যালু দেয়? নাকি আপনার-আমার সীমাহীন চাওয়া দেখতে দেখতে তারা বড্ড ক্লান্ত বোধ করছে?

একসময় ভাবা হতো বড় হলেই সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু খুব সম্ভবত ব্যাপারটা এত সহজ নয়। তারা অনেক কিছুতেই এখন ফুলস্টপ দিতে শিখছে না। এমন ধারা চলতে থাকলে তারা ঠিক কোথায় গিয়ে ঠেকবে তা বলা সত্যিই মুশকিল। এসব থেকে ফেরানোর জন্য তাদের বুঝতে চেষ্টা করার বিকল্প নেই। বেশি আয় দিয়ে সুখ কেনা যায় না। তাই জীবনে আয় সবকিছু নয়। কথা যত দ্রুত বুঝতে পারব, ততই কল্যাণ। নইলে সময় গেলে সাধন হবে না...!

 

মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক পোস্ট ক্রাইসিস বিজনেস বইয়ের লেখক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন