কিস্তি ছাড়ের সুবিধায় ২ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ

হাছান আদনান

কভিড-১৯ মহামারীতে সৃষ্ট দুর্যোগে বিধ্বস্ত বৈশ্বিক অর্থনীতি। এর প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের উৎপাদন রফতানিতে। প্রতিকূল অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাংকঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা স্থগিত করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। সরকারের নির্দেশনায় ঋণগ্রহীতাদের জন্য ঘোষিত ডেফারেল সুবিধা বা পেমেন্ট হলিডে কার্যকর ছিল বিদায়ী বছরজুড়ে। যদিও নীতি ছাড়ের সুযোগ নেননি দেশের বেশির ভাগ গ্রাহক। তবে সুযোগ পেয়ে ব্যাংকঋণ পরিশোধ করেননি এমন ঋণের পরিমাণও কম নয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বলছে, ডেফারেল সুবিধা নেয়া ঋণের পরিমাণ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার বেশি। এটি দেশের ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত ঋণের ২৩ শতাংশ।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দেশে ব্যাংক খাতের বিতরণ করা ঋণের পরিমাণ ছিল ১০ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালের শুরু থেকে শেষ দিন পর্যন্ত কার্যকর ছিল ডেফারেল সুবিধা। সময়ে ডেফারেল সুবিধা উপভোগ করেছে লাখ ৫৫ হাজার ৩৮৬ কোটি টাকার ঋণ। তবে সুবিধা নেয়া কিছু গ্রাহক ৩৬ হাজার ৭১১ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে কিছু কিস্তি পরিশোধ করেছেন। বাকি লাখ ১৮ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে বিদায়ী বছরে ব্যাংকগুলোকে এক টাকাও পরিশোধ করা হয়নি, যা ব্যাংক খাতের বিতরণকৃত মোট ঋণের প্রায় ২০ শতাংশ।

গত এক বছরে ঋণগ্রহীতারা সবচেয়ে বেশি ডেফারেল সুবিধা নিয়েছেন অগ্রণী ব্যাংক থেকে। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেক থেকে কোনো অর্থই আদায় হয়নি। এছাড়া গ্রাহকদের বেশি ডেফারেল সুবিধা দেয়া ব্যাংকগুলোর মধ্যে রয়েছে ডাচ্-বাংলা, সোনালী, আইএফআইসি, সাউথইস্ট, জনতা, ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ব্যাংক এশিয়া ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি) এসব ব্যাংক থেকেই গ্রাহকরা ডেফারেল সুবিধা পেয়েছেন লাখ ৩৪ হাজার ৯০০ কোটি টাকা, যা মোট ডেফারেল ঋণের ৫৩ শতাংশ। পেমেন্ট হলিডে দেয়া না হলে ঋণ খেলাপির খাতায় উঠত।

ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা থেকে এক বছর মুক্ত থাকার পরও মেয়াদ আরো ছয় মাস বাড়ানোর দাবি ছিল এফবিসিসিআইসহ দেশের ব্যবসায়ীদের। তবে ব্যবসায়ীদের দাবি নাকচ করে মেয়াদ আর না বাড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরই মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। সে হিসাবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে খেলাপি ঋণের সময়গণনা শুরু হয়েছে। ডেফারেল সুবিধা নেয়া গ্রাহকদের জানুয়ারি থেকেই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু করতে হবে। অন্যথায় মার্চ থেকেই দেশের ব্যাংক খাতের এক-চতুর্থাংশ ঋণ নতুন করে খেলাপির খাতায় যুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। খেলাপি ঋণের ধেয়ে আসা ঝড় মোকাবেলা করা অনেক ব্যাংকের পক্ষেই অসম্ভব হয়ে উঠবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

করোনাভাইরাসের গতিপ্রকৃতিসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করেই পেমেন্ট হলিডের মেয়াদ তুলে দেয়া হয়েছে বলে জানান বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশের সবকটি ব্যাংকের কাছে আমরা ডেফার্ড পেমেন্ট বা অপরিশোধিত ঋণের তথ্য চেয়েছিলাম। ব্যাংকগুলো থেকে যে তথ্য দেয়া হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে বেশির ভাগ ঋণের বিপরীতেই গ্রাহকরা কিস্তি পরিশোধ করেছেন। যে পরিমাণ ঋণের বিপরীতে গ্রাহকরা ডেফারেল সুবিধা নিয়েছেন, তা তুলনামূলকভাবে কম। এটি দেশের ব্যাংক খাতের জন্য একটি ভালো সংবাদ। দেশের সবকটি ব্যাংকের শীর্ষ নির্বাহীসহ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সুপারিশের ভিত্তিতেই ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতার শিথিলতা তুলে নেয়া হয়েছে।

রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক থেকে সর্বোচ্চ ডেফারেল সুবিধা নিয়েছেন ব্যাংকটির ঋণগ্রহীতারা। পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৯ সাল শেষে অগ্রণী ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ ছিল ৪৬ হাজার কোটি টাকা। ঋণের মধ্যে বিদায়ী বছরে ২৪ হাজার ২০০ কোটি টাকাই ডেফারেল সুবিধার আওতায় পড়েছে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির অর্ধেকের বেশি গ্রাহক বিদায়ী বছরে কোনো অর্থ ফেরত দেননি।

সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বড় গ্রাহকরা ঋণের কিস্তি পরিশোধ না করায় এমনটি হয়েছে বলে মন্তব্য করেন অগ্রণী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. শামসউল-ইসলাম। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য উদ্যোক্তাদের স্বার্থের কথা বিবেচনা করেই ডেফারেল সুবিধা দেয়া হয়েছিল। কিন্তু কিছু গ্রাহক অনৈতিকভাবে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করেননি। এখন ঋণ পরিশোধের বাধ্যবাধকতা ফিরে এসেছে। এখন গ্রাহকরা ব্যাংকের টাকা যথানিয়মে পরিশোধ করবেন বলেই আশা করছি। করোনা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি, এটিও মনে রাখতে হচ্ছে।

১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ডেফারেল সুবিধা দেয়া ব্যাংকের সংখ্যা আটটি। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের ১৯ হাজার ৮০০ কোটি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের ১৫ হাজার ৮০০ কোটি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের ১৩ হাজার ৮০০ কোটি, সাউথইস্ট ব্যাংকের ১১ হাজার ৬০০ কোটি, সোনালী ব্যাংকের ১১ হাজার ৫০০ কোটি, আইএফআইসি ব্যাংকের ১১ হাজার ৬০০ কোটি এবং জনতা ব্যাংকের ১০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা ডেফারেল সুবিধা পেয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের -সংক্রান্ত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, ডেফারেল সুবিধার আওতায় পড়েছে ব্যাংক এশিয়ার হাজার ২০০ কোটি, ইউসিবির হাজার ১০০ কোটি, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংকের হাজার কোটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংকের হাজার কোটি, ট্রাস্ট ব্যাংকের হাজার ৯০০ কোটি, মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের হাজার ৮০০ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংকের হাজার ৭০০ কোটি, দি সিটি ব্যাংকের হাজার ৫০০ কোটি টাকা। সিটি ব্যাংকের সমপরিমাণ অর্থ ডেফারেল সুবিধার আওতায় পড়েছে প্রাইম ব্যাংকের। পূবালী ব্যাংকের হাজার কোটি, ন্যাশনাল ব্যাংকের হাজার ৮০০ কোটি, এক্সিম ব্যাংকের হাজার ১০০ কোটি প্রিমিয়ার ব্যাংকের হাজার ৫০০ কোটি, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের হাজার ৪৫০ কোটি টাকা ডেফারেল সুবিধার আওতায় পড়েছে।

কর্মীদের আন্তরিক চেষ্টার কারণে পূবালী ব্যাংকের খুব বেশি ঋণ ডেফারেল হয়নি বলে জানান ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী মো. আব্দুল হালিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ঋণের কিস্তি অপরিশোধিত থাকলে গ্রাহকদেরই বিপদ বলে আমরা বোঝাতে পেরেছি। কারণে আমাদের গ্রাহকদের বড় অংশ নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করেছেন। এখন কিস্তির মেয়াদ বাড়িয়ে হলেও গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা আদায়ের চেষ্টা করছি। তবে মহামারীতে অনেক গ্রাহকই সর্বস্বান্ত হয়েছেন, এতে কোনো সন্দেহ নেই।

এদিকে গতকাল কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ব্যাংকিং প্রবিধি নীতি বিভাগ থেকে জারীকৃত প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গ্রাহকদের যে ডেফারেল সুবিধা দেয়া হয়েছে, তা ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে আর বর্ধিত হবে না। তবে ব্যাংকার-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে কেবল মেয়াদি ঋণ আদায় প্রক্রিয়া সহজ করা যাবে। এক্ষেত্রে মেয়াদি ঋণের অবশিষ্ট মেয়াদের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ সময় বাড়ানোর অনুমতি দেয়া হয়েছে। কোনোভাবেই বর্ধিত সময়সীমা দুই বছরের বেশি হবে না বলে প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন