ধানমন্ডি লেকে এক সন্ধ্যা

রাইসা জান্নাত

ঘড়িতে সন্ধ্যা ৬টা ১২। অফিস থেকে বেরিয়ে সোনারগাঁ হোটেলের বিপরীতে পথচলা। উদ্দেশ্য রিকশা। গন্তব্য ধানমন্ডি ৩২। লেকের ভেতরে। অফিস ফিরতি সারি সারি গাড়ি, রিকশার টুং টাং শব্দ, সিএনজির কালো ধোঁয়া, জ্যাম ঠেলে লেকে পৌঁছাতে বেজে গেল পাক্কা ৭টা। রিকশা থেকে নেমে লেকের সরু রাস্তা ধরে শুরু হলো হাঁটা... শীতের সন্ধ্যা। আরো ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল আলো-আধারিযুক্ত আবহ। রাস্তার এক পাশে লেকের টলটলে পানি। পানির ওপর গাছের ছায়া আর দূর থেকে ভেসে আসা টীমটীমে আলোর চাঁদরে লেকের ভেতর সে এক অন্যরকম দৃশ্য। অন্য দিকটায় কিছুটা দূরত্ব পর পর বসেছে তরুণ-তরুণীদের আড্ডা। এসব অবলোকন করতে করতে হঠাৎ সামনে মিলে গেল পরিচিত কিছু মুখ। অতঃপর সবাই মিলে আবারো হাঁটতে থাকা...

পথ চলতে চলতে দেখা মিলল ছবি আঁকার সরঞ্জামসহ এক তরুণের। ধানমন্ডি লেকে যাদের নিয়মিত আনাগোনা তাদের এটা অজানা নয় যে, বেশ কয়েকজন তরুণ প্রতিদিন সেখানে আসেন, ছবি আঁকতে। তবে সেই তরুণকে দেখে এখানে নতুন মনে হল আজ। কাছে যেতেই একটা পোর্ট্রেটকে হাওয়া দিতে দেখা গেল তাকে। কার পোর্ট্রেট জিজ্ঞেস করতেই উত্তর মিলল, পোর্ট্রেটটি তার নিজেরই। এই তরুণের নাম মো. সিরাজ। একটু আগে মোবাইলে নিজের ছবি দেখে স্কেচটি করেছেন। সেটাকেই এখন শুকাচ্ছেন। সিরাজ আজ প্রথমবার ধানমন্ডি লেকে এসেছেন। কৌতূহলী হয়ে জানতে চাওয়া হলো কতদিন যাবত আঁকাআকির সঙ্গে যুক্ত? সিরাজের কথায় জানা গেল, গত প্রায় ১৫ বছর ধরে তিনি এ কাজটি করছেন। কেবলই ভালোবেসে। কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই তার। সিরাজ চারুকলার শিক্ষার্থী নন। নিজের চেষ্টায় বলা যায় এ দক্ষতা লাভ করেছেন। তার আঁকার হাত দেখে অবশ্য তা এতটুকুও বোঝার উপায় নেই। শুধু পোর্ট্রেটই নয়, প্রাকৃতিক দৃশ্যসহ নানা কিছুর ছবি আঁকেন সিরাজ। সেসব আবার বিক্রি করেন। 

একেকটি ছবির অর্থমূল্যও আলাদা। সর্বনিম্ন ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে আড়াই-তিন হাজার পর্যন্তও নিয়ে থাকেন। অবশ্য তা নির্ভর করে কী ধরনের ছবি তার ওপর। একবার নাকি ২০ হাজার অর্থমূল্যেরও স্কেচ করেছিলেন সিরাজ। তার সঙ্গে কথোপকথনের আগ পর্যন্ত তখনো তার কাছে পোর্ট্রেট করার জন্য কোনো ক্লায়েন্ট আসেননি। তাই বসে বসে নিজের পোর্ট্রেটই এঁকে ফেলেন। তারপর কথা বলতে বলতেই সেটাকে শুকিয়ে নিলেন। ছবি আঁকার অনেক মাধ্যম রয়েছে। তবে আঁকিবুকির ক্ষেত্রে সিরাজের প্রধান মাধ্যম চারকোল। 

ছোটবেলা থেকেই নিজের আগ্রহে আঁকাআঁকি করতেন সিরাজ। আরেকটু বড় হওয়ার পর থেকে ছবি আঁকাই তার ‘প্যাশনে’ পরিণত হয়। একসময় এ কাজই হয়ে ওঠে তার সাবলম্বিতার উপায়। এভাবে ছবি বিক্রি করে কেমন চলে সিরাজের জীবন? সিরাজের উত্তর,‘ভালো আছি’। পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, ‘অন্তত চাকরির থেকে এই কাজটা করা ভালো নয় কি?’ ‘নিজের স্বাধীনতা আছে। মন খারাপ থাকলে ছবি আঁকলে মন ভালো হয়ে যায়’—বললেন সিরাজ। 

করোনায় লকডাউনের সময় কী করেছেন, এর জবাবে সিরাজের উত্তর, সে সময় বাসায় বসে অনলাইনে ছবি আঁকার কাজ করেছি। জানালেন, অনলাইনে ক্লায়েন্টরা ফোন করে অর্ডার দিতেন, ছবি পাঠাতেন নিজেদের; আর সেগুলো দেখেই আঁকাআকি করতেন। 

এ কাজে তার পরিবারের সদস্যদের যথেষ্ট সমর্থন রয়েছে। আগামীতেও নিজেকে এই শিল্পচর্চার সঙ্গে যুক্ত রাখার ইচ্ছার কথা জানালেন সিরাজ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার চৌহদ্দি পুরোটা পার করতে পারেননি তিনি। অনার্স শেষ করেছেন। ঢাকা কলেজে মাস্টার্সে ভর্তি হলেও পারিবারিক কারণে তা সম্পন্ন করা হয়ে ওঠেনি। সিরাজের দেশের বাড়ি খুলনা বাগেরহাট। এখানে যাত্রাবাড়িতে বসবাস তার। 

আগামীকাল কি আবারো এখানে দেখা যাবে আপনাকে? ‘কালকে এখানে না-ও আসতে পারি।’ তাহলে পরের গন্তব্য? ‘কখনো কখনো পার্লামেন্ট ভবনের সামনে বসি।’ এখানেই সিরাজের সঙ্গে আলাপের ইতি টেনে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকি...

দৃশ্যপট-২

কিছুটা হাঁটতেই একটা বিশেষ জায়গাজুড়ে বেশ কিছু চিত্রকর্ম নজর কাড়ে। পোর্ট্রেট, প্রাকৃতিক দৃশ্য, প্রাণীদের চিত্র দড়িতে ঝোলানো রঙ বেরঙের আরো নানা চিত্রকর্ম। বুঝতে কষ্ট হলো না লেকের ধারে খোলা আকাশের নিচে চলছে একটি প্রদর্শনী। কিন্তু কার প্রদর্শনী? আশপাশের কয়েকজনের কাছে জানা গেল প্রদর্শনীটি এক তরুণের। এবার অপেক্ষা সেই তরুণের। একটু পরই দেখা মিলল তার। খানিক এগিয়ে কথা বলার চেষ্টা তার সঙ্গে। তরুণটি তার সামনে বসে থাকা পরিচিত একজনের পোর্ট্রেট আঁকায় ব্যস্ত। পাশে ভেসে আসছে গিটারের সুর। নাম জানতে চাইলে খানিক মুখ তুলে উত্তর দিলেন, জাকির হোসেন আনন্দ। রঙতুলি নিয়ে খেলতে খেলতেই উত্তর দিলেন আরো নানা প্রশ্নের। আনন্দ রাজধানীর ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অলটারনেটিভে (ইউডা) পড়াশোনা করেন। তার কথায় জানা গেল, গত নভেম্বর থেকে প্রদর্শনীটি চলছে। কিন্তু এভাবে প্রদর্শনীর কারণ কী? তার উত্তর, ক্যাম্পাস থেকে ধানমন্ডি লেক কাছে। আর পরিবেশটাও ভালো। 

সন্ধ্যা নামলে লেকের ভেতরের আনাগোনাও যায় বেড়ে। জগিং করতে করতে হঠাৎ করে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে এক ঝলক দেখে নিচ্ছেন ছবিগুলো। পছন্দ হলে কিনেও নেন অনেকে—বললেন আনন্দ। একেকটি ছবির মূল্য আড়াই/তিন হাজার থেকে শুরু। আনন্দের সঙ্গে কথা বলতে বলতে খেয়াল করলাম চারপাশে ছোট ভিড় জমে গেছে। সেখানেই আলাপের ইতি টেনে এগিয়ে যেত থাকি সামনে.. পেছন ফিরে একবার তাকিয়ে দেখি আনন্দ তখনো আপনমনে ছবি এঁকে যাচ্ছে...

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন