ভাগ্য ফেরানোর স্বপ্ন নিয়ে প্রতি বছর মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে পাড়ি দিচ্ছেন লাখ লাখ বাংলাদেশী কর্মী। বিদেশ যাত্রার আগে খরচ জোগাতে কেউ সম্পদ বিক্রি করছেন, কেউ নিচ্ছেন চড়া সুদে ঋণ। তবে বিদেশ পৌঁছেই স্বপ্ন ভঙ্গের মুখে পড়ছেন অনেকেই। বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী কর্মীদের সমস্যা ও কষ্ট নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন শেষ পর্ব
২০১৩ সালের দিকে একবার মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেন যশোরের ইমরান হোসেন। সে সময় ভিসা, এজেন্সি ফি, উড়োজাহাজের টিকিটসহ বিভিন্ন খরচ বাবদ প্রায় সাড়ে ৩ লাখ টাকা দালালকে দেন তিনি। এজন্য পৈত্রিক সূত্রে পাওয়া ইসাপুর গ্রামের কৃষিজমিগুলো বন্ধক রেখেছিল তার পরিবার। তবে শেষ পর্যন্ত প্রতারিত হয়ে কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর থেকেই ফিরে আসতে হয়েছিল তাকে। পরবর্তী সময়ে ২০১৬ সালের শেষদিকে সৌদি আরবে যেতে সক্ষম হন ইমরান হোসেন। এবার সব মিলিয়ে তার খরচ হয় প্রায় ৮ লাখ টাকা। পরিবারের সহায়তায় ওই অর্থ তিনি মোটা সুদে ঋণ হিসেবে সংগ্রহ করেন চৌগাছা পৌরসভার এক এনজিও থেকে। চার বছর ধরে সৌদি আরবে প্রবাস জীবন কাটার পরও এখন পর্যন্ত সে ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে ইমরান হোসেনের পরিবারকে।
ইমরান হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, প্রথমবার যখন মালয়েশিয়া যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন, তখন ব্যাংকঋণের বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা ছিল না। তাই জমি বন্ধক রেখে অর্থ জোগাড় করেছিলেন। তবে পরবর্তী সময়ে সৌদি আরবে যাওয়ার সময় প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। কিন্তু ব্যাংকে জামানত রাখার মতো কোনো সম্পত্তি ছিল না তার। ব্যাংকের কর্মকর্তারাও এ বিষয়ে তথ্য দিয়ে খুব বেশি সহায়তা করেননি সে সময়। বাধ্য হয়েই স্থানীয় একটি এনজিও থেকে ঋণ নিতে হয়েছে। জামানত হিসেবে রাখতে হয়েছে আত্মীয়-স্বজনের সুনাম।
এ প্রবাসী জানান, সৌদি আরবে এ পর্যন্ত তিনবার মালিক পরিবর্তন করতে হয়েছে। আকামা নবায়ন বাবদ প্রতি বছর ২ লাখ টাকার বেশি খরচ করতে হচ্ছে। এ কারণে বাড়িতে খুব বেশি অর্থ পাঠানো সম্ভব হয়নি। তাই এখন পর্যন্ত ঋণের বোঝা বয়ে বেড়াতে হচ্ছে পরিবারকে।
মালয়েশিয়া প্রবাসী শামীম রেজার গল্পও প্রায় একই। তিনি ২০১৭ সালে মালয়েশিয়ায় যান। এজেন্সির মাধ্যমে সব ব্যবস্থা করতে প্রায় ৪ লাখ টাকা খরচ হয় তার। শামীম রেজার অভিবাসন খরচের এ অর্থ জোগান দিয়েছে তার পরিবার ও আত্মীয়স্বজনরা। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, পরিচিত একজনের কাছ থেকে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের টেলিফোন নম্বর পেয়েছিলেন। তথ্য পেতে বেশ কয়েকবার ফোন করলেও কেউ সাড়া দেননি। পরবর্তী সময়ে ঢাকায় এসে ব্যাংকের হেড অফিসে গিয়েছিলেন তিনি। তখন ব্যাংক থেকে তার কাছে জামানতসহ বিভিন্ন তথ্যের অনেক কাগজ জমা দিতে বলা হয়েছিল। এসব জোগাড় হলেও দ্রুত ঋণ পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। তাই ব্যাংকের আশা বাদ দিয়ে পারিবারিক মাধ্যম থেকে অর্থ জোগাড় করেছিলাম।
অভিবাসনের অর্থ জোগান দিতে ব্যাংকের নগণ্য ভূমিকার বিষয়টি উঠে এসেছে সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সমীক্ষাতেও। অভিবাসী কর্মীদের নিয়ে বিবিএসের ‘অভিবাসন ব্যয় জরিপ’ শীর্ষক সমীক্ষায় বলা হয়েছে, বিদেশে যাওয়া ব্যক্তিদের তিন-চতুর্থাংশই ঋণ করেন। এসব ঋণ আত্মীয়স্বজন, এনজিও বা মহাজনদের কাছ থেকে নিয়েছেন। অভিবাসী কর্মীদের জন্য প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক গঠন করা হলেও সেখান থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা খুবই কম। খুব অল্পসংখ্যকই ঋণ পেয়েছেন ব্যাংক থেকে। নারীদের চেয়ে পুরুষরাই বেশি ঋণ নিয়ে বিদেশ গেছেন। ৮১ শতাংশ পুরুষ কর্মী আর ৫৬ শতাংশ নারী কর্মী ঋণ নিয়ে বিদেশে গেছেন।
বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ৪১ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবাসী বন্ধু বা আত্মীয়স্বজন থেকে টাকা নিয়েছেন। আর পরিবারের কাছ থেকে অর্থ পেয়েছেন ২৮ দশমিক ২ শতাংশ, ২০ দশমিক ৫ শতাংশ প্রবাসী এনজিওর কাছ থেকে এবং ১৫ দশমিক ৩ শতাংশ প্রবাসী মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশ গেছেন। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে গিয়েছেন মাত্র ৩ দশমিক ৭ শতাংশ। এছাড়া জমি বিক্রি বা বন্ধক রেখে অর্থ সংগ্রহ করেছেন ১৪ দশমিক ৪ শতাংশ, সমবায় সমিতি থেকে ১ দশমিক ৪ শতাংশ, জমিদারের কাছ থেকে ১ দশমিক ২ শতাংশ এবং অন্যান্য উৎস থেকে ঋণ নিয়ে বিদেশে যান ১ দশমিক ৪ শতাংশ প্রবাসী।
বিশেষায়িত ব্যাংক থাকা সত্ত্বেও ঋণগ্রহীতারা চড়া সুদে অন্য উেসর ঋণে কেন ঝুঁকছে—এমন প্রশ্নের জবাবে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ভারপ্রাপ্ত) মো. এবনুজ জাহান বণিক বার্তাকে বলেন, বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে বিদেশগামীদের জামানত লাগছে না। ঋণ পেতে আগে যেসব জটিলতা ছিল, তা-ও দূর করা হচ্ছে। যার ফলাফল দেখা গেছে গত কয়েক মাসের ঋণ বিতরণের সূচকেই। গত নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংটির ঋণ বিতরণ ছিল ১৪ কোটি টাকা। দুই মাসের ব্যবধানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ কোটি। ঋণগ্রহীতার সংখ্যা বর্তমানে আড়াই হাজারের বেশি। ঋণের জন্য এখন আর হেড অফিসে আসতে হচ্ছে না। শাখাগুলো থেকেই সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হচ্ছে। বর্তমানে ব্যাংকের শাখার সংখ্যা ৭১, যা আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ৮০ ছাড়িয়ে যাবে।
তিনি বলেন, ঋণ বিতরণের নীতিমালা পরিবর্তন করে প্রবাসীবান্ধব করা হচ্ছে। তবে এত বিশালসংখ্যক প্রবাসীর তুলনায় ব্যাংকের সক্ষমতা অনেক কম। বর্তমানে ব্যাংকের স্থায়ী জনবল মাত্র ২৭০ জন। এ কারণে সেবার ব্যাপ্তি বাড়াতে আরো জনবল নিয়োগ দেয়া প্রয়োজন।
সমীক্ষায় উঠে এসেছে, জরিপ চলার সময় পর্যন্ত বিদেশে যাওয়ার জন্য যারা ঋণ করেছিলেন, তাদের মধ্যে প্রায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ পুরুষ কর্মী ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে না পারায় জামানতের মালিকানা হারিয়েছেন। নারীদের মধ্যে জামানতের মালিকানা হারানোর হার ১৬ শতাংশ। সার্বিকভাবে ১২ দশমিক ৭ শতাংশ অভিবাসী ঋণ ফেরত দিতে না পারায় জামানত হারিয়েছেন।
জরিপ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সব মিলিয়ে একজন অভিবাসীর বিদেশ যেতে গড়ে ব্যয় হয়েছে ৪ লাখ ১৬ হাজার ৭৮৯ টাকা। এর মধ্যে নারী কর্মীর গড় অভিবাসন খরচ ১ লাখ ১০২ টাকা, আর পুরুষ কর্মীর অভিবাসীর খরচ ৪ লাখ ৭১ হাজার ৬৬৮ টাকা।
তবে প্রকৃত খরচের সঙ্গে সরকার নির্ধারিত ব্যয়ের কোনো মিল নেই জানিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, সিঙ্গাপুর যেতে সরকার ২ লাখ ৬২ হাজার ২৭০ টাকা বেঁধে দিলেও বাস্তবে ব্যয় হচ্ছে ৫ লাখ ৭৪ হাজার ২৪১ টাকা। সৌদি আরবে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা বেঁধে দেয়া হলেও বাস্তবে ব্যয় হচ্ছে ৪ লাখ ৩৬ হাজার ৩৬৬ টাকা। মালয়েশিয়ায় ১ লাখ ৬০ হাজার টাকার জায়গায় লাগছে ৪ লাখ ৪ হাজার ৪৪৮ টাকা। কাতার যেতে ১ লাখ ৭৮০ টাকা নির্ধারণ করা হলেও বাস্তবে ব্যয় হচ্ছে ৪ লাখ ২ হাজার ৪৭৮ টাকা। ওমান যেতে ১ লাখ ৭৮০ টাকা ব্যয়ের কথা সরকারি হিসাবে থাকলেও বাস্তবে ব্যয় হচ্ছে ৩ লাখ ৮ হাজার ৪৭ টাকা।
উল্লেখ্য, ২০১৫ থেকে ২০১৮ সময়ে যারা অভিবাসী হয়েছেন, তাদের পরিবারের মধ্যেই দৈবচয়নের ভিত্তিতে জরিপটি করে বিবিএস। এজন্য জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) থেকে অভিবাসীদের তথ্যভাণ্ডার সংগ্রহ করা হয়। এ সময়কালে দেশের মোট অভিবাসী কর্মীর সংখ্যা ছিল ২৭ লাখ ৩ হাজার। এর মধ্যে ৮৫ শতাংশ ছিলেন পুরুষ। ৪ লাখ বা ১৫ শতাংশ ছিলেন নারী। এ ক্ষেত্রে দৈবচয়নের ভিত্তিতে উত্তরদাতা ছিল আট হাজার অভিবাসী পরিবার। গত বছরের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ দুই মাস ব্যক্তিগত সাক্ষাত্কার পদ্ধতিতে মাঠপর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করে জরিপটি করেছে বিবিএস।