প্রতি কেজি চালে মিলারদের মুনাফা পাঁচ টাকা

সাইদ শাহীন

দেশে এখন চালের বাজারের বড় প্রভাবক নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে চালকল মালিক বা মিলাররা। চাল প্রক্রিয়াকরণের পর বাজারজাত করার সময় অস্বাভাবিক মুনাফা করছেন তারা। গত বছর বোরো মৌসুমে কেজিপ্রতি চালে তাদের গড় মুনাফার পরিমাণ ছিল প্রায় টাকা ৭০ পয়সা। আমন মৌসুমে তা আরো বেড়ে দাঁড়িয়েছে টাকা ২০ পয়সায়। বাংলাদেশ ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ব্রি) সম্প্রতি গত চার বছরে মিলাররা চাল প্রক্রিয়াকরণ থেকে আহরিত মুনাফা নিয়ে এক গবেষণা চালায়। গবেষণার ফলাফল প্রকাশ হয়েছে অ্যাভেইলেবিলিটি অ্যান্ড প্রাইস ভোলাটিলিটি অব রাইস ইন বাংলাদেশ: অ্যান ইন্টার ইনস্টিটিউশনাল স্টাডি ইন ২০২০ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে। সেখানেই চালের বাজার থেকে মিলারদের বিপুল পরিমাণ মুনাফা তুলে নেয়ার তথ্য উঠে এসেছে।

দেশের কৃষিভিত্তিক ১৪টি জোনের প্রায় ৭০টি চালকলে জরিপের ভিত্তিতে গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করেছে ব্রি। এসব জোনের মধ্যে নওগাঁ, ময়মনসিংহ কুমিল্লায় সরাসরি জরিপ কার্য পরিচালনা করা হয়। বাকিগুলোয় জরিপ চালানো হয় টেলিফোনের মাধ্যমে।

প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালে আমন মৌসুমে মিলারদের প্রতি কেজি চালে মুনাফা ছিল সাড়ে টাকা। পরের বছর তা নেমে আসে টাকা ৪০ পয়সায়। এরপর ২০১৯ সালে টাকা ৬০ পয়সায় নামলেও গত বছর তা আবার টাকা ছাড়িয়ে যায়। গত বছর মিলাররা আমন মৌসুমের চাল প্রক্রিয়াকরণ থেকে মুনাফা তুলে নিয়েছে কেজিতে টাকা ২০ পয়সা করে। অন্যদিকে বোরো মৌসুমে ২০১৭ সালে প্রতি কেজি চালে মিলারদের মুনাফা হয়েছে টাকা ৯০ পয়সা। এরপর বোরো মৌসুমের চালে মিলারদের ২০১৮ সালে মুনাফা হয়েছে টাকা ২০ পয়সা, ২০১৯ সালে টাকা ৩০ পয়সা ২০২০ সালে মুনাফা হয়েছে টাকা ৭০ পয়সা।

গবেষকদের ভাষ্য হলো, চাল প্রক্রিয়াকরণের ক্ষেত্রে ধানের সর্বোচ্চ সর্বনিম্ন দাম বিবেচনায় নিয়েই গড় মুনাফা হিসাব করা হয়েছে। গত বছর ধানের কিছুটা দাম বৃদ্ধি, বিদ্যুৎ বিল, যানবাহন শ্রমিক খরচ বাড়ার কারণে বছর মিলিং খরচ কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। খরচ বৃদ্ধির ফলে মিলারদের মুনাফা কিছুটা কমছে। তবে যে মুনাফা হচ্ছে, সেটিও অস্বাভাবিক।

ধান চালের বাজারে স্টেকহোল্ডারদের মধ্যে চালকল মালিকদের প্রভাবই সবচেয়ে বেশি বলে প্রতিবেদনে উঠে আসে। এতে দেখা যায়, বাজার নিয়ন্ত্রণে মিলারদের ভূমিকা প্রায় ৩৩ শতাংশ। অন্যদিকে পাইকার খুচরা ব্যবসায়ীদের ভূমিকা যথাক্রমে ২৯ ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে ভোক্তা কৃষকদের ভূমিকা মাত্র ১০ শতাংশ। বাজারে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণের সুবাদে মিলাররা সেখান থেকে অস্বাভাবিক মুনাফা তুলে নিতে পারছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একচ্ছত্র আধিপত্য থাকার কারণে মিলারদের মধ্যে এক ধরনের বাজার নিয়ন্ত্রণমূলক আচরণ দেখা যায়। তার প্রমাণও ব্রি-এর সমীক্ষায় দৃশ্যমান হয়েছে। তারা এমনকি প্রকাশ্যেই সরকারের সংগ্রহ মৌসুমে চাল কেনার চুক্তিতে না যাওয়ারও ঘোষণা দিয়েছেন। অন্যদিকে কৃষকরা মৌসুমের শুরুতেই ধান বিক্রির চাপে থাকেন। ধার দেনা পরিশোধের চাপ থাকে বিধায় মৌসুমের শুরুতে কম দামে ধান বিক্রি করে দিচ্ছেন কৃষকরা, যার সুযোগ নিচ্ছে মিলার ফড়িয়ারা। মিলারদের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, তারা বাজার থেকে সবচেয়ে কম দামে ধান ক্রয় করতে পারে। পরবর্তী সময়ে ধান প্রক্রিয়া করে মিলাররা বিক্রি করছে বাজারে বা সরকারের কাছে। সেখান থেকেই অপ্রত্যাশিত মুনাফা করছে মিলাররা। পরিস্থিতিতে চাল ধানের বাজার সহনীয় রাখতে কার্যকর উদ্যোগ প্রয়োজন রয়েছে। সেখানে সরকারের মজুদ সক্ষমতা বাড়ানো, কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান কেনার প্রচলন করতে হবে। পাশাপাশি চিকন মোটা দানার চালের জন্য সরকারের পৃথক ন্যূনতম সহায়তা মূল্য (এমএসপি) ঘোষণা করা প্রয়োজন। তাছাড়া সরকারেরও মোট উৎপাদনের প্রায় ১০ শতাংশ সংগ্রহের সক্ষমতা অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে।

বাজারে মিলারদের নিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকার বিষয়টি সরকারের নীতিনির্ধারকরাও স্বীকার করে নিয়েছেন। গতকাল ব্রি-এর গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে কৃষিমন্ত্রী . মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, তিনটি কারণে এবার মিলাররা চরম সুযোগ নিয়েছে। লাগাতার বন্যার কারণে আউশ আমনে চালের উৎপাদন কম হয়েছে। সরকারিভাবে ধান-চাল সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এর পাশাপাশি সরকারি খাদ্যগুদামে পর্যাপ্ত মজুদ না থাকায় মিল মালিক পাইকাররা সুযোগ নিয়েছে। এজন্য তারাই বাজারের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে। তবে এটি ভবিষ্যতে যাতে না হয়, সেজন্য আগামী বোরো মৌসুমে ধান চাল কেনার লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সব ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে। চাল কিনে সরকারি মজুদ বাড়ানো হবে, যাতে বাজার সরকারের নিয়ন্ত্রণে থাকে।

প্রতিবেদনের তথ্যমতে, প্রতি কেজি চাল উৎপাদনে বোরো মৌসুমের তুলনায় আমন মৌসুমে বেশি মুনাফা করছে মিলাররা। তবে মিলারদের মুনাফা গত কয়েক বছরে কিছুটা কমেছে। মিলারদের চাল প্রক্রিয়াকরণ থেকে বড় পরিমাণে মুনাফা তুলে নেয়ায় সহায়ক ভূমিকা রাখছে চালের বাইপ্রোডাক্ট বা উপজাত দ্রব্য। এগুলোর মধ্যে চালের কুঁড়া, রাইস ব্র্যান, তুষ, কালো চাল অন্যান্য দ্রব্য রয়েছে। গত দুই বছরে এসব উপজাত দ্রব্য থেকেও মুনাফা করেছে মিলাররা। অন্যদিকে এর আগের দুই বছরে তারা মুনাফা করেছে এসব উপজাত দ্রব্য ছাড়াই।

সার্বিক বিষয় নিয়ে ব্রি-এর মহাপরিচালক . মো. শাহজাহান কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, মিলাররা তাদের মুনাফা দেখানোর সময় এক ধরনের চালাকির আশ্রয় নিয়ে থাকে। অনেক সময় উপজাত দ্রব্য ভালো দামে বিক্রি করলেও সেটির হিসাব না দেখিয়ে বলে থাকে তাদের মুনাফা হচ্ছে না। এভাবে সরকারের কাছ থেকে বাড়তি সুবিধা আদায়ের চেষ্টা করে তারা। তাই মিলারদের কার্যকর উৎপাদন খরচ মুনাফা নির্ণয় করা হয়েছে গবেষণায়। সরকারের কাছে ন্যূনতম সাড়ে ১২ লাখ টন চালের মজুদ থাকলে মিলারদের বাজার নিয়ন্ত্রণের সুযোগ কমে আসবে। এজন্য ধান চাল সংগ্রহ পদ্ধতির আধুনিকায়ন করতে হবে। কৃষকের কাছ থেকে সরাসরি ধান সংগ্রহ করতে হবে। কৃষক ভোক্তা উভয়ের স্বার্থকেই গুরুত্ব দিতে হবে। দুয়ের মধ্যে সমন্বয় করেই নীতি-সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেখানে মধ্যস্বত্বভোগীদের যৌক্তিক আচরণ নির্ধারণে তদারকি আরো বাড়াতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন