আলোকপাত

বাজারে অতিরিক্ত তারল্য ও মূল্যস্ফীতির শঙ্কা

ড. আর এম দেবনাথ

সব ব্যবসার মতো ব্যাংক ব্যবসায়ও টাকার জোয়ার-ভাটা আছে। মুহূর্তে ব্যাংকগুলোতে টাকার প্রবাহে জোয়ার দৃশ্যমান। অথচ কিছুদিন আগেও ব্যাংকে আমানতের ছিল হাহাকার। ব্যাংকের ভাষায় বলা হয় লিকুইডিটি বা তারল্য সংকট। এখন ব্যাংকগুলো আর লিকুইডিটি সংকটে নেই। বরং উল্টো অবস্থা। তারা লিকুইডিটিতে বা ক্যাশে ভাসছে। এটা হরহামেশাই ব্যাংক খাতে ঘটে। যারা বুদ্ধিমান তারা সময়ে আমানতকারীদের হতাশ না করে তার টাকা আমানত হিসেবে নেয়। এতে ফান্ড প্রবাহে স্থিতিশীলতা রক্ষিত হয়। হয়তো খরচ সামান্য বাড়ে। আবার অ্যাগ্রেসিভ ব্যাংকাররা আমানতকারীদের দুর্দিনে পাশে থাকে না। তারা আমানত গ্রহণ করে না। কারণ মুহূর্তে তাদের ফান্ডের দরকার নেই। এতে অনেক সময় দুর্দিনে টাকা পাওয়া যায় না। এখন টাকার প্রবাহ প্রবল। ব্যাংকগুলো যেমন দিশেহারা তেমনই দিশেহারা আমানতকারীরা। আমানতের ওপর কোনো সুদ নেই, যা আছে তা মূল্যস্ফীতি হারের অনেক নিচে। কেন? ভাবা যায় ২০২০ সালের শেষে ব্যাংক খাতে অতিরিক্ত তারল্য বা অ্যাকসেস লিকুইডিটি পরিমাণ ছিল লাখ কোটি টাকার ওপর। অর্থনৈতিক একটা কাগজের সাম্প্রতিক খবরে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের শুরুতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল মাত্র লাখ কোটি টাকার কিছু ওপরে। শুধু অতিরিক্ত তারল্য নয়, ব্যাংকগুলো কর্তৃক বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ টাকা জমার (ক্যাশ রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট বা সিআরআর) পরিমাণও ছিল প্রয়োজনের তুলনায় অনেক বেশি। ২০২০ সালের সে অতিরিক্ত সিআরআরের পরিমাণ ছিল প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা। রকম অবস্থায় ব্যাংকগুলো উপায়ান্তর না দেখে সরকারি বিল বন্ডে অল্প সুদে টাকা বিনিয়োগ করছে বলে খবরে প্রকাশ। কেউ কেউ নাকি শেয়ারবাজারেও যাচ্ছে। মুশকিল হচ্ছে ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্যের টাকা শেয়ারবাজারে গিয়ে যদি সেখানে অতিরিক্ত তারল্যের সৃষ্টি করে তাহলে শেয়ারবাজারে বুদবুদের সৃষ্টি হবে। এরই মধ্যে অপ্রদর্শিত কিছু টাকা সেখানে ঢুকেছে। উপায়ান্তর না দেখে অনেকে শেয়ারবাজারে ফিরে যাওয়ার প্রবণতা দেখাচ্ছেন। করিত্কর্মারাও যে খুবই তত্পর তা কোম্পানিবিশেষে দর বৃদ্ধির তথ্য থেকে কিছুটা বোঝা যায়। এদিকে রিয়েল এস্টেট বাজারও আবার গরম হয় হয় অবস্থা। সরকার রেজিস্ট্রেশন কস্ট হ্রাস করেছে। আবার জমি-বাড়ি-ফ্ল্যাটে অপ্রদর্শিত টাকা স্বল্প আয়করে ঘোষণা করার সুযোগও দেয়া হয়েছে। এতে বাজারে যে ক্যাশ আছে, লিকুইডিটি আছে তা ওইদিকেও ধাবিত হওয়ার উপক্রম হয়েছে। এসবই ঘটছে সার্বিক ব্যবসায়িক মন্দার মধ্যে। কভিড-১৯ এর দ্বিতীয় আক্রমণের মধ্যে।

প্রশ্ন, হঠাৎ করে এত টাকা বাজারে কোত্থেকে এল? হঠাৎ করে নয়, এটা ধীরে ধীরেই ঘটছে। করোনার শুরু থেকেই বাজারে অতিরিক্ত তারল্য বিদ্যমান ছিল। ২০১৭ সাল থেকে এর পরিমাণ ছিল ৮৬ হাজার কোটি টাকার ওপরে। ঋণপ্রবাহে তখনো মন্দা, আজও তেমনি মন্দা। ২০২০-এর নভেম্বরে ২০১৯-এর একই সময়ের তুলনায় ঋণের প্রবাহ বেড়েছে মাত্র দশমিক ২১ শতাংশ। এটা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় প্রায় অর্ধেক। এর অর্থ ঋণের চাহিদা কম। এর প্রভাব পড়েছে অতিরিক্ত তারল্যে। এদিকে রেমিট্যান্সের প্রবাহেও জোয়ার। এর অনেক কারণ দেখানো হয়। যে কারণেই হোক হিসাবে দেখা যাচ্ছে ২০২০ সালের জুলাই-নভেম্বরের মধ্যে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৪২ শতাংশ। রেমিট্যান্স মানেই তা পাবে প্রেরকদের পরিবার। ডলার রূপান্তরিত হয়ে টাকা হবে। ব্যাংকে ঢুকবে। তৃতীয় উৎস মনে হয় মধ্যবিত্ত উচ্চ মধ্যবিত্তের ব্যয় হ্রাস। দেশে দুই পদের লোক আছে। নিম্নমধ্যবিত্ত, গরিব শ্রমজীবী মানুষ। তারা সঞ্চয় ভেঙে খেয়েছে এক বছর। চাকরিচ্যুতরাও তা- করেছে। কিন্তু যাদের আয়ে ঘাটতি হয়নি, যারা চিকিৎসা উপকরণের ব্যবসা করে, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ব্যবসা করে, যারা স্থায়ী চাকরি করে বা সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী তাদের আয় ঠিকই আছে। অথচ তাদের সচ্ছল অংশের খরচ অনেক কম। তারা এখন দেশে-বিদেশে আগের মতো স্বাধীনভাবে বেড়াতে পারে না। হোটেল, রেস্তোরাঁ খরচ খুবই কম। আপ্যায়ন-সামাজিকতার খরচ কম, বিলাস পণ্য ক্রয়ে ধীরগতি তাদের, ছেলেমেয়েদের খাতে খরচ কম। এসব কারণে তাদের ব্যয় বাজেট এখন সংকুচিত অথচ আয়ে ঘাটতি নেই। এসব টাকা ব্যাংকে-ক্যাশে থাকার কথা। বড় কারণ আরেকটা। সরকার নানাভাবে বাজারে প্রচুর ক্যাশ বা লিকুইডিটি জোগান দিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকও তা-ই। ব্যবসা-বাণিজ্য অর্থনীতি সচল রাখার জন্য, আমদানি রফতানি সচল রাখার জন্য সরকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক উদারভাবে বাজারে লিকুইডিটি সরবরাহ করছে। এর পরিমাণ লক্ষাধিক কোটি টাকা। এটা প্রণোদনার টাকা। পাওয়ার কথা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা কিন্তু পাচ্ছে সবাইযারা পাওয়ার উপযুক্ত তারাও পাচ্ছে, যারা উপযুক্ত নয় তারাও পাচ্ছে। এসব বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ঋণের টাকা; ব্যাংকঋণের টাকা। এখানে একটা মজা আছে। ব্যাংক নগদে বা ক্যাশে কাউকে ঋণের টাকা দেয় না। ঋণের টাকার জন্য ব্যবসায়ীদের নামে ব্যবসার নামে নানা ধরনের ঋণ হিসাব (লোন অ্যাকাউন্ট) আছে। ঋণের টাকা ব্যাংক ওই সব হিসাবে ক্রেডিট করে দেয়। ব্যবসায়ীরা চেকের মাধ্যমে ওখান থেকে টাকা তোলেন। প্রক্রিয়াকে বলে আমানত ঋণ সৃষ্টি করে, আবার ঋণ আমানত সৃষ্টি করে। এভাবেও প্রচুর টাকার আমানত বাড়ে। বলা বাহুল্য প্রণোদনার টাকা বাদেও ব্যাংকের নিয়মিত ঋণ আছে। সেখান থেকেও আমানতের সৃষ্টি হয়। এসব কারণে বাজারে অতিরিক্ত তারল্যের সৃষ্টি হয়েছে, বিশেষ করে যখন লক্ষ্যমাত্রামাফিক ঋণ প্রবাহ বাড়ছে না। ব্যবসায়ীরা নতুন শিল্প উদ্যোগ গ্রহণ করছেন না। স্বাভাবিক বৃদ্ধিও ব্যবসায় ঘটছে না। আমদানির জন্য ঋণপত্র কম। মূলধনি যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল মধ্যবর্তী পণ্যের আমদানি অনেক হ্রাস পেয়েছে। রফতানির বাজারেও কোনো ঢেউ নেই। সর্বোপরি রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের উল্লম্ফন।

অতিরিক্ত তারল্যের দোষগুণ কী? হাতে বেশি টাকা থাকলে ব্যক্তির মাথা গরম থাকে, ব্যবসায়ীর মাথাও গরম থাকে। যাচ্ছেতাই করার প্রবণতা বাড়ে। অর্থনীতির ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তারল্যে শেয়ারবাজার, সম্পত্তির বাজারে সাধারণভাবে বুদবুদের সৃষ্টি হয়। শতাব্দীর শুরুর দিকে এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। তখন ব্যাংক আমানতের ১০ শতাংশ টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করতে পারত। ওই নিয়ম ছিল ভুল, আসলে হবে পুঁজির ১০ শতাংশ। পরে তা- হয়েছে, সর্বনাশের পর। কী সর্বনাশ ব্যাংকগুলো তাদের টাকা নিয়ে যায় শেয়ারবাজারে। চাহিদা বেড়ে যায় অথচ ভালো শেয়ারের সরবরাহ কম। ফলে বাজারে সৃষ্টি হয় বুদবুদ। একশ্রেণীর লোক সর্বস্বান্ত হয়, আরেক শ্রেণী প্রচুর টাকা বানায়। তারা ওই টাকা নিয়ে যায় ফ্ল্যাট জমির বাজারে। ফলে ফ্ল্যাট জমির দাম বাড়ে মারাত্মক উচ্চহারে। এখনো তার রেশ চলছে। অতিরিক্ত তারল্যের হচ্ছে একটা পরিণতি। সবকিছু মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে চলে যায়। বর্তমান অবস্থায় বিনিয়োগের কোনো ব্যবস্থা নেই। যারা সঞ্চয়কারী তাদের বিনিয়োগ করার কোনো উপযুক্ত মাধ্যম নেই। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করা এখন খুবই কঠিন। ঊর্ধ্বতম সীমা এখন জনপ্রতি মাত্র ৫০ লাখ টাকা। সব সঞ্চয়পত্র মিলে ৫০ লাখ। আগে তা ছিল এক কোটিরও ওপর। এতে সুদের হার কমানো হয়েছে। সুদের ওপর কর বসানো হয়েছে। উপযুক্ত করদাতা না হলে কেউ সঞ্চয়পত্র কিনতে পারে না। অর্থাৎ এখানে সঞ্চয় করা টাকা বিনিয়োগ করা হচ্ছে নিরুৎসাহিত। ব্যাংকে সব ব্যাংকে এখন আমানতের ওপর সর্বোচ্চ সুদ মাত্র শতাংশ, বস্তুত মূল্যস্ফীতির নিচে। কিন্তু ব্যাংক শতাংশ ঋণ দেয় না। সঞ্চয় হিসাবে বলতে গেলে উল্টো। আমানতকারীদের চার্জ দিতে হয় সুদ তো দূরের কথা। অতিরিক্ত তারল্যের আগেই ছিল বিধ্বস্ত অবস্থা। এখন সুদের হার আরো কম। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে শেষ পর্যন্ত তা শূন্য সুদে যেতে পারে। ব্যাংক প্রণোদনার ঋণ দেয় এখন সাড়ে চার শতাংশ সুদে, যা ঋণগ্রহীতার কাছ থেকে আদায় করা হয়। বাকি সাড়ে শতাংশ দেবে সরকার ভর্তুকি হিসেবে। একটি কাগজে দেখলাম সরকারের ওই ভর্তুকি টাকা পাওয়া যাবে ঋণের টাকা আদায়ের পর। কথা সত্য হলে ভর্তুকির টাকা পাওয়া ব্যাংকের জন্য হবে এক কঠিন কাজ। এমনিতে সাধারণ ঋণের টাকা, সুদের টাকা আদায় হয় না। বাকি রয়েছে প্রণোদনার টাকার সুদ আদায়! কঠিন, কঠিন এক বিষয়। মারাত্মক ধারণা, অনেক ব্যবসায়ী মনে করেন প্রণোদনার টাকা আর ফেরত দিতে হবে না। ধারণা সর্বব্যাপী হলে ব্যাংকের জন্য হবে বিপদ। ব্যাংকের জন্য ভবিষ্যতে যাই হোক না কেন মুহূর্তে অতিরিক্ত তারল্যের চরম শিকার আমানতকারীরা। এদিকে পত্রিকান্তরে প্রকাশিত একটি খবরে দেখলাম ব্যাংকগুলো চোরাগোপ্তা পথে শতাংশ সুদ বাদে প্রায় ৪৪ ধরনের চার্জ আদায় করছে। সেটা হতে পারে। ব্যাংক সব সময় এসব পথ খোঁজে। কিন্তু এর সুবিধা আমানতকারীরা কখনো পায়নি, এখনো পাবে না।

অতিরিক্ত তারল্যে বাজারের স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়, মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ সৃষ্টি করে। এর লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। পৌষ সংক্রান্তি গেছে ১০-১২ দিন।

নতুন চালের পিঠা খাওয়ার দিন, আনন্দ-ফুর্তির দিন। ধান হয়েছে আশাপ্রদভাবে। কিন্তু ধান চালের দাম বাড়তির দিকে। সরকার চাল আমদানি করছে, তবু এর দামে কোনো ইতরবিশেষ নেই। সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল ইত্যাদির দাম বেড়েছে। শাকসবজির বাজার ভরপুর। দোকানের মাল দেখলে প্রাণ ভরে যায়। কিন্তু এসবের মূল্য কমার লক্ষণ নেই। প্রচুর মাছ বাজারে। কিন্তু মূল্য তো উঁচুতেই রয়েছে। এসব কিসের লক্ষণ? বাংলাদেশ ব্যাংকের বার্ষিক রিপোর্ট ২০১৯-২০ বিশ্বাস করলে বলতে হয় এসব মূল্যস্ফীতির আলামত। বার্ষিক রিপোর্ট বলছে, বিশ্ব অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে আরো সময় লাগবে। সর্বত্র মন্দা চলছে। মন্দা আমাদেরও। উন্নত বিশ্বের মন্দা না কাটলে আমাদের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাকের রফতানি বাড়বে না। কভিড-১৯-এর আক্রমণ থেকে আমরা এখনো মুক্ত নই। একটা আশার আলো দেখা যাচ্ছে। ভারত থেকে শুভেচ্ছাস্বরূপ আমরা করোনার ২০ লাখ টিকা পেয়েছি। আরো টিকা আগামী মাস থেকে নিয়মিত আসতে থাকবে। এতে মানুষের মনে কিছুটা সাহস ফিরে এসেছে। এর প্রভাব নিশ্চিতভাবেই অর্থনীতির ওপর পড়বে। এসব হিসাবে রেখেও বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, মূল্যস্ফীতি বছর শেষে শতাংশে পৌঁছতে পারে। এটা মোটেই ভালো খবর নয়। অতিরিক্ত তারল্য যদি মূল্যস্ফীতির হার বৃদ্ধি করে তাহলে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ মূল্যস্ফীতি সাধারণ মানুষের শত্রু। এটা টাকার ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস করে। একই পরিমাণ টাকা দিয়ে কিনতে হবে কম পরিমাণ পণ্য-দ্রব্যাদি-সেবা। অতএব একটা পদক্ষেপ জরুরি হয়ে পড়েছে এবং তা হচ্ছে ঋণের টাকার সদ্ব্যবহার এবং ৮০ লাখ ছোট ছোট প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত ঋণ সরবরাহ করা।

 

. আর এম দেবনাথ: সাবেক শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন