বেসিক ব্যাংকের আর্থিক ক্ষতি দিয়ে হতে পারত মেগা প্রকল্প

হাছান আদনান

গত আট বছরে কার্যক্রম পরিচালনা করতে গিয়ে ১৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি প্রত্যক্ষ আর্থিক ক্ষতির শিকার হয়েছে রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ব্যাংক। পরিমাণ অর্থ দিয়ে বাস্তবায়ন করা যেত কর্ণফুলী টানেল বা পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো আরো একটি মেগা প্রকল্প।

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে নির্মাণ হচ্ছে প্রায় সাড়ে কিলোমিটার দীর্ঘ বঙ্গবন্ধু টানেল। দেশের প্রথম টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। পটুয়াখালীর পায়রায় ১২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকায় নির্মাণ করা হয়েছে হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার তাপবিদ্যুৎকেন্দ্র। ৯৩০ মিটার দ্বিতীয় দীর্ঘ মেঘনা সেতুর নির্মাণে হাজার ৭৫০ কোটি এবং হাজার ৪১০ মিটারের গোমতী সেতুর নির্মাণ ব্যয় হয়েছে হাজার ৯৫০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পের কোনোটিরই ব্যয় বেসিক ব্যাংকের গত আট বছরের আর্থিক ক্ষতির সমান নয়।

মুজিব বর্ষ উপলক্ষে গৃহহীন মানুষকে ঘর দিচ্ছে সরকার। প্রতিটি ঘর নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে লাখ ৭৫ হাজার টাকা। সরকার থেকে এখন পর্যন্ত ঘর পেয়েছে প্রায় ৭০ হাজার পরিবার। সে হিসাবে বেসিক ব্যাংকের ক্ষতি হওয়া অর্থ দিয়ে আট লাখেরও বেশি গৃহহীন পরিবারকে ঘর করে দেয়া যেত।

গত আট বছরে বেসিক ব্যাংক নিট লোকসান দিয়েছে হাজার ৭৪০ কোটি টাকা। সময়ে ব্যাংকটিকে বাঁচিয়ে রাখতে রাজস্ব থেকে হাজার ৩৯০ কোটি টাকা জোগান দিয়েছে সরকার। তার পরও বর্তমানে হাজার ৮০০ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতিতে রয়েছে ব্যাংকটি। পাশাপাশি হাজার ২৩৩ কোটি টাকা সঞ্চিতি ঘাটতিও রয়েছে বেসিক ব্যাংকের। সব মিলিয়ে ঋণ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে বের হয়ে যাওয়া অর্থ বাদ দিয়েই গত আট বছরে বেসিক ব্যাংকের প্রত্যক্ষ ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১৪ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঋণ কেলেঙ্কারির পর বেসিক ব্যাংক বন্ধ করে দিলে পরিমাণ অর্থ বাঁচানো যেত। শুধু তা- নয়, বর্তমানে নতুন একটি ব্যাংকের লাইসেন্স নিতে হলে দরকার হচ্ছে ৫০০ কোটি টাকার মূলধন। গত আট বছরে কার্যক্রম পরিচালনা করতে বেসিক ব্যাংকের যে পরিমাণ অর্থ অপচয় হয়েছে, তা দিয়ে অন্তত ২৮টি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স হতে পারত।

বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের খেলাপি ঋণের পরিমাণ হাজার ৬০৭ কোটি টাকা। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫২ শতাংশই খেলাপি, যা মন্দমানের হওয়ায় আদায়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ।  হিসাববিদরা বলছেন, রাষ্ট্রায়ত্ত খাতের সেরা ব্যাংকটি সঠিকভাবে পরিচালিত হলে প্রতি বছরই বড় অংকের অর্থ মুনাফা করতে পারত। কিন্তু সঠিক পথে না থাকায় যে পরিমাণ মুনাফা থেকে বঞ্চিত হতে হয়েছে তা হিসাবে নিলে গত আট বছরে বেসিক ব্যাংকের প্রত্যক্ষ পরোক্ষ ক্ষতির পরিমাণ কোনোভাবেই ৩০ হাজার কোটি টাকার কম নয়। পরিমাণ অর্থ দিয়েও নির্মাণ করা যেত পদ্মা সেতুর মতো আরেকটি মেগা প্রকল্প।

বাংলাদেশ স্মল ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যান্ড কমার্স (বেসিক) ব্যাংক লিমিটেডের যাত্রা ১৯৮৯ সালে। প্রতিষ্ঠার পরের দুই দশক দেশের সেরা ব্যাংক হিসেবেই বিকাশ হয়েছিল বেসিক ব্যাংকের। ২০০৯ সাল পর্যন্ত বেসিক ব্যাংককে তুলনা করা হতো বৈশ্বিক জায়ান্ট স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ডের সঙ্গে। এরপর অনিয়ম-দুর্নীতি লুণ্ঠনের ভারে বিধ্বস্ত হয়ে দেউলিয়া হওয়ার দুয়ারে দাঁড়িয়েছে বেসিক ব্যাংক।

বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আলাউদ্দিন মাজিদের ভাষ্য, ২০০৯ সাল-পরবর্তী সময়ে বেসিক ব্যাংকে যা হয়েছে, সেটিকে ব্যাংকিং বলা যায় না। ২০১৪ সাল থেকে টানা ছয় বছর আমি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি। নিজের দীর্ঘ ব্যাংকিং জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বেসিক ব্যাংককে টেনে তোলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু উল্লেখ করার মতো ব্যাংকটির কোনো উন্নতি হয়নি।

আলাউদ্দিন মাজিদ বলেন, বেসিক ব্যাংকের ২০১৩ সাল-পরবর্তী ক্ষতি হিসাব করতে হলে আট বছরের নিট লোকসান, সঞ্চিতি মূলধন ঘাটতি এবং সরকার থেকে জোগান দেয়া অর্থ যোগ করতে হয়। এসব হিসাব করলে ঋণ কেলেঙ্কারির অর্থ বাদ দিয়েও বেসিক ব্যাংকের ক্ষতি বিশাল অংকের। সরকার মূলধন হিসেবে যে অর্থের জোগান দিয়েছে, তা দিয়ে সিআরআর এসএলআর সংরক্ষণ করতে হয়েছে। অর্থ না পেলে পরিস্থিতি আরো খারাপ হতো। ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের অর্ধেক বর্তমানে খেলাপি। তার পরিমাণও সাড়ে হাজার কোটি টাকার বেশি। সব মিলিয়ে বেসিক ব্যাংকের ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করা কঠিন।

বেসিক ব্যাংকের মোট দায়ের পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে ১৪ হাজার কোটি টাকা হলো গ্রাহকদের আমানত। তবে বেসিক ব্যাংকের আমানতের সিংহভাগই হলো সরকারি। ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের পরিমাণ প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা। ঋণের মধ্যে হাজার ৬০৭ কোটি টাকা খেলাপি, যা ব্যাংকটির বিতরণকৃত ঋণের ৫২ শতাংশ। আমানতের অর্থ থেকে যেকোনো ব্যাংক ঋণ বিতরণ করে। বেসিক ব্যাংকের বিতরণকৃত ঋণের ৫২ শতাংশ খেলাপি হওয়ায় গ্রাহকদের আমানত পরিশোধ করার সক্ষমতা বর্তমানে ব্যাংকটির নেই।

পরিস্থিতি ভালো নেই বলে মনে করেন বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক রফিকুল আলমও। ২০১৯ সালের জুন থেকে ব্যাংকটির শীর্ষ নির্বাহী পদে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, বেসিক ব্যাংকের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। আমি দায়িত্ব গ্রহণের সময় ব্যাংকটির ঋণ-আমানত অনুপাত (এডি রেশিও) ছিল ১১৫ শতাংশ। যেখানে এডি রেশিও থাকার কথা ছিল ৮৫ শতাংশের নিচে। দায়িত্ব পালনের সময়টুকুতে চেষ্টা করেছি ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে। কিন্তু রকম খারাপ পরিস্থিতিতে থাকা একটি ব্যাংককে টেনে তোলা খুবই কঠিন। বর্তমানে এডি রেশিও ১০৪ শতাংশে নেমে এসেছে। তবে বেসিক ব্যাংক মুনাফায় আসতে আরো সময় লাগবে।

সরকারি ব্যবস্থাপনায়ও বাণিজ্যিক ব্যাংক ভালো করতে পারে, এর উদাহরণ ছিল বেসিক ব্যাংক। কিন্তু ২০১০ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে চরম অনিয়ম-দুর্নীতির শিকার হয়েছে ব্যাংকটি। এর পর থেকে শুরু হয় ব্যাংকটির বিপর্যয়। ২০০৯ সালের ডিসেম্বর শেষেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল বিতরণকৃত ঋণের মাত্র শতাংশ। এর পর থেকে দ্রুতই অবনমন ঘটতে থাকে বেসিক ব্যাংকের। ঋণ কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে বাড়তে থাকে খেলাপি ঋণ। এর বিপরীতে কমতে থাকে মুনাফার অংক। ২০১৩ সালে এসে প্রথমবারের মতো লোকসানে পড়ে ব্যাংকটি। এরপর লোকসানের পাল্লা কেবল ভারীই হয়েছে বেসিক ব্যাংকের।

বেসিক ব্যাংকের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০০৯ সালেও রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটি প্রায় ৬৫ কোটি টাকা নিট মুনাফা করে। পরবর্তী সময়ে তা কমে ২০১২ সালে কোটি ৭৮ লাখ টাকায় দাঁড়ায়। পরের বছরই ৫৩ কোটি টাকা লোকসান করে ব্যাংকটি। ২০১৪ সালে লোকসানের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১১১ কোটি টাকা। ২০১৫ সালে ব্যাংকটির লোকসান বেড়ে হয় ৩১৮ কোটি টাকা। অতীতের অনিয়মে অনিবার্য ফল হিসেবে চূড়ান্ত ধাক্কা লাগে বেসিক ব্যাংকের ২০১৬ সালের নিট মুনাফায়। বছরটিতে ব্যাংকটির লোকসান দাঁড়ায় হাজার ৪৯৩ কোটি টাকায়। এরপর ২০১৭ সালে ৬৮৪ কোটি টাকা নিট লোকসান দিয়েছে বেসিক ব্যাংক। ২০১৮ সালেও ৩৫৪ কোটি টাকা লোকসান দিয়েছে ব্যাংকটি। ২০১৯ সালে ৩২৭ কোটি টাকা নিট লোকসান গোনার পর ২০২০ সালেও প্রায় ৪০০ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে বেসিক ব্যাংকের।

সারা দেশে ৬৮টি শাখা প্রায় দুই হাজার জনবল নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছে বেসিক ব্যাংক। কর্মীদের বেতন-ভাতাসহ অন্যান্য পরিচালন ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়েই ব্যাংকটি লোকসানের ফাঁদে আটকা পড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বেসিক ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনা করলেই ক্ষতের পরিমাণ বাড়তে থাকবে। অর্থের অপচয় এড়াতে হলে ব্যাংকটিকে নিয়ে সরকারকে কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এক্ষেত্রে বেসিক ব্যাংকের অবসায়নই হবে সর্বোত্তম পথ। বেসিক ব্যাংকের জনবলকে রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী রূপালী ব্যাংকের শূন্য পদের বিপরীতে নিয়োগ দেয়া যায়। পাশাপাশি ব্যাংকটির ভালো গ্রাহকদের স্বাধীনভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত অন্য ব্যাংকের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে যাওয়ার সুযোগ করে দেয়া দরকার। খেলাপি হয়ে যাওয়া ঋণ সরকার গঠিত অ্যাসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানির আওতায় নিয়ে আদায়ের প্রক্রিয়া চলমান রাখলে ক্ষতির পরিমাণ কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন