সময়ের ভাবনা

বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার প্রতিরোধ ও কাস্টমস

ড. মইনুল খান

অর্থ পাচার নিয়ে গণমাধ্যমে সাম্প্রতিক আলোচনা ও এ-সংক্রান্ত উত্তাপ একটা ইতিবাচক ফল আনতে পেরেছে এবং তা হলো বিদেশে অর্থ পাচার সামাজিকভাবে অনেকটা গর্হিত ও নিন্দিত। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার হয়, এটি এখন স্বীকৃত সত্য। অর্থ পাচার হলে দেশের ক্ষতি কী—এমন প্রশ্নের জবাব অনেকটা সহজ। আমরা আরো জানি, যেসব অর্থ পাচার হয় তার অধিকাংশ অবৈধ পথে উপার্জিত অথবা অপরাধের উত্স থেকে অর্জিত। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুসারে, বৈধভাবে উপার্জিত টাকাও অবৈধ পথে বিদেশে নিলে তা অর্থ পাচার। এ টাকা দেশে থাকলে তা বিনিয়োগ ও ভোগে ব্যবহূত হতো এবং কর্মসংস্থান ও উন্নয়নে ভূমিকা রাখত। পাচারের ফলে মুদ্রাবাজারে ভারসাম্য ও প্রতিযোগিতার পরিবেশ নষ্ট হচ্ছে। সার্বিকভাবে দেশ ও জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে। আর পাচারের সুযোগ সীমিত হলে বিভিন্ন ধরনের অপরাধের মাত্রাও (উত্সমুখ) নিয়ন্ত্রিত হতো। কেননা যেকোনো অপরাধের পেছনে থাকে অর্থ; আর এ অবৈধ অর্থের ব্যবহার মনিটর বা চাপে থাকলে ওই অপরাধে কেউ জড়িত হওয়া থেকে বিরত থাকবে। তাই অর্থনৈতিক দিক ছাড়াও সুশাসনের দৃষ্টিতে অর্থ পাচারের পথ রুদ্ধ হওয়ার তাগিদ রয়েছে। 

অর্থ পাচার প্রতিরোধে সরকারের যথেষ্ট নজর রয়েছে। বিভিন্ন সংস্থা এ নিয়ে কাজও করছে। তবে এ পাচারের অংকটা কী? কীভাবে এসব অর্থ পাচার ঘটে? কোন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়? কোথায় জোর দিয়ে কাজ করতে হবে? এসব প্রশ্নের উত্তর সন্ধান করা দায়িত্বরতদের জন্য অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থ পাচারের অংকটির হিসাব নিয়ে এখনো তেমন কোনো প্রশ্নাতীত গবেষণা হয়নি; কেবল ধারণা ও অনুমান করা যায়। যেহেতু পাচারের কৌশলগুলো গোপন, তাই এর সঠিক হিসাব বের করাও সহজসাধ্য নয়। এরই মধ্যে বাংলাদেশ কাস্টমস কতিপয় ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধ অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে। এ ধরনের পাঁচটি কেস নিচে তুলে ধরা হলো। এর মাধ্যমে বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং-সংক্রান্ত অপরাধের কিছু স্বরূপ ও প্রবণতা উন্মোচিত হতে পারে।  

কেস স্টাডি ১: ঢাকার একটি বাড়িতে এনবিআরের কাস্টমস গোয়েন্দা অধিদপ্তর কর্তৃপক্ষ অভিযান চালিয়ে প্রায় দুই মণ স্বর্ণবার (বিদেশী মনোগ্রাম চিহ্নিত) এবং পাঁচ বস্তা দেশী ও বিদেশী মুদ্রাসহ দোষী ব্যক্তিকে আটক করে। আটক স্বর্ণ ও মুদ্রার মোট মূল্য নির্ধারণ করা হয় প্রায় ৪০ কোটি টাকা। ধারণা করা হয়, আটক ব্যক্তি ও তার দল স্বর্ণবারগুলো বিদেশ থেকে বিমানবন্দর বা অন্য কোনো বন্দর থেকে কোনোরূপ ঘোষণা ছাড়া কিংবা চোরাচালান করে আমদানি করেছেন। এর জন্য তিনি বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবহার করেছেন এবং তার আলামত টাকার বস্তার ভেতরে রয়েছে। অন্যদিকে দেশীয় মুদ্রায় তিনি স্থানীয় কোনো ব্যবসায়ী বা ব্যক্তির সঙ্গে এ স্বর্ণ বিক্রি বা লেনদেন করেছেন। আটক ব্যক্তির ব্যবসায়িক পরিচয় ও অন্যান্য বিস্তারিত তথ্য থেকে জানা যায়, তিনি একজন মিষ্টির দোকানদার। কিন্তু এই বিদেশী স্বর্ণ এল কীভাবে এবং বিদেশী মুদ্রাই বা বস্তায় কেন পাওয়া গেল, তার কোনো সদুত্তর পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে এত টাকা ও স্বর্ণ কোনোটাই তার আয়কর নথিতে পাওয়া যায়নি। এই স্বর্ণ ও মুদ্রা তার জ্ঞাত আয়বহির্ভূত হিসেবে প্রতীয়মান হয়েছে কাস্টমস গোয়েন্দার কাছে। এ ঘটনার অনুসন্ধানে জানা যায়, চোরাচালান চক্রটি জব্দ করা টাকা দিয়ে বারবার অবৈধ পথে স্বর্ণ এনেছে এবং তা দিয়ে লেনদেনে জড়িত ছিল। অনুসন্ধানে জানা যায়, আমদানি নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষা ও শুল্ক ফাঁকি দিয়ে এ-জাতীয় অপরাধ দেশে বিরল ঘটনা নয়। 

কেস স্টাডি ২: কাস্টমস গোয়েন্দা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম বন্দরে ১২ কনটেইনার বিদেশী মদ, সিগারেট ও ইলেকট্রনিকস পণ্য আটক করে। পণ্য চালানটি অন্য দেশের হলেও মালয়েশিয়া হয়ে চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। পণ্য চালানগুলোতে ঘোষণা ছিল মুরগির খাবার তৈরির যন্ত্রপাতি। পরে অনুসন্ধান করে জানা গেল, যে দুটো প্রতিষ্ঠানের নামে এ পণ্য আনা হয়েছে তাদের কোনো অস্তিত্বই নেই। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে গিয়ে দেখা যায়, অতীতে এ দুই প্রতিষ্ঠান আরো ১০৮টি কনটেইনার একই প্রক্রিয়ায় খালাস নিয়েছে। অনুসন্ধানে আরো দেখা যায়, অতীতে খালাসকৃত ওইসব কনটেইনারেও একই ধরনের অবৈধ পণ্য আনা হয়েছিল। ব্যাংকের হিসাব নথিতে দেখা যায়, এক ব্যক্তির ফটো আইডি দিয়ে আরেক ব্যক্তি ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করেছেন। যাকে সামনে পাওয়া গেল তার বাড়ি রূপগঞ্জের কোনো এক গ্রামে এবং সাধারণ খেটে খাওয়া দরিদ্র মানুষ। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, তিনি ঘটনার কিছুই জানেন না। এতে আরো স্পষ্ট হলো, এর পেছনে বড় চক্র কাজ করেছে। এই ১২০ কনটেইনারের মূল্য দাঁড়িয়েছে প্রায় ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা, যার লেনদেন দেশে ও বিদেশে অবৈধ প্রক্রিয়ায় সম্পন্ন হয়েছে। এ ঘটনায় নিজের প্রকৃত পরিচিতি গোপন করে এবং জালজালিয়াতির আশ্রয়ে এ অবৈধ কর্মকাণ্ডটি ঘটেছে। একই সঙ্গে বারবার অবৈধ অর্থের রূপান্তর হয়েছে।

কেস স্টাডি ৩: একটি শুল্ক ভবনে একজন ব্যবসায়ী বিদেশ থেকে মূলধনি যন্ত্রপাতি আমদানির ঘোষণা দিলেন। কনটেইনারটি কাস্টমসের তল্লাশির আওতায় এল। কিন্তু কনটেইনার খুলে দেখা গেল, কনটেইনারে মূলধনি যন্ত্রপাতির পরিবর্তে আছে বালি ও ইট। এটি তল্লাশির আওতায় না এলে মূলধনি যন্ত্রপাতি হিসেবেই খালাস হতো কনটেইনারটি। পরে অনুসন্ধান করে দেখা যায়, সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে কনটেইনারের মূল্য বাবদ প্রায় কোটি টাকা দেশের বাইরে চলে গেছে। অথচ যে পণ্য আসার কথা সেটি আসেনি। মূলধনি যন্ত্রপাতির ঘোষণা দেয়ায় ব্যবসায়ীকে নামমাত্র ১ শতাংশ শুল্ককর দেয়ার কথা ছিল। শুল্কহার কম থাকায় এবং দেশের শিল্প খাতে বিনিয়োগে ব্যবহূত হবে এমন বিবেচনায় এসব চালান দ্রুত খালাসে অগ্রাধিকার পায়। আর এ সুযোগটি নেয় একশ্রেণীর অপরাধী। কম খরচে পণ্যমূল্য হিসেবে এত বিপুল পরিমাণ টাকা বিদেশে পাচার তাদের জন্য অপেক্ষাকৃত সহজ ও নিরাপদ পথ। কেউ যদি শত শত কনটেইনার এভাবে নিয়ে আসতে পারে, তাহলে তিনি সে অনুপাতে শত শত কোটি টাকা পাচারও করতে পারেন এ পন্থা অবলম্বন করে।

কেস স্টাডি ৪: একজন রফতানিকারক প্রায় ৪৫০টি শিপিং বিলের মাধ্যমে তার তৈরীকৃত পণ্য বিদেশে রফতানি দেখিয়েছেন। এসবের বিপরীতে তিনি তার স্থানীয় ব্যাংককে এসব শিপিং বিল সরবরাহ ও বিক্রি করে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছেন। পরে দেখা গেল ওই ব্যাংক কর্তৃক ক্রয়কৃত শিপিং বিলগুলোর বিপরীতে বিদেশ থেকে কোনো ডলার আসেনি। অন্যদিকে এ প্রদর্শিত রফতানির বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটি সরকারের কাছ থেকে প্রায় ২০০ কোটি টাকা নগদ সহায়তা নিয়েছে। যেসব দেশে পণ্য রফতানি দেখানো হয়েছে তাদের ব্যাংক নানা অজুহাতে এ অর্থ পাঠায়নি। এসব অজুহাতও তার গোচরে হয়েছে। ফলে স্থানীয় ব্যাংকের ক্রয়কৃত শিপিং বিলের টাকা ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে এবং তা তছরুপ হওয়ার উপক্রম হয়েছে। ব্যাংকের এ টাকা পণ্য রফতানির নামে ব্যবসায়ী ব্যক্তি আত্মসাত্ করেছেন মর্মে প্রতিভাত হয়েছে। অনুসন্ধানে দেখা যায়, যে শিপিং বিলের মাধ্যমে পণ্য রফতানি করা হয়েছে সেগুলোর সত্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। ধারণা করা হয়, চট্টগ্রাম কাস্টমসের শিপিং বিলের কাগজপত্র দাখিল করলেও প্রকৃত অর্থে ঘোষিত পণ্য রফতানি হয়নি। এমন আরো কেউ কেউ আছেন যারা রফতানির জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ও নগদ প্রণোদনা নিলেও প্রকৃত অর্থে পণ্য রফতানি করেননি। 

কেস স্টাডি ৫: একজন পোশাক রফতানিকারক তৈরি পোশাক রফতানি করে দেশের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করবেন, এ শর্তে বিনা শুল্কে কাপড় আমদানির জন্য শুল্ক বন্ড লাইসেন্স দেয়া হয়। শুল্ক গোয়েন্দা এ সুবিধার অপব্যবহারের তথ্য পেয়ে ওই প্রতিষ্ঠানে অভিযান চালায়। এতে দেখা যায়, প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টরি তালাবদ্ধ। কোনো শ্রমিক কাজ করছেন না। ভেতরে কোনো কাঁচামাল বা কাপড়ও নেই। পরে দেখা গেল, অল্প ব্যবধানে তিনি বিদেশ থেকে আমদানীকৃত ১৩৬টি কনটেইনার ভর্তি কাপড় খালাস নিয়েছেন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। অথচ এগুলো দিয়ে শ্রমিক নিয়োজিত করে পোশাক তৈরিপূর্বক বিদেশে প্রেরণ করার কথা ছিল। কিন্তু তিনি তা না করে শুল্কমুক্তভাবে আমদানীকৃত এ বিপুল পরিমাণ কাপড় স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে নিজে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছেন। অনুসন্ধানে আরো দেখতে পাওয়া যায়, এভাবে কাঁচামাল ক্রয়ের নামে তিনি প্রায় ১০০ কোটি টাকার অবৈধ লেনেদেনে জড়িত হয়েছেন। কিন্তু এর বিনিময়ে কোনো বৈদেশিক মুদ্রা আসত না। এ প্রতিষ্ঠান হয়তো ভুয়া রফতানির কাগজপত্র তৈরি করে তা রফতানি দেখানোর চেষ্টা করত এবং একই সঙ্গে প্রণোদনা হিসেবে নগদ সহায়তাও হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টা হতো। 

বর্ণিত এসব কেস সাম্প্রতিক এবং শুল্ক বিভাগ কর্তৃক উদ্ঘাটিত। সবই বাণিজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং এগুলোতে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে মামলা হয়েছে বা তা অনুসন্ধানাধীন। বর্তমানে এগুলোর অনুসন্ধান ও তদন্ত চলমান থাকায় ঘটনাগুলো নাম-ঠিকানাহীনভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সম্প্রতি অর্থ পাচার নিয়ে অনেক উদ্বেগ ও উত্কণ্ঠার একটা চিত্র ফুটে উঠবে বর্ণিত কেস স্টাডি থেকে। বিশেষ করে বাণিজ্যের সঙ্গে মানি লন্ডারিং অপরাধের সংযোগটির গভীরতা বোঝা যাবে এসব ঘটনা থেকে। বিভিন্ন গবেষণা অনুযায়ী, অর্থ পাচার নিঃসন্দেহে দেশের জন্য বড় ধরনের ক্ষত। কিন্তু ক্ষতটা কোথায় এবং কীভাবে কাজ করতে হবে তা বস্তুনিষ্ঠভাবে সামনে আসা দরকার।

উল্লিখিত ঘটনাগুলো বিশ্লেষণে পাঁচটি প্রধান গুরুত্বপূর্ণ দিক ফুটে ওঠে। প্রথমত, বাণিজ্যের আড়ালে মানি লন্ডারিংয়ের সুযোগ ও ব্যাপকতা অন্য মাধ্যমের চেয়ে বেশি। বর্তমান বাস্তবতায় এত টাকা বিদেশে পাঠানোর জন্য সঙ্গে বহন করা প্রায় অসম্ভব। বিমানবন্দরগুলোতে নানা নিরাপত্তা ও কাস্টমসের নজরদারি এখন আগের তুলনায় বেশ কঠোর। এখন ইচ্ছে করলেই স্যুটকেস ভর্তি টাকা নিয়ে এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া যায় না। ঘোষণা ছাড়া কোনো অতিরিক্ত অর্থ নিয়ে পার হওয়ার ঝুঁকি আছে পদে পদে। এ ঝুঁকি শুধু বাংলাদেশেই নয়, অন্যান্য দেশেও লক্ষণীয়। তাই বিকল্প হিসেবে বড় ধরনের অর্থ পাচারের জন্য বাণিজ্যভিত্তিক নানা অপকৌশল ব্যবহার করা অপেক্ষাকৃত শ্রেয়। বলতে গেলে, আমদানি ও রফতানি সুবিধাদির অপব্যবহার করা পাচারকারীদের প্রিয় মাধ্যম হওয়ার সুযোগ রয়েছে। দ্বিতীয়ত, বাণিজ্যের মাধ্যমে আমদানি ও রফতানির ক্ষেত্রে ব্যাংক চ্যানেলে যেসব লেনদেন হয় তা উন্মুক্ত এবং যেকোনো সময় তা যাচাই ও তদন্ত করা যায়। কিন্তু কোনো কোনো ক্ষেত্রে যা ঘোষণা থাকে বাস্তবে পণ্যের প্রকৃত মূল্য অনেক বেশি। অথবা এক পণ্যের আড়ালে অন্য পণ্য আনা হয়। কেস ২-এ দেখা যায়, ব্যাংকের মাধ্যমে পরিশোধ হয়েছে ১ কোটি টাকার কম। কিন্তু ব্যাংকের বাইরে লেনদেন হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৪৯ কোটি টাকা। এ বিপুল পার্থক্যজনিত অর্থ হুন্ডি বা অনানুষ্ঠানিকভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যা সামনে আসেনি বা আমরা জানছি না। ব্যাংকের মাধ্যমে লেটার অব ক্রেডিট ব্যবহার করে যে অর্থের লেনদেন হয় তার সমান্তরাল আরেকটি অনানুষ্ঠানিক চ্যানেল ব্যবহার হচ্ছে। এ অনানুষ্ঠানিক চ্যানেলটি মানি লন্ডারিংয়ের জন্য উর্বর স্থান। তৃতীয়ত, এক দেশ থেকে আরেক দেশে অবৈধভাবে অর্থ পাচার হচ্ছে একটা মাধ্যম মাত্র। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুসারে এর আওতা আরো ব্যাপক। শুল্কসংক্রান্ত বা চোরাচালানের অপরাধসহ আরো ২৬টি সম্পৃক্ত অপরাধ থেকে অর্জিত অর্থ লেনদেন, ব্যবহার, বিনিয়োগ, পাচার বা ভোগ হলেই তা মানি লন্ডারিংয়ের সংজ্ঞাভুক্ত ও শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচ্য। এর অর্থ হলো, চোরাচালান বা শুল্কসংক্রান্ত অপরাধ সংঘটন করে যেকোনো মুনাফা বিদেশে পাচার হোক বা না হোক দেশের অভ্যন্তরে তা ব্যবহার কিংবা বিনিয়োগ হলেই মানি লন্ডারিং হিসেবে বিবেচিত হবে। বর্ণিত পাঁচটি ঘটনায় এর সব উপাদান জড়িত থাকায় তা স্পষ্টতই মানি লন্ডারিং। চতুর্থত, মানি লন্ডারিংয়ের অন্যতম কৌশল হলো ‘ডার্টি মানি’র উত্স লুকানো বা গোপন করা কিংবা সত্যকে অসত্য দিয়ে আড়াল করা। ঘটনাগুলোতে ব্যাংক ও কাস্টমসের ঘোষণা বা কাগজপত্রে আছে এক রকম তথ্য; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে পণ্য বা পণ্যমূল্য আছে ভিন্ন রকম। ঘোষণা ও অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যের মধ্যে পার্থক্যের মূল কারণ হলো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের শুল্ককর ফাঁকিসংক্রান্ত আর্থিক লাভ বা পাচারের সংযোগ। এ জালিয়াতি বা মিথ্যা ঘোষণাই হচ্ছে বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিংয়ের ভিত্তি। এর মাধ্যমে অর্জিত হচ্ছে অবৈধ মুনাফা ও সম্পন্ন হচ্ছে পাচার। এর ব্যবহারও হতে পারে নিয়ন্ত্রণহীন। পঞ্চমত, প্রচলিত আইন লঙ্ঘন হচ্ছে মানি লন্ডারিংয়ের অন্যতম অনুষঙ্গ। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন ২০১২ অনুসারে ২৬ ধরনের অপরাধের কথা বলা হয়েছে। এর ব্যত্যয় ঘটিয়ে যেকোনো অর্থ অর্জন ও ব্যবহার করলেই তা মানি লন্ডারিং হিসেবে গণ্য হবে। উল্লিখিত ঘটনাগুলোর প্রত্যেকটিতে কাস্টমস আইনসহ অন্যান্য আইন ভঙ্গের উপাদান রয়েছে। শুল্ককর ফাঁকিসহ আরোপিত নিয়ন্ত্রণ উপেক্ষা করে অর্থ পাচারের প্রাথমিক সত্যতা পাওয়া গেছে এগুলোতে। 

দেশে কী পরিমাণ মানি লন্ডারিং হয় তার হিসাব নিয়ে তেমন তথ্যভিত্তিক গবেষণা হয়নি। আগেই বলা হয়েছে, গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) প্রতি বছর একটা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এর ভিত্তি কী এবং কতখানি গ্রহণযোগ্য তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। তবে এ প্রতিবেদন থেকে একটা ইঙ্গিত পাওয়া যায়, মানি লন্ডারিংয়ের ঘটনা ঘটছে। জিএফআই রিপোর্ট ও অন্যান্য গবেষণা অনুসারে, দেশে যত মানি লন্ডারিং হয় তার প্রায় ৮০ ভাগ সম্পন্ন হয় বাণিজ্যের মাধ্যমে। জিএফআই তাদের রিপোর্ট-এ বলছে, ২০০৮ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত নয় বছরে গড়ে ৭ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বাংলাদেশ থেকে বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হয়েছে। কেবল ২০১৫ সালেই বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হয়েছে ১৭ দশমিক ৯৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এ অংক নিয়ে নানা বিতর্ক রয়েছে। তবে বর্ণিত পাঁচটি কেস স্টাডি থেকে এ ধরনের পর্যবেক্ষণের কিছুটা মিল পাওয়া যায়। এ নিয়ে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে তাকে সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়া কঠিন।

বর্তমান সরকারও বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে ভাবছে এবং তা রোধে মানি লন্ডারিং অনুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি শক্তিশালী করছে। এ বিষয়ে সমন্বয় করার জন্য একাধিক কমিটি ও সংস্থা কাজ করছে। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে ২০১৫ সালের আগে কেবল দুর্নীতি দমন কমিশন ওই আইনের অধীন অনুসন্ধান ও তদন্ত করতে পারত। ২০১৫ সালের আইনের সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশ কাস্টমসসহ নিজ নিজ ফাংশনাল সংস্থাকেও এ দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ফলে প্রত্যাশা সৃষ্টি হয়েছে যে এ সংশোধনীর মাধ্যমে প্রদত্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব অনুসারে এসব সংস্থা কতটুকু তা প্রতিরোধ করতে পারছে এবং ঘটে যাওয়া অপরাধের শাস্তির বিধান প্রয়োগ করছে তার মূল্যায়ন করা। এরই মধ্যে কাস্টমসের পক্ষ থেকে প্রায় ৯০টি মামলা করা হয়েছে এবং এগুলো তদন্তাধীন রয়েছে। এসব মামলা হয়তো দেশে ঘটে যাওয়া অপরাধের একটা ছোট অংশ; তবে শুরুটা নিসন্দেহে স্বস্তির কারণ বটে। 

মানি লন্ডারিং অপরাধের সঙ্গে সংযোগকৃত অর্থের সরবরাহ, লেনদেন ও ব্যবহার সীমিত করতে পারলে এসব অপরাধের ব্যাপকতা কমে যাবে। সন্ত্রাসবাদ বা অন্যান্য অপরাধে এ ধরনের অর্থায়ন বন্ধ করতে পারলে সমাজ ও রাষ্ট্রে এসব অপরাধের অক্সিজেন সরবরাহ সরু হবে। এসব বিবেচনায় উন্নত বিশ্বসহ বিভিন্ন দেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে সৃষ্ট অনুশাসন কঠোর ও আর্থিক লেনদেনে স্বচ্ছতা আনা হচ্ছে। প্রতিরোধের সফলতার ওপর আবার বিশ্বব্যাপী র্যাংকিংও হচ্ছে। কোনো কোনো দেশ কালো তালিকা, ধূসর বা সাদা তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। এসব বিভাজন অনুযায়ী দেশের ভাবমূর্তি ও বৈধ বাণিজ্যের খরচও ওঠানামা করছে। বাংলাদেশ সম্প্রতি কালো বা ধূসর তালিকা এড়াতে পেরেছে, যা ইতিবাচক। তবে সাম্প্রতিক বাংলাদেশ কাস্টমস কর্তৃক উদ্ঘাটিত কয়েকটি ঘটনায় ইঙ্গিত দিচ্ছে যে বাণিজ্যসংশ্লিষ্ট কয়েকটি ক্ষেত্রে মানি লন্ডারিংয়ের ঝুঁকি রয়েছে। ওয়ার্ল্ড কাস্টমস অর্গানাইজেশনের (ডব্লিউসিও) মতে, বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধে কাস্টমস সার্বিকভাবে সীমান্তের ফ্রন্টলাইনার হিসেবে Tip of the Spear এর ভূমিকা পালন করতে পারে। ডব্লিউসিও এ বিষয়ে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর জন্য কিছু গাইডলাইন তৈরি করেছে, যা উপযুক্ত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অনুসরণ করা যেতে পারে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে বাণিজ্যের প্রসার বহুগুণ বেড়েছে। ১৯৭৩ সালের তুলনায় এর পরিমাণ প্রায় ৫৭৩ গুণ বেশি; ২০৪১ সাল নাগাদ এর পরিমাণ আরো বাড়বে। এ অনুপাতে অপবাণিজ্যের হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কার পরিপ্রেক্ষিতে মানি লন্ডারিংয়ের প্রবণতার রাশ টেনে ধরা দরকার। বাণিজ্যের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের এই ব্যাপ্তি বিবেচনায় কাস্টমস কর্তৃক প্রতিরোধের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে বর্ণিত ক্ষমতা অনুসারে বাংলাদেশ কাস্টমসের সক্ষমতাকে বাড়ানো এবং এর সহায়ক ভৌত অবকাঠামো তৈরি করা, প্রয়োজনীয় লোকবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ প্রদান জরুরি হয়ে পড়েছে। এ বিষয়ে একটি বিশেষায়িত পৃথক ইউনিট গঠন করা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে। একই সঙ্গে অন্যান্য দেশের সঙ্গে মিল রেখে এবং উত্তম চর্চা অনুসারে কাস্টমসের আধুনিকায়নে সময়াবদ্ধ দৃশ্যমান অগ্রগতি আনা প্রয়োজন। দায়েরকৃত মানি লন্ডারিং মামলাগুলো দ্রুত তদন্ত সম্পন্ন করে দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করাটা আবশ্যক হয়ে উঠেছে। দেশে এ-সংক্রান্ত কিছু নজির স্থাপন করতে পারলে পাচারকারীরা চাপে পড়বে; বিদেশমুখিতার মোহে ভাটা পড়বে। 

পরিশেষে আন্তর্জাতিক গবেষক জন এ কাসারা (২০১৬) Trade-Based Money Laundering: The Next Frontier in International Money Laundering Enforcement শীর্ষক বইয়ের উক্তি উল্লেখ করা এখানে প্রাসঙ্গিক হবে। এ গবেষকের মতে, বর্তমানে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে যেকোনো এনফোর্সমেন্টে বাণিজ্যভিত্তিক মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ হবে গুরুত্বপূর্ণ দিগন্ত। সীমান্তের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে বাংলাদেশ কাস্টমসকে এ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে হবে; আরো দৃশ্যমান হতে হবে কাজের পরিসর ও মান নিয়ে। কাস্টমসকে এনফোর্সমেন্টের নতুন এ ক্ষেত্রকে সঠিকভাবে পরিচালনা করা প্রয়োজন।

(লেখাটি আন্তর্জাতিক কাস্টমস দিবস ২০২১ উপলক্ষে এনবিআর কর্তৃক প্রকাশনা থেকে সংকলিত)


লেখক: ড. মইনুল খান মহাপরিচালক, ভ্যাট গোয়েন্দা, তদন্ত ও অডিট অধিদপ্তর, এনবিআর; শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন