বাংলাদেশের পোশাক খাত

বিপদ বাড়ছে স্বল্পসংখ্যক ক্রেতানির্ভরতায়

বদরুল আলম

দেশের রফতানি খাত এমনিতেই বৈচিত্র্যময় নয়। মোট রফতানির ৮০ শতাংশের বেশি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। আবার পণ্যটির বাজারও সীমিত। একক দেশ হিসেবে রফতানি পণ্যের প্রধান গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র জার্মানি। বৈচিত্র্য বাজার সীমাবদ্ধতার পাশাপাশি পোশাক পণ্য তৈরি সংশ্লিষ্টদের দুর্বলতার আরেকটি ক্ষেত্র হচ্ছে ক্রেতা। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান কভিড-১৯ মহামারীতে পণ্য বিক্রিতে গুটিকয় ক্রেতার ওপর নির্ভরতা রফতানিকারক তথা বাংলাদেশের বিপদ বাড়িয়ে দিচ্ছে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষকদের দাবি, গুটিকয়েক ক্রেতার ওপর নির্ভরতার কারণেই কভিড-১৯ অনেক বেশি ভুগিয়েছে দেশের পোশাক খাতকে। একই কারণে কভিড-১৯-এর প্রভাবে সৃষ্ট বিপদ আরো বাড়ছে রফতানিকারকদের। কভিড-১৯-এর প্রভাব পুনরুদ্ধার পরিস্থিতি নিয়ে সম্প্রতি যৌথভাবে জরিপ পরিচালনা করে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্টার ফর এন্ট্রাপ্রেনিউরশিপ ডেভেলপমেন্টের (সিইডি) ম্যাপড ইন বাংলাদেশ (এমআইবি) জরিপের ভিত্তিতে তৈরি গবেষণা প্রতিবেদনে তারা বলেছে, স্বল্পসংখ্যক ক্রেতার ওপর নির্ভরতা পোশাক খাতের অন্যতম প্রধান দুর্বলতা। শুধু ছোট না, বড় আকারের কারখানাগুলোর ক্ষেত্রেও দুর্বলতা রয়েছে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। তৈরি পোশাক প্রস্তুতকারকদের স্বল্পসংখ্যক ক্রেতার ওপর নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ছোট-বড় সব ধরনের ক্রেতার ক্রয়াদেশ নেয়ার পরামর্শও দিয়েছে তারা।

সিপিডির গবেষণা পরিচালক . খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বণিক বার্তাকে বলেন, বিকল্প উৎস থাকলে একটি বড় ব্র্যান্ড পণ্য না নিলে অন্য ক্রেতার সঙ্গে চুক্তি করতে পারত সরবরাহকারী। সুযোগ থাকলে টিকে থাকার জন্য সীমিত আকারের হলেও ক্রয়াদেশ পাওয়া যেত। কিন্তু যেহেতু সীমিতসংখ্যক ব্র্যান্ড ক্রেতার ওপর আমাদের কারখানাগুলো নির্ভরশীল, তাই সংকটের মধ্যে নতুন ক্রেতা খোঁজা বা পাওয়া সম্ভব হয়নি। এছাড়া চলমান পরিস্থিতিতে বড় ব্র্যান্ডগুলোই বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তাদের অনেক বিক্রয়কেন্দ্র বন্ধ করতে হয়েছে, দেউলিয়া হয়েছেন অনেকে। যারা ছোট ক্রেতা, তাদের পরিচালন ব্যয় কম বলে তারা ছোট আকারের হলেও ব্যবসা করে টিকে থাকতে পেরেছে। আমাদের পোশাক কারখানাগুলো যদি ছোট ব্র্যান্ডগুলোর সঙ্গেও কাজ করত, তাহলে তাদের পক্ষে ব্যবসায়ও বৈচিত্র্য আনা সম্ভব হতো। আবার টিকে থাকার ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থা সৃষ্টির সুযোগও থাকত।

তিনি বলেন, আগামীতে আমরা যখন লো-এন্ড থেকে মিডিয়াম এন্ডের পণ্য তৈরির দিকে ধাবিত হব, বড় আকারের উৎপাদন থেকে আমরা যখন বের হব, তখন কিন্তু বড় আকারের ক্রেতারা আমাদের ভালো সহায়তা দিতে পারবে না। বড় আকারের ক্রেতা আমাদের লাগবে কিন্তু পর্যায়ক্রমে তাদের ক্রয়াদেশও কমে আসবে আগামীতে। ওই সময় কারখানাকে অনেক ক্রেতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সার্বিকভাবে এখনকার বিচারে, আমাদের টিকে থাকা বিবেচনায়, প্রতিরোধ, পুনরুদ্ধার শিল্প উন্নয়ন যে কোনো দিক বিবেচনায় আমাদের ক্রেতা বৈচিত্র্যতাও খুব প্রয়োজন।

এমআইবি কারখানাভিত্তিক যে তথ্যভাণ্ডার তৈরি করেছে, সেটির বিশ্লেষণেও গুটিকয়েক ক্রেতা নির্ভরতার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে। কোন কারখানা কোন ক্রেতার জন্য পণ্য তৈরি সরবরাহের কাজ করে, সে চিত্র তথ্যে উঠে এসেছে। এতে দেখা গেছে, অনেকসংখ্যক কারখানা গুটিকয়েক ক্রেতার পণ্য সরবরাহের কাজ করে।

এমআইবির পরিসংখ্যানে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি কারখানা কাজ করে স্পেনভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জারা। মোট ৩৫২ কারখানা জারার জন্য পোশাক তৈরির কাজ করে বা করেছে। জারার পরই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক কারখানা দেখা যাচ্ছে সুইডিশ এইচঅ্যান্ডএমের ক্ষেত্রে। ব্র্যান্ডের কাজ করে বা করেছে এমন কারখানা সংখ্যা ৩৩৬টি। হংকংভিত্তিক লিঅ্যান্ডফাং-এর জন্য কাজ করে বা করেছে এমন কারখানার সংখ্যা ৩০৪টি। যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ালমার্টের জন্য কাজ করে এমন কারখানার সংখ্যা ৩০৪টি। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক প্রাইমার্কের হয়ে কাজ করে বা করেছে এমন কারখানার সংখ্যা ২৯৭টি।

কভিড-১৯-এর প্রভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাত প্রাথমিকভাবে কাঁচামালের সরবরাহ সংকটে পড়ে। দেশে তৈরি ওভেন পণ্যের আনুমানিক ৬০ শতাংশ কাপড় আমদানি হয় চীন থেকে। আর নিট পণ্যের কাঁচামাল আমদানি হয় ১৫-২০ শতাংশ। নভেল করোনাভাইরাসের ব্যাপক সংক্রমণের কারণে চীন থেকে কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত হয়। পরবর্তী সময়ে কাঁচামাল সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও রফতানি গন্তব্যগুলোয় রোগের প্রাদুর্ভাব ছড়িয়ে পড়ায় চাহিদার সংকট তৈরি হয়।

চাহিদা সংকটের ধারাবাহিকতায় একের পর এক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করতে থাকে। কভিডের প্রথম ঢেউয়ে ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিত করা ক্রেতাদের মধ্যে ছিল প্রাইমার্কের মতো বড় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও। আয়ারল্যান্ডভিত্তিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি ছোট-মাঝারি-বড় সব ধরনের ক্রেতাই ক্রয়াদেশ বাতিল-স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছিল ওই সময়। তবে পরবর্তী সময়ে এইচঅ্যান্ডএম, ইন্ডিটেক্স, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার, কিয়াবি, টার্গেট, পিভিএইচসহ আরো কিছু ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ক্রয়াদেশ বহালও করে। এখন কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে ক্রেতারা ক্রয়াদেশ সরবরাহের সময়ে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে শুরু করেছে।

বিজিএমইএর তথ্য বলছে, এপ্রিল শেষে হাজার ১৫০ কারখানার মোট ৩১৮ কোটি ডলারের ক্রয়াদেশ বাতিল স্থগিত হয়। এসব ক্রয়াদেশের আওতায় ছিল ৯৮ কোটি ২০ লাখ পিস পোশাক। অন্যদিকে এসব কারখানার কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ২২ লাখ ৮০ হাজার। এখন কভিডের দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে আবারো ক্রয়াদেশ নিয়ে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। দ্বিতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে এরই মধ্যে ক্রয়াদেশ ৩০ শতাংশ কমেছে বলেও জানিয়েছে বিজিএমইএ। পরিস্থিতিতে যে ক্রয়াদেশগুলো আসছে, তার বেশির ভাগই ঋণপত্র ছাড়া। আর পশ্চিমা খুচরা বাজারের অনিশ্চয়তায় পণ্যের দাম পরিশোধ নিয়েও ঝুঁকি বাড়ছে। এরই মধ্যে উপকরণ থেকে শুরু করে চূড়ান্ত পণ্যের মূল্য হিসেবে ক্রেতাদের কাছে বিলিয়ন ডলারের পাওনা সৃষ্টি হয়েছে। পাওনা আদায় নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন রফতানিকারকরা।

বাংলাদেশ ফরেন ট্রেড ইনস্টিটিউটের সিইও আলী আহমেদ বণিক বার্তাকে বলেন, পোশাক বাজারে এখনো ক্রেতা আধিপত্যই শক্তিশালী। একেবারে স্বল্প মেয়াদের ভবিষ্যতে আমার মনে হয় আমরা অবস্থাতেই চলতে বাধ্য হব। অর্থাৎ পোশাকের ওপর নির্ভরশীলতা আর ওই দুই বাজার অভিন্ন ক্রেতার ওপর নির্ভরশীলতা। এজন্যই প্রয়োজন পণ্যের পাশাপাশি ক্রেতা বাজার বৈচিত্র্যকরণ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন