হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকা

এক মোড় ঘিরে ছয় মেগা প্রকল্প

শামীম রাহমান

সারি সারি কংক্রিটের স্ল্যাব ফেলে রাখা হয়েছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর গোল চত্বরে। এসবের ফাঁকফোকর দিয়ে চলছে গাড়ি। ফেলে রাখা স্ল্যাবগুলো বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের। গাজীপুর-বিমানবন্দরের মধ্যে বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন হচ্ছে প্রকল্পের মাধ্যমে। একই সঙ্গে গোলচত্বরের দক্ষিণে বিমানবন্দর-কুড়িল মহাসড়কে নির্মাণ করা হচ্ছে ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। পুরোদমে চলছে উড়ালসড়কটির নির্মাণকাজ।

শুধু বিআরটি বা ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নয়, বিমানবন্দর গোলচত্বর ঘিরে আরো চারটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সরকার। ছয় মেগা প্রকল্পের মধ্যে দুটির কাজ চলমান। এর মধ্যে মেট্রো রেল লাইন- আর ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ চলতি বছরেই শুরুর কথা রয়েছে। বিমানবন্দর গোলচত্বরে আন্ডারপাস নির্মাণের জন্য আহ্বান করা হয়েছে দরপত্র। অন্যদিকে পরিকল্পনাধীন অবস্থায় রয়েছে বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশনকে ঘিরে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব নির্মাণ।

ছয়টি প্রকল্পের জন্য সম্ভাব্যতা সমীক্ষা হয়েছে পৃথকভাবে। কিন্তু গোলচত্বরটি ঘিরে ছয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য সমন্বিতভাবে কোনো সমীক্ষা হয়নি। বিমানবন্দর গোলচত্বরে  এতগুলো প্রকল্পের প্রয়োজন আদৌ রয়েছে কিনা, তা নিয়েও কোনো সমীক্ষা নেই।  প্রকল্পগুলোর সুফল নিয়েও অন্ধকারে রয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সমন্বিত সমীক্ষা ছাড়া একটি গোলচত্বরে এতগুলো প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে, সেখানে জটিলতা দেখা দেয়ার আশঙ্কা করছেন তারা।

বিমানবন্দর গোলচত্বর ঘিরে বর্তমানে দুটি মেগা প্রকল্পের কাজ চলছে। এর একটি বিআরটি। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের বিমানবন্দর-গাজীপুর অংশে প্রকল্পের মাধ্যমে বাসের জন্য বিশেষায়িত লেন গড়ে তোলা হচ্ছে। হাজার ২৬৮ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে সড়ক জনপথ (সওজ) অধিদপ্তর, বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর। প্রকল্প কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বাসের জন্য বিশেষায়িত লেনটিতে কেবল সরকারি কোম্পানির নির্দিষ্টসংখ্যক বাস চলাচল করবে। এতে গাজীপুর থেকে বিপুলসংখ্যক যাত্রী সহজে কম খরচে দ্রুত বিমানবন্দর পর্যন্ত যাতায়াত করতে পারবে। ২০২২ সালের জুনে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে, যদিও ধীরগতির নির্মাণকাজের কারণে বাস্তবায়নে আরো বেশি সময় লাগতে পারে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রায় হাজার কোটি টাকায় শাহজালাল  বিমানবন্দর থেকে চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুতুবখালী পর্যন্ত ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ করছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। কম-বেশি ৪৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উড়ালসড়কটি শুরু হয়েছে বিমানবন্দর গোলচত্বরের দক্ষিণ পাশ থেকে। প্রকল্পের কাজও ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা।

বিমানবন্দর গোলচত্বরের উত্তর পাশ থেকে শুরু হবে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে যুক্ত করে দেয়া হবে। আর দুই এক্সপ্রেসওয়ের সংযোগস্থল হবে বিমানবন্দর গোলচত্বর। ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। আগামী ফেব্রুয়ারি নাগাদ কাজ শুরু করার কথা জানিয়েছেন প্রকল্প পরিচালক শাহাবুদ্দিন খান।

বিমানবন্দর রেলওয়ে স্টেশন থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড মেট্রো রেল নির্মাণ করছে ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। এটিকে অভিহিত করা হচ্ছে মেট্রো রেল- নামে। ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা খরচ হবে প্রকল্পে। মাটির নিচ দিয়ে বিমানবন্দর গোলচত্বর অতিক্রম করবে প্রকল্প।

বিদ্যমান রেলওয়ে স্টেশনটি বিমানবন্দর গোলচত্বরের ১০০ মিটার সীমার মধ্যেই। স্টেশনটি আধুনিকায়নের উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এটিকে গড়ে তোলা হবে মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট হাব হিসেবে। এর মাধ্যমে স্টেশন থেকেই একসঙ্গে অনেক ধরনের যানবাহন সুবিধা পাবেন যাত্রীরা। পাশাপাশি স্টেশনটিতে নানা বাণিজ্যিক কার্যক্রমও পরিচালনা করবে রেলওয়ে। বর্তমানে প্রকল্পের প্রাথমিক কাজগুলো এগিয়ে নিচ্ছে জাপানি প্রতিষ্ঠান কাজিমা করপোরেশন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিক কাজ শেষ করে দ্রুত প্রকল্পটি একনেকে তোলার অপেক্ষায় তারা কাজ করে যাচ্ছেন।

বিমানবন্দর গোলচত্বরের নিচে নির্মাণ করা হবে ৬২০ মিটার দীর্ঘ আন্ডারপাস। এটি হাজি ক্যাম্পের সম্মুখভাগ, বিমানবন্দর রেলস্টেশন, বিআরটি স্টেশন, এমআরটি (মেট্রো রেল)- স্টেশন বিমানবন্দর টার্মিনাল -এর মধ্যে সংযোগ স্থাপন করবে। নির্মাণে প্রাথমিকভাবে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২১ কোটি টাকা। গ্রেটার ঢাকা আরবান ট্রান্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট, যেটির মাধ্যমে বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি নির্মাণ করা হচ্ছে, সেই প্রকল্পের মাধ্যমেই বানানো হবে আন্ডারপাস। এরই মধ্যে আন্ডারপাসটি নির্মাণে দরপত্রও আহ্বান করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। শিগগির কাজ শুরু করার ইঙ্গিত দিয়েছেন প্রকল্পের কর্মকর্তারা।

ঢাকা শহরের মধ্যে যোগাযোগ অবকাঠামো খাতের উন্নয়নের জন্য এখন পর্যন্ত কোনো ডিমান্ড মডেল তৈরি করা হয়নি। এটা থাকলে বিমানবন্দর গোলচত্বরে এতগুলো প্রকল্পের যৌক্তিকতার বিষয়টি সহজেই যাচাই করা যেত বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক . হাদিউজ্জামান। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, বিমানবন্দর মোড় ঘিরে যেসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, সেগুলোর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের কাজ করা হয়েছে আলাদাভাবে। এক চত্বরে যেহেতু অনেকগুলো প্রকল্প হচ্ছে, সেহেতু সব প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা যাচাইয়ের কাজটি সমন্বিতভাবে করা উচিত ছিল। সেটি না হওয়ায় সব প্রকল্প চালু হলে জটিলতা তৈরি হতে পারে বলে মত দেন তিনি। পাশাপাশি প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সমন্বিতভাবে করার ওপর জোর দেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন