ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধন

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেশির ভাগ প্রস্তাবই কাটছাঁট হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে

হাছান আদনান

দেশের ব্যাংক খাতে পরিবারতন্ত্র চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের নীতিকে দেখা হয় সুশাসন কার্যকরের অন্তরায় হিসেবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে এক বা একাধিক ব্যাংক একক পরিবারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার ঘটনাও ঘটছে। ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে ফেরত দিচ্ছে না ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা। অবস্থায় ১৯৯১ সালের ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে বিশৃঙ্খলার লাগাম টানতে চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এজন্য দীর্ঘ আলোচনা-পর্যালোচনার পর ব্যাংক কোম্পানি আইনে যেসব সংস্কার প্রস্তাব বাংলাদেশ ব্যাংক দিয়েছিল, তার বেশির ভাগই কাটছাঁট হচ্ছে অর্থ মন্ত্রণালয়ে।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের যে খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের অনেক সুপারিশই তাতে অনুপস্থিত। সম্প্রতি খসড়া প্রস্তাবটির ওপর মতামত আহ্বান করেছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সও (বিএবি) এখন খসড়া প্রস্তাবের অনেক বিষয়ে আপত্তি জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। গত সপ্তাহে বিএবির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।

২০১৮ সালে ব্যাংক কোম্পানি আইনে সংশোধন এনে একটি ব্যাংকের পরিচালক পদে একই পরিবারের দুজনের পরিবর্তে চারজনকে থাকার সুযোগ দেয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, আইনে দেয়া পরিবারের সংজ্ঞার সীমাবদ্ধতার সুযোগ নিয়ে কোনো কোনো ব্যাংকে একই পরিবারের আটজনও পরিচালক হিসেবে থাকছেন। অবস্থায় ব্যাংকগুলোকে পরিবারতন্ত্র থেকে বের করে আনতে পরিবারের সংজ্ঞা পরিবর্তনের প্রস্তাব করেছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। কিন্তু বিএবি-এবিবিসহ কিছু ব্যাংকের বিরোধিতার মুখে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশোধন প্রস্তাবটি বাদ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

বিদ্যমান আইনে পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে কোনো ব্যক্তির স্বামী বা স্ত্রী, পিতা, মাতা, পুত্র, কন্যা, ভাই, বোন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীলদের কথা বলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাব ছিল পুত্রবধূ, জামাতা, শ্বশুর, শাশুড়ি, ভাইয়ের পুত্র কন্যা, বোনের পুত্র কন্যা, নাতি-নাতনি, পিতা মাতার ভাই-বোন তাদের স্বামী বা স্ত্রী এবং পুত্র-কন্যাদেরও পরিবারের অন্তর্ভুক্ত হিসেবে গণ্য করা হোক। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের খসড়ায় প্রস্তাব বাদ পড়েছে।

দেশে ব্যাংক খাতের ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়ার দাবি উঠেছিল সর্বমহল থেকে। বিষয়টি আমলে নিয়ে ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংশোধন প্রস্তাবে ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংজ্ঞা সংযোজনের প্রস্তাব করে বাংলাদেশ ব্যাংক। অর্থ মন্ত্রণালয় সংজ্ঞাটি খসড়া প্রস্তাবে ঠাঁই দিলেও তাতে আমূল পরিবর্তন এনেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাব ছিল, জাল-জালিয়াতি, প্রতারণা মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে অস্তিত্বহীন কোনো প্রতিষ্ঠানের নামে ঋণ গ্রহণ করলে বা যে উদ্দেশ্যে ঋণ গ্রহণ করা হয়েছিল, সে উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে ঋণের অর্থ অন্য কোনো খাতে ব্যবহার বা স্থানান্তর করলে গ্রাহককে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হবে। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রকাশ করা খসড়ায় বিষয়টি স্থান পায়নি।

অন্যদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে প্রকাশিত আইনের খসড়ায় ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, যিনি নিজের বা নিজ স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের অথবা বেনামি বা অস্তিত্বহীন কোম্পানির নামে গৃহীত ঋণ, অন্য কোনো আর্থিক সুবিধা বা তার অংশবিশেষ অথবা এর সুদ সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিশোধ না করেন, তাহলে তিনি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি হবেন। এছাড়া যদি কেউ ঋণের বিপরীতে দেয়া জামানত ঋণদাতা ব্যাংকের লিখিত পূর্বানুমতি ছাড়াই হস্তান্তর বা স্থানান্তর করেন এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী গৃহীত ঋণ পরিশোধ না করেন, তাহলে তিনিও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপির তালিকায় যুক্ত হবেন।

ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর পরিচালক, ব্যবস্থাপনা পরিচালক তার নিম্ন দুই স্তর পর্যন্ত কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষমতা চেয়েছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এক্ষেত্রে প্রস্তাব ছিল, বাংলাদেশ ব্যাংক পদগুলোয় নিয়োগের লক্ষ্যে একটি কমিটি বা ইন্টারভিউ বোর্ড গঠন করবে।

কমিটি নির্বাচিত বা মনোনীত ব্যক্তিদের সাক্ষাত্কার গ্রহণ করে নিয়োগের সুপারিশ করবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাবও বাদ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। এছাড়া আইনের ১৫ ধারার আওতায় নতুন পরিচালক নির্বাচন, স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ, পর্ষদের ভূমিকা দায়দায়িত্বের বিষয়েও ব্যাপক সংস্কারের প্রস্তাব ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় ওই প্রস্তাবগুলোতেও কাটছাঁট করেছে।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো তৈরি করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের একাধিক বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তারা। তাদের মধ্যে ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, ব্যাংক খাতের শৃঙ্খলার স্বার্থেই বাংলাদেশ ব্যাংক আইনে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু এর মধ্যে কিছু প্রস্তাব অর্থ মন্ত্রণালয় এরই মধ্যে বাদ দিয়েছে। কিছু প্রস্তাব কাটছাঁট করে রাখা হয়েছে। তার পরও এখন পর্যন্ত যেসব বিধান রাখা হয়েছে, তা শেষ পর্যন্ত থাকে কিনা সেটি নিয়েও সন্দেহ রয়েছে। ব্যাংক খাতের স্বার্থেই আইন সংশোধন করে অনিয়ম-দুর্নীতির লাগাম টানা দরকার।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ২৩ ধারা সংশোধনের বিষয়েও প্রস্তাব দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে বলা হয়েছিল, কোনো ব্যক্তি একটি ব্যাংকের পরিচালক থাকা অবস্থায় কোনোভাবেই অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা বীমা কোম্পানির পরিচালক থাকতে পারবেন না। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত খসড়া সংশোধন প্রস্তাবে এটি ঠাঁই পেয়েছে। ব্যাংক পরিচালকদের বিষয়ে ধারা রাখা হলেও ২৭ ধারায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশোধন প্রস্তাবে বাদ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। ওই ধারার সংশোধন প্রস্তাবে বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছিল, পরিচালকদের বিনা জামানত ব্যক্তিগত গ্যারান্টি ছাড়া ঋণ নেয়ার বিষয়ে বিধিনিষেধ আরোপ করা হোক। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রস্তাব বাদ দিয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সুপারিশ আমলে নিয়ে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিষয়ে বেশকিছু বিধিনিষেধের প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিষয়ে আইনের ২৭ ধারায় উপধারা সৃষ্টির প্রস্তাব করা হয়েছে। ধারায় বলা হয়েছে, ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতা শনাক্ত চূড়ান্ত করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের জারীকৃত নির্দেশনা অনুযায়ী প্রত্যেক ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান একটি শনাক্তকারী কমিটি একটি চূড়ান্তকারী কমিটি গঠন করবে। প্রত্যেক ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সময় সময় ইচ্ছাকৃত খেলাপি ঋণগ্রহীতাদের তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রেরণ করবে। প্রাপ্ত তালিকা বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে পাঠাবে।

ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের কিছু মৌলিক অধিকার স্থগিতের বিষয়টিও আইনে সংযোজনের প্রস্তাব করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বিষয়ে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক সরকারের সংশ্লিষ্ট সংস্থার কাছে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের তালিকা পাঠাতে পারবে। ধরনের ঋণখেলাপিদের ওপর বিদেশযাত্রা, গাড়ি বাড়ি নিবন্ধন, ট্রেড লাইসেন্স ইস্যু কোম্পানি নিবন্ধনের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যাবে। পাশাপাশি ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা রাষ্ট্রীয়ভাবে কোনো সম্মাননা পাওয়া বা রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের যোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন না বলেও সংশোধন প্রস্তাবে যুক্ত করা হয়েছে। প্রস্তাবে বলা হয়েছে, কোনো পেশাজীবী, ব্যবসায়িক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা রাজনৈতিক সংগঠন পরিচালনায় গঠিত কমিটির কোনো পদে ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা থাকতে পারবেন না।

আইনের ধারার সংশোধন প্রস্তাবটির বিরোধিতা করেছে বেসরকারি ব্যাংক উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিএবি। সংগঠনটি বিষয়ে নিজেদের মতামত তুলে ধরে বলেছে, মুহূর্তে ব্যাংক কোম্পানি আইনে ২৭ককক এবং ২৭কককক উপধারা সংযোজন করলে ব্যাংক খাতে বিশৃঙ্খল অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

ব্যাংক কোম্পানি আইনের ৬৬ ধারা সংশোধন করে বাংলাদেশ প্রস্তাব করেছিল, কোনো ব্যাংক বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে গৃহীত যেকোনো ব্যবস্থা চলমান থাকা অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক যদি মর্মে সন্তুষ্ট হয়, ওই ব্যাংকের আমানতকারী বা জনস্বার্থে এর বর্তমান সাবেক পরিচালক, ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, অন্য যেকোনো ব্যক্তি বা তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অথবা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রতিষ্ঠান পরিচালিত ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের হিসাব এবং তাদের মালিকানাধীন বা নিয়ন্ত্রণাধীন স্থাবর অস্থাবর সম্পদ অবরুদ্ধ করা প্রয়োজন, তাহলে বাংলাদেশ ব্যাংক হাইকোর্ট বিভাগের আদেশ গ্রহণপূর্বক তা অবরুদ্ধ করতে পারবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রস্তাবের বিষয়ে বিএবি বলেছে, ধারাটি আমাদের কাছে আপত্তিকর মনে হচ্ছে এজন্য আইনের খসড়া থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রস্তাব বাদ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়।

বিষয়ে বিএবি চেয়ারম্যান মো. নজরুল ইসলাম মজুমদার বণিক বার্তাকে বলেন, ব্যাংক কোম্পানি আইনে যেসব সংস্কার প্রস্তাব এসেছে, তা নিয়ে আমরা পর্যালোচনা করেছি। এক্ষেত্রে ধারাগুলোর ইতিবাচক নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে আমরা এর আগে মতামত জানিয়েছিলাম। তবে সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে সংশোধন প্রস্তাবের একটি খসড়া প্রকাশ করা হয়েছে। এটির বিষয়েও বিএবি নিজেদের মতামত জানানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। এরই মধ্যে বিএবির বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।

অর্থ মন্ত্রণালয় ঘোষিত খসড়া প্রস্তাবে ব্যাংক কোম্পানি আইনে ষষ্ঠ- খণ্ড নামে একটি অধ্যায় যুক্ত করা হয়েছে। অধ্যায়ে দেশের দুর্বল ব্যাংকগুলোর পুনরুদ্ধার বা মার্জার-অ্যাকুইজিশন সম্পর্কে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়েছে। অধ্যায়ের আওতায় দেশে ব্যাংকের সংখ্যা কমানো কিংবা দুর্বল ব্যাংক অবসায়নের পথ সুগম হবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন