মার্চে কার্যক্রম চালুর প্রত্যাশা রিজেন্ট এয়ারওয়েজের

মনজুরুল ইসলাম

কভিড-১৯ মহামারীর প্রাদুর্ভাবের মুখে এয়ারলাইন খাতের প্রতিষ্ঠানগুলো গত বছরের মার্চে একের পর এক আন্তর্জাতিক অভ্যন্তরীণ গন্তব্যের বাণিজ্যিক ফ্লাইট বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। বাংলাদেশী বেসরকারি এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট এয়ারওয়েজও সে সময় তিন মাসের জন্য নিজেদের কার্যক্রম সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয়। পরবর্তী সময়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অন্যান্য এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠান বাণিজ্যিক ফ্লাইট শুরু করলেও এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। প্রতিষ্ঠানটি বলছে, আগামী মার্চ থেকে কার্যক্রমে ফিরে আসছে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। এজন্য গত ডিসেম্বরে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য দেশের বাইরে উড়োজাহাজ পাঠিয়েছে এয়ারলাইনসটি। যদিও গুঞ্জন উঠেছে, রক্ষণাবেক্ষণের নামে লিজের উড়োজাহাজ বাইরে পাঠিয়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার পরিকল্পনা করছে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ কর্তৃপক্ষ।

রিজেন্ট এয়ারওয়েজের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, দীর্ঘ সময় ধরে আর্থিক সংকটে থাকায় রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ২০১৯ সালের আগস্ট থেকেই কর্মীদের নিয়মিত বেতন দিতে পারছিল না। পরবর্তী সময়ে কভিড-১৯-এর প্রেক্ষাপটে গত বছর মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানটির ফ্লাইট চলাচল। ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার আগে প্রায় ৩০ হাজার অগ্রিম টিকিট বিক্রি করেছিল এয়ারলাইনসটি, যার অর্থ এখনো ফেরত পাননি যাত্রীরা। অন্যদিকে আয় না থাকায় বৈমানিকসহ কর্মীদের বেতন-ভাতাও নিয়মিত দেয়া হচ্ছে না। অধিকাংশ কর্মীকেই অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে। শুধু তা- নয়, প্রতিষ্ঠানটি পুনরায় কার্যক্রমে ফিরতে পারবে কিনা, এমন শঙ্কা থেকে অনেক আগেই চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন রিজেন্টের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, বিক্রয় বিপণন বিভাগের পরিচালকসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ (বেবিচক) জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছেও বিপুল অংকের বকেয়া রয়েছে এয়ারলাইনস প্রতিষ্ঠানটির। অবস্থায় উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ করতে দেশের বাইরে নেয়ার বিষয়টিকে কার্যক্রম গুটিয়ে ফেলার পরিকল্পনারই অংশ হিসেবে মনে করেন এয়ারলাইনসটির কর্মীরা।

তবে প্রতিষ্ঠানটির প্রধান পরিচালন কর্মকর্তা (সিওও) আশিষ রায় চৌধুরী জানালেন, পুনরায় কার্যক্রম চালুর প্রস্তুতি নিচ্ছে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দুটি উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য মুহূর্তে ভারতে রয়েছে। আর দেশে যে উড়োজাহাজটি রয়েছে, সেটির ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হবে। উড়োজাহাজটি বাইরে না পাঠিয়ে দেশেই মেরামত করা হবে। আগামী মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে পুনরায় ফ্লাইট শুরু করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এজন্য গত ডিসেম্বরে একটি টেস্ট ফ্লাইট চালানো হয়েছে। প্রথমে মাস্কাট দোহা রুটের ফ্লাইট পরিচালনার পরিকল্পনা রয়েছে। পাশাপাশি দুটি এটিআর-৭২ উড়োজাহাজ লিজে আনার প্রক্রিয়াও প্রায় শেষ, যেগুলো দিয়ে অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা করা হবে।

বেবিচকের বকেয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ফ্লাইট পরিচালনা থেকে আয় না থাকলেও বেবিচকে বকেয়া থাকা অর্থ পরিশোধ শুরু করেছে রিজেন্ট। এরই মধ্যে কোটি টাকা দেয়াও হয়েছে। বাকি অর্থ পরিশোধের বিষয়ে বেবিচকের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, আগে থেকেই আর্থিক সংকটে ভুগছিল রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। ২০১৯ সালের আগস্ট থেকেই কর্মীদের নিয়মিত বেতন দিতে পারছিল না এয়ারলাইনসটি। এমন অবস্থার মধ্যেই কভিড-১৯-এর সংক্রমণ রোধে গত বছর মার্চ থেকে বন্ধ হয় রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ফ্লাইটও। বেতন বকেয়া থাকায় নিজেদের দুরবস্থার বিষয়টি উল্লেখ করে গত বছরের জুনে বেবিচকে চিঠি দেয় রিজেন্ট এয়ারওয়েজের ২৮ বৈমানিক।

বকেয়া বেতনের বিষয়টি উল্লেখ করে বেবিচক চেয়ারম্যান বরাবর দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়, (চিঠি দেয়ার সময়ের আগের) ১০ মাস ধরে নিয়মিত বেতন পরিশোধ করছে না রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ। যদিও মার্চের শেষ পর্যন্ত ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন বৈমানিকরা। কিন্তু জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত কোনো বেতন না দিয়েই হঠাৎ করেই সব কর্মীকে বিনা বেতনে ছুটিতে পাঠানো হয়। পরবর্তী সময়ে মে মাসের শেষ সপ্তাহে শুধু জানুয়ারির বেতন দেয় প্রতিষ্ঠানটি।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া তথ্যে আরো জানা যায়, অর্থ সংকটের কারণে অ্যারোনটিক্যাল নন-অ্যারোনটিক্যাল চার্জ বাবদ বেবিচক এনবিআরের বড় অংকের পাওনা পরিশোধ নিয়ে জটিলতায় রয়েছে রিজেন্ট এয়ারওয়েজ। গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত রিজেন্ট এয়ারওয়েজের কাছে বেবিচকের বকেয়া পাওনা ছিল ২৩৬ কোটি লাখ ৩২ হাজার ৭০ টাকা। একইভাবে টিকিট বিক্রি করে যাত্রীদের কাছ থেকে নেয়া সরকারি রাজস্বও সময়মতো পরিশোধ করতে পারেনি রিজেন্ট এয়ারওয়েজ।

তবে ফ্লাইট পরিচালনা করে এসব পাওনা পরিশোধ করা হবে শর্তে রিজেন্টের এয়ার অপারেশন সার্টিফিকেট (এওসি) নবায়ন করছে বেবিচক। এর পরিপ্রেক্ষিতে বহরে লিজের মাধ্যমে সংযোজিত বোয়িং-৭৩৭ উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণের জন্য ডিসেম্বরে দেশের বাইরে পাঠায় রিজেন্ট। যদিও এখনো উড়োজাহাজের রক্ষণাবেক্ষণ কার্যক্রম শুরু হয়নি বলে জানিয়েছেন রিজেন্টের কর্মীরা।

নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে তারা জানিয়েছেন, রিজেন্টের পক্ষ থেকে এখনো বাবদ প্রয়োজনীয় অর্থ সংশ্লিষ্ট রক্ষণাবেক্ষণকারী প্রতিষ্ঠানকে পাঠানো হয়নি। টাকা পাঠানোর পর সবকিছু শেষ করে দেশে উড়োজাহাজ পাঠাতে সময় লাগবে দেড় মাসেরও বেশি।

তাদের মধ্যে গুঞ্জন উঠেছে, রক্ষণাবেক্ষণের নামে লিজের উড়োজাহাজ বাইরে পাঠিয়ে দিচ্ছে রিজেন্ট। পরবর্তী সময়ে ব্যবসা গুটিয়ে ফেলারও আশঙ্কা করছেন অনেকেই। রকম কিছু হলে কর্মীদের তাদের বকেয়া বেতন-ভাতা না পাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এমনকি বেবিচক এনবিআরেরও পাওনা আদায়ের জন্য কোনো উড়োজাহাজ জব্দেরও উপায় থাকবে না।

প্রসঙ্গে বেবিচকের সদস্য (ফ্লাইট স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড রেগুলেশনস) গ্রুপ ক্যাপ্টেন চৌধুরী মো. জিয়াউল কবীর বণিক বার্তাকে বলেন, বিষয়টি অত্যন্ত জটিল। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক কমপ্লায়েন্স সংশ্লিষ্ট বিষয়াদিও জড়িত। তবে বেবিচক বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপই নিচ্ছে।

ফ্লাইট বন্ধ হওয়ার আগে আন্তর্জাতিক রুটের মধ্যে কাতার, মালয়েশিয়া, ওমান, সিঙ্গাপুর ভারতে ফ্লাইট পরিচালনা করে আসছিল রিজেন্ট। বিভিন্ন দেশে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হতে থাকায় মার্চ থেকে একে একে এসব রুটের ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যায়। অভ্যন্তরীণ রুটের মধ্যে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে সপ্তাহে তিনটি ফ্লাইট চালু ছিল। সেটিও গত মার্চে বন্ধ হয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, ২০১০ সালের ১০ নভেম্বর বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনার মাধ্যমে কার্যক্রমে আসে চট্টগ্রামভিত্তিক হাবিব গ্রুপের প্রতিষ্ঠান রিজেন্ট এয়ারওয়েজ (এইচজি এভিয়েশন লিমিটেড)

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন