শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই কোচিংয়ে যাচ্ছে শিক্ষার্থীরা

সাইফ সুজন

করোনার কারণে ১০ মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সম্প্রতি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতির বিষয়ে নির্দেশনা এলেও এখন পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষে ফিরিয়ে আনার কোনো ঘোষণা আসেনি। যদিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগেই কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে কোচিং সেন্টারগুলো। বাণিজ্যিকভাবে পরিচালিত এসব কোচিং সেন্টারে নিয়মিত সশরীরে আসা-যাওয়া করছে শিক্ষার্থীরা।

তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আগে কোচিং সেন্টার খোলার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক . সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সমাগমই এখন পর্যন্ত অনুমোদন দেয়নি সরকার। সে হিসেবে শিক্ষার্থীদের কোচিংয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কোচিং সেন্টারগুলো আমাদের অধীনে পরিচালিত হয় না। তাদের বিষয়গুলো প্রশাসনের দেখার কথা। তার পরও শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয় থাকায় বিষয়ে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের পদক্ষেপ নেয়া হবে।

গত বছরের মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমণ শনাক্ত হওয়ার এক সপ্তাহের মাথায় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দেয় সরকার। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক নির্দেশনায় প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাসব পর্যায়ের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে যায়। এরপর অনলাইন দূরশিক্ষণের মাধ্যমে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেয়ার নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও এখন পর্যন্ত সশরীরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন দেয়নি সরকার। তবে এরই মধ্যে কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে বাণিজ্যিক কোচিং সেন্টারগুলো। গত কয়েক মাস ধরে রাজধানী ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় জেলা শহরে কোচিং, ব্যাচ প্রাইভেট টিউশনসহ নানা নামে কার্যক্রম চালাচ্ছে এসব প্রতিষ্ঠান। প্রশাসনের নজর এড়াতে অনেক কোচিং সেন্টার সকাল ১০টার মধ্যেই তাদের কার্যক্রম সমাপ্ত করে ফেলছে।

খুলনা শহরের আহসান আহমেদ রোডে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান। এসব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে কেন্দ্র করে ওই সড়কে গড়ে উঠেছে শতাধিক কোচিং সেন্টার। গত সপ্তাহে আহসান আহমেদ সড়কে গিয়ে শিক্ষার্থীদের স্কুল ব্যাগ কাঁধে কোচিংয়ে যেতে দেখা যায়। শিক্ষার্থীদের পিছু গিয়ে দেখা যায় সড়কের দুই পাশে বিভিন্ন বাড়িতে ভাড়া ঘরে শিক্ষার্থীদের পড়াচ্ছেন প্রাইভেট টিউটররা। আগের মতোই ব্যাচ করে কোচিংয়ে আসা-যাওয়া করছে শিক্ষার্থীরা।

গত মঙ্গলবার জেলা স্কুলের অষ্টম শ্রেণীর দুই সহপাঠী কোচিং শেষে বাসায় ফিরছিল। কথা বলে জানা যায়, গত দুই-আড়াই মাস ধরেই সশরীরে কোচিংয়ে যাচ্ছে তারা। মাস্ক পরিধান করে স্বাস্থ্যবিধি মেনেই কোচিং চলছে বলে জানায় তারা। কোন কোচিংয়ে পড়ো? জানতে চাইলে তারা গণেশ স্যারের কাছে পড়ে বলে জানায়। ওই রোডের বেশকিছু বাড়িতে গিয়ে এভাবে ব্যাচে ব্যাচে শিক্ষার্থীদের পড়ানোর চিত্র দেখা গেছে। এমনকি কোচিংয়ের বাইরে অভিভাবকদের অপেক্ষমাণ বসে থাকতেও দেখা যায়।

কথা হয় নাজনীন সুলতানা নামের এক অভিভাবকের সঙ্গে। তার ভাষ্য, দীর্ঘদিন বাসায় বন্দি থাকার কারণে ছেলে-মেয়ের মধ্যে এক ধরনের একগুঁয়েমি ভাব চলে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে কয়েক মাস আগে কোচিং থেকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। আমরা দেখলাম, শপিং সেন্টার থেকে শুরু করে সবকিছুই চলছে। তাহলে ছেলে-মেয়েরা শুধু পড়ালেখায় পিছিয়ে থেকে লাভ কী।

দেশের অন্য বিভাগীয় শহরগুলোতে খোঁজ নিয়েও একই চিত্র পাওয়া যায়। সিলেটে একাডেমিক কোচিংয়ের মধ্যে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কোচিংগুলো সশরীরে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। তবে শিশুদের কোচিংগুলো এখনো ওই হারে কার্যক্রম শুরু করেনি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং ভাষা শিক্ষা প্রদানকারী সেন্টারগুলো পুরোদমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

সিলেট জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা আইসিটি) বদরুদ্দোজা বণিক বার্তাকে বলেন, যেহেতু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, তাই কোচিং পরিচালনারও কোনো সুযোগ নেই। ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে আমরা বেশকিছু কোচিংয়ে অভিযান চালিয়েছি। এখন যেহেতু আবার অভিযোগ উঠেছে, আমরা খোঁজ নিয়ে দেখব। আর আইইএলটিএস প্রশিক্ষণের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে নয়। তার পরও তারা কীভাবে কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সে বিষয়টি খতিয়ে দেখা হবে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও কার্যক্রম চালাচ্ছে রাজশাহী শহরের কোচিং সেন্টারগুলো। বিশেষ করে নগরীর মালোপাড়া বাটার মোড় এলাকার কোচিংগুলো শিক্ষার্থীরা সশরীরে এসে ক্লাস করছেন। তবে প্রশাসনের নজর এড়াতে এখন সকাল ১০টার মধ্যেই সব ধরনের কার্যক্রম শেষ করছে রাজশাহী শহরের কোচিং সেন্টারগুলো। পর্যন্ত ধরনের বেশ কয়েকটি কোচিংয়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়েছে স্থানীয় প্রশাসন।

বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা আইসিটি) মো. কামরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের কোনো ধরনের সমাগম করা যাবে না। সে নির্দেশনার আলোকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে। যদিও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে পরিচালিত কোচিংগুলো নির্দেশনা না মেনে কার্যক্রম পরিচালনার চেষ্টা করছে। আমরা বেশ কয়েক দফায় সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে অভিযান পরিচালনা করেছি। হাতেনাতে প্রমাণ সাপেক্ষে অনেকগুলো কোচিং বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষক-শিক্ষার্থী অভিভাবকদের বিষয়ে সচেতন করার চেষ্টা করেছি।

এদিকে নভেল করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বন্ধ থাকা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে আগামী ফেব্রুয়ারির মধ্যে শিক্ষার্থী, শিক্ষক কর্মচারীদের নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। গত শুক্রবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি -সংক্রান্ত নির্দেশনা দিয়েছে মাধ্যমিক উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি) এতে খোলার বাজেট তৈরিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পাওয়া মাত্র শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার গাইডলাইনে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব পেয়েছে। তিন ফুট দূরত্বে ক্লাসরুমের বেঞ্চগুলোকে স্থাপন করতে বলা হয়েছে। পাঁচ ফুটের কম দৈর্ঘ্যের একজন শিক্ষার্থী পাঁচ থেকে সাত ফুট দৈর্ঘ্যের বেঞ্চে দুজন শিক্ষার্থী স্বাস্থ্যবিধি মেনে গাইডলাইন অনুসারে ক্লাস করতে পারবে। স্কুলে ঢোকার আগেই থার্মোমিটার দিয়ে তাপমাত্রা পরীক্ষা করার কথাও বলা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, করোনাভাইরাসের কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী ৩০ জানুয়ারি পর্যন্ত ছুটি ঘোষণা আছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন