প্রযুক্তির ব্যবহারে গতিশীল নওগাঁর শস্য বহুমুখীকরণ

আরমান হোসেন রুমন

কৃষি খাতে এতদিন নওগাঁর পরিচিতি ছিল প্রধানত ধান উৎপাদনকারী জেলা হিসেবে। তবে বর্তমানে সে গণ্ডির বাইরে বেরিয়ে আসছে জেলাটি। ধাননির্ভরতা কমিয়ে এখন শস্য বহুমুখীকরণেই বেশি মনোযোগী হয়ে উঠছেন জেলাটির কৃষকরা। এরই প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে জেলাটির শস্য উৎপাদন চিত্রেও। ধানের পাশাপাশি আবাদ বাড়ছে সবজি, ফল গম, মসলা তেলবীজের। এর মধ্যে কোনো কোনো শস্যের উদ্বৃত্ত জেলাতেও পরিণত হয়েছে নওগাঁ। এর পেছনে গত এক দশকে জেলাটির কৃষি খাতে প্রযুক্তির সম্প্রসারণ কৃষকদের আগ্রহ বৃদ্ধিকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।

কৃষি বিভাগের তথ্যতেও দেখা যাচ্ছে, গত কয়েক বছরে আবাদে বোরোনির্ভরতা কমে আসার পাশাপাশি বেড়েছে অন্যান্য ফসলের আবাদ। গত তিন বছরে পরিসংখ্যান বলছে, সময়ে বোরো ধানের আবাদ সাড়ে আট হাজার হেক্টরেরও বেশি। গমের আবাদ কমেছে হাজার ৬৩০ হেক্টর। অন্যদিকে আমনের আবাদ বেড়েছে ৩৫ হাজার ৫৮০ হেক্টর। এছাড়া আমের আবাদ ১২ হাজার ১০৫ হেক্টর, আলুর ৬১০, সরিষার হাজার ৭৫৫, সবজির ৬৬৬, ভুট্টার হাজার ৪৬৫ পেঁয়াজের আবাদ ৮৭০ হেক্টর বেড়েছে।

নওগাঁয় শস্যের বহুমুখিতা বৃদ্ধি নিয়ে কৃষকরা বলছেন, জেলায় ফসলি জমির পরিমাণ কমেছে ঠিকই। তবে ঠিক কারণেই একই জমিতে স্বল্প সময়ে একাধিক ফসল উৎপাদনের বিষয়টিতে মনোযোগ বেড়েছে তাদের। আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ এবং উন্নত জাত ব্যবহার করে বাড়তি ফসল উৎপাদন করছেন তারা। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ জেলাটির শস্য বহুমুখীকরণকে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্ববহ ভূমিকা রেখেছে।

সদর উপজেলার পাহাড়পুর গ্রামের কৃষক মাবুদ হোসেন বলেন, আগে আমরা গরু দিয়ে চাষাবাদ করতাম। কিন্তু গরু দিয়ে চাষাবাদের বিষয়টি বেশ সময় ব্যয়সাপেক্ষ। তিন-চার বছর ধরে আমাদের মধ্যে ট্রাক্টর বা পাওয়ারটিলার দিয়ে জমি চাষাবাদের প্রবণতা বেড়েছে। এতে করে জমিতে ফসল বপনের সময় ব্যয় দুটোই কমেছে।

আবাদ চর্চার পরিবর্তনের কারণে জেলায় এখন ধান-চালের পাশাপাশি অন্যান্য ফসলেরও উদ্বৃত্ত থাকছে। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, জেলায় গত তিন অর্থবছরে চালের উৎপাদন উদ্বৃত্ত ছিল ১০ লাখ টন। এছাড়া আলুর উৎপাদন উদ্বৃত্ত ছিল লাখ ৫৩ হাজার টন, আম লাখ ৬০ হাজার ৬১৫ সবজির উৎপাদন উদ্বৃত্ত ছিল ৩৯ হাজার ৯০০ টন। স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত অংশ দেশের বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেছেন কৃষকরা।

জেলার বদলগাছি উপজেলার দাউতপুর গ্রামে কৃষক আলতাফ হোসেন বলেন, আগে আমার তিন বিঘা ফসলি জমি আবাদ করতাম গরু দিয়ে। নিজের গরু না থাকায় অন্যের গরু দিয়ে জমি চাষ করতে হতো। এতে করে সময়ের দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়ার পাশাপাশি খরচও বেশি পড়ত। এখন গরুর হাল উঠেই গিয়েছে। হালচাষ করি পাওয়ারটিলার দিয়ে। প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোয় শস্য আবাদে আমার এখন সময় টাকা দুটোই কম লাগছে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে জেলায় বোরো ধানের আবাদ হয়েছে লাখ ৮২ হাজার ৪৫০ হেক্টর জমিতে। এছাড়া আউশ ৬২ হাজার ১০৪ হেক্টর জমিতে, আমন লাখ ৯৭ হাজার ২৭৯, পাট হাজার ১৫০, গম ২২ হাজার ৫০০, সরিষা ৩১ হাজার ১৭৫, আলু ২০ হাজার ৮৯০, পেঁয়াজ হাজার ৯৬০, ভুট্টা হাজার ৩৩৫, আম ২৪ হাজার ৭৭৫ সবজি ১৫ হাজার ৫৬ হেক্টর জমিতে আবাদ করা হয়েছে।

এছাড়া স্থানীয় কৃষি বিভাগও এখন কৃষকদের অল্প জমিতে বাড়তি ফসল উৎপাদন নিয়ে নানা পরামর্শ-প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। বদলগাছি উপজেলার দাউতপুর গ্রামেরই আরেক কৃষক জাহিদুল ইসলাম বলেন, আমার প্রায় ১৩ বিঘা আবাদি জমি আছে। জমিতে কখন কী প্রয়োগ করতে হবে, রোগবালাই দমনে কী কীটনাশক দিতে হবে; তার সার্বিক পরামর্শ কৃষি অফিস থেকে নিয়ে থাকি। এতে করে বাড়তি টাকা খরচ করতে হয় না। আবার ফসলও ভালো হয়। ফলে আমরা লাভবান হচ্ছি।

বিষয়ে বদলগাছি উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা হাসান আলী বলেন, অল্প জমিতে কীভাবে বেশি পরিমাণ ফসল উৎপাদন করা যায়, বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে তা কৃষকদের হাতেকলমে শেখানো হচ্ছে। সেক্ষেত্রে উন্নত ফলনের জাতের ব্যবহার বাড়ানোয় গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এছাড়া উৎপাদন খরচ কমাতে পরিবেশবান্ধব বিশেষ পদ্ধতির ব্যবহার নিয়েও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। যেমন আমরা কৃষকদের বলছি, ধানের জমিতে পাখি বসার জায়গার জন্য কয়েকটি বাঁশের কঞ্চি বা কাঠি পুঁতে দিতে হবে। এতে কীটনাশকের ব্যবহার কমবে এবং পরিবেশ ঠিক থাকবে। ধান লাগানোর সময় সারিবদ্ধভাবে রোপণ করতে হবে। এতে ফসলে সহজেই আলো-বাতাস প্রবেশ করতে পারবে। এছাড়াও কৃষকদের সুষম সার ব্যবহার করার বিষয়েও পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. শামছুল ওয়াদুদ বণিক বার্তাকে বলেন, প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে একই জমিতে এখন বাড়তি ফসল উৎপাদন করতে পারছেন কৃষকরা। রফতানির জন্য উৎপাদিত ফসলের জন্য কম পরিমাণ বালাইনাশক প্রয়োগ করার বিষয়ে কৃষকদের সার্বিক পরামর্শ দিচ্ছি আমরা, যাতে তা নিরাপদ হয়। বর্তমানে জেলার কৃষকরা কীটনাশকের ব্যবহার কমিয়ে সবজির ক্ষেত্রে সেক্স ফেরোমেন আমের ক্ষেত্রে ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। আশা করছি আগামীতে এর ব্যবহার বাড়বে। কৃষকরাও ভালো দাম পেয়ে লাভবান হবেন। চলতি মৌসুম থেকে আমরা কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণ বাড়াতে বড় ধরনের কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন