যদি প্রশ্ন করি, নব্বইয়ের দশকের বলিউডের কোন চলচ্চিত্র আপনার সামনে নিটোল, সুখী ও কাঙ্ক্ষিত পরিবারের প্রতিচ্ছবি নিয়ে হাজির হয়? আপনি একবার ভাববেন, দুবার ভাববেন অথবা একটুও না ভেবেই হয়তো বলবেন—আরে এ তো ‘হাম আপকে হ্যায় কউন’
(১৯৯৪)। একই পরিচালকের ‘হাম সাথ সাথ হ্যায়’
(১৯৯৯)-এর কথাও বলতে পারেন। তবে সেটি ২০০ কোটি রুপি আয় করা ‘হাম আপকে হ্যায় কউন’কে পেছনে ফেলতে পারে না কিছুতেই। এ চলচ্চিত্রে পুজা, মানে বাড়ির বড় বউ বা বড় বোনের যে চরিত্রটি মিষ্টি হাসি নিয়ে পরিবারের বন্ধন অটুট রাখে তিনি রেনুকা শাহানি।
এবার আমাকে প্রশ্ন করতে পারেন, ‘ত্রিভঙ্গ’
(২০২১) নিয়ে কথাবার্তার মধ্যে নব্বইয়ের দশকের চলচ্চিত্র কেন টেনে আনা? কারণ এ ত্রিভঙ্গ ছবিটির নির্মাতাও সেই মিষ্টি হাসির রেনুকা শাহানিই। এ সিনেমাতেও পরিবারের প্রতিচ্ছবি আঁকা হয়েছে। তবে এ পরিবার অনেকের মনে অস্বস্তি তৈরি করে! মাকে নাম ধরে ডাকা এবং হাসপাতালের বিছানায় মৃত্যুশয্যায় শায়িত মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আনুকে (কাজল) তামাশা করতে দেখি। মাকে ধাক্কা দিয়ে বের করেও দেয়া হয়েছে। অথচ ছবিটি অধিকাংশ দর্শকই গ্রহণ করছে। মূলধারার মিডিয়ায় ছবিটি নিয়ে ইতিবাচক আলোচনাও চলছে।
নব্বইয়ের দশকের অভিনেত্রী শাহানি অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে তিন দশকের শেষে এসে পরিচালক শাহানি হয়েছেন। নব্বইয়ের দশকের ‘নিটোল’
পরিবারের চরিত্র থেকে একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকে একটা ‘ভঙ্গুর’
পরিবারের গল্প নিয়ে হাজির হয়েছেন বড় স্ক্রিনে নয় বরং করপোরেট বেইজড ওটিটি প্লাটফর্মে। তার এ যাত্রাপথেই ত্রিভঙ্গ চলচ্চিত্রের মূল গল্প লুকিয়ে রয়েছে।
এমন নয় যে উপমহাদেশে শাহানিই এমন পরিবারের গল্প প্রথম বলছেন। কয়েক বছর আগে কাপুর অ্যান্ড সনস (২০১৬) দেখলাম, আবার এরও অনেক দিন আগে ১৯শে এপ্রিল (১৯৯৯) দেখেছিলাম।বেছে নেয়ার স্বাধীনতার প্রশ্ন যদি করি, তাহলে ‘পিঙ্ক’ (২০১৬) ‘নো মিনস নো’ বলে কঠিন সম্মতির প্রশ্ন সামনে এনেছে। আরো অনেক ছবি আছে, যেগুলো হয়তো আমার জানার বাইরে। ফলে শাহানি এমন কনটেন্ট নিয়ে প্রথম কথা বলছেন তা নয়। বরং পরিবর্তিত টেক্সট এবং প্লাটফর্মের সময়ে তিনিও এ চেঞ্জমেকারদের দলে শামিল হয়েছেন ‘ত্রিভঙ্গ’ চলচ্চিত্র নিয়ে।
তবে ‘ত্রিভঙ্গ’
গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘মা’ চরিত্রগুলোকে সমাজের প্রচলিত আদর্শের বাইরে এনে হাজির করার জন্য। বলিষ্ঠ-আউটস্পোকেন বা ‘ডিভোর্সি’
নারীর সঙ্গে তার মেয়ে সন্তানের কনফ্লিক্ট, সন্তানের ভোগান্তি এবং পরিণত বয়সে পরস্পরকে বুঝে নেয়াই এ চলচ্চিত্রের মূল উপজীব্য। মাতৃত্বের যাবতীয় ‘স্টেরিওটাইপড’
ধারণাকে আমরা এ চলচ্চিত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেখি। ‘ডিভোর্সি মা’র ‘ওপেন রিলেশনশিপ’
এখানে গল্পের প্রয়োজনে এসেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে। কিন্তু মায়ের ‘বন্ধু’
দ্বারা মেয়ের ওপর যৌন নির্যাতন এখানে মূল ঘটনা হিসেবে এসেছে। এ কারণেই অনুরাধা আজীবন তার মা নয়নতারাকে (তানভি আজমি) ঘৃণা করেছে। আবার আনুর জীবনকে নতুন করে ফিরে পাওয়া, ট্রমা থেকে বেরিয়ে আসাও ঘটেছে মায়ের পরবর্তী ‘বন্ধু’
ভাস্কর রায়নার (কানওয়ালজিত সিং) হাত ধরে। যে কিনা তাকে পিতৃস্নেহ দিয়েছে নিজের বাবার থেকেও বেশি। আনুকে পরিচয় করিয়েছে ওড়িশি নাচের সঙ্গে, আর আনুর ছোট ভাই রবীন্দ্র খুঁজে পেয়েছে তার কৃষ্ণকে, সেটাও ভাস্করের মারফতই।
শাহানি বলছেন, এটা তার সেমি-বায়োগ্রাফিক্যাল চলচ্চিত্র। অনুরাধা আপ্তে ওরফে আনু (কাজল) এখানে মূল চরিত্র হলেও তিনটি চরিত্রই আদতে নির্মাতার ভেতরের প্রতিচ্ছবি। এক সাক্ষাত্কারে শাহানি বলেছেন, ছোটবেলায় তার মা-বাবার ‘ডিভোর্স’
হয়। বিষয়টি নিয়ে স্কুলে তাকে বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে। অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের রেনুকার সঙ্গে খেলতে বারণ করতেন। বিশ্বনন্দিত নির্মাতা আলফ্রেড হিচককের কথা মনে পড়ে এখানে। খুব ছোটবেলায় দুষ্টুমির জন্য বাবা তাকে ভয় দেখাতে ৫ মিনিট জেলে বন্দি করে রেখেছিলেন। সে ভয় হিচকককে আজীবন তাড়িয়ে বেরিয়েছে। তার প্রতিফলন হিচককের বেশির ভাগ সিনেমাতেই পড়েছে। ঠিক তেমনি শাহানিও তার ছোটবেলার ক্ষত থেকেই এমন এক পরিবারের ছবি এঁকেছেন তার চলচ্চিত্রে।
স্কুলে বুলিংয়ের শিকার হওয়ার ঘটনা যেমন আনু-রবীন্দ্রর ক্ষেত্রে ঘটে, ঠিক তেমনি মাশাও স্কুলে বুলিং দ্বারা আক্রান্ত হতো বলে আমরা চলচ্চিত্রের শেষ পর্যায়ে এসে জানতে পারি। আনু চরিত্রটি আদতে রেনুকার ছোটবেলার সেই মানসিক ক্ষতের জায়গাটাকেই বিবৃত করে। ফলে চরিত্রটি অনেক লাউড, যেন অকারণে-অযথা রেগে ফুঁসে উঠছে। একটু লক্ষ করলে দেখা যায়, মূল চরিত্রগুলোকে রেনুকা শাহানি নিজের ভেতরের ইড-ইগো-সুপার ইগো—এ তিন ভাগে ব্যাখ্যা করেছেন। যেটাকে সিনেমার মধ্যে আনু ওড়িশি নাচের মুদ্রায় ব্যাখ্যা করেন। যদি একটু ভেঙে বলি তাহলে দাঁড়ায় নয়নতারা, অভঙ্গ মানে সুপার ইগো; মাশা, সমাভঙ্গ মানে ইগো আর আনু নিজে ত্রিভঙ্গ, ইড।
বাস্তব জীবনে নিজের মায়ের সঙ্গে রেনুকার সবসময়ই একটা মিষ্টি সম্পর্ক রয়েছে। ভারতের বিখ্যাত লেখিকা এবং স্ক্রিনপ্লে রাইটিংয়ের জন্য দুবার জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শান্তা গোখালের সন্তান রেনুকা তার প্রথম ছবি ‘রিটা’
নির্মাণ করেন তার মায়ের উপন্যাস রিটা ওয়েলিঙ্কার অবলম্বনে। এরপর ১২ বছর বাদে দ্বিতীয় ছবি বানিয়েছেন রেনুকা। চার বছর ধরে লিখেছেন এর স্ক্রিনপ্লে। প্রচণ্ড যত্ন করে নির্মাণ করেছেন ছবিটি। ওটিটি প্লাটফর্ম না হলে এ ছবি মুক্তি দেয়া কঠিন হতো বলেও মনে করেন এ নির্মাতা।
শক্তিশালী নারী চরিত্র নির্মাণে চলচ্চিত্রগুলোর একটা বড় অংশই নারী-পুরুষের বাইনারি সম্পর্কের মধ্যে আটকে থাকে। অথচ ‘ত্রিভঙ্গ’তে আমরা তিন প্রজন্মের নারীর সম্পর্কের পারস্পরিক বোঝাপড়া দেখতে পাই। এ চলচ্চিত্রে কোনো খল চরিত্র নেই। এমনকি নয়নতারার শাশুড়িকেও তার জায়গা থেকে কখনো খল মনে হয়নি। বরং সামাজিক কাঠামো, গতানুগতিক মূল্যবোধ আর অন্যের পছন্দকে খারিজ করে দেয়ার প্রবণতাই এখানে খল চরিত্র।
সিনেমাটিতে ব্যতিক্রমী চরিত্র মাশা। যে কিনা মা ও নানির থেকে আলাদা জীবন বেছে নিয়েছে। ধর্ম বিশ্বাসের ক্ষেত্রে মাশা ‘বাহাই’। তার জবানিতেই দর্শক জানতে পারে, এ মতাদর্শ অনুসরণকারীরা মানবতাকেই পৃথিবীর সবচেয়ে সেরা ধর্ম বলে মনে করে। মাশা একান্নবর্তী পরিবারে বিয়ে করে। কারণ পিতৃপরিচয়হীনভাবে বেড়ে ওঠা মাশা সমাজের ভয়ংকর কদাকার চেহারার মুখোমুখি হয়েছে বারবার। তাই তার সন্তানকে সে একটি ‘পরিপূর্ণ’
পরিবার দিতে চায়।
তবে সিনেমাটির গল্প, টেক্সট, স্ক্রিনপ্লের যেমন সংবেদনশীল এবং যৌক্তিক পাটাতন রয়েছে, চলচ্চিত্রের ভাষায় গল্প বলার ক্ষেত্রে ততটা মুন্সিয়ানা দেখাতে পারেননি রেনুকা শাহানি। চলচ্চিত্রের একেবারে শেষ দৃশ্য বাদে আর কোনো ইন্টেলেকচুয়াল শট দেখতে পাই না। ধারাবাহিকভাবে কিছুটা ফ্ল্যাশব্যাক আর বর্তমানকে সরলভাবে ক্যামেরায় বলে গেছেন নির্মাতা। কাহিনীর দিক থেকে সিনেমাটি দেখে মাঝে মাঝেই অগাস্টিন অ্যালমোদোভারের ভলভার (২০০৬)-এর কথা মনে হলেও সেখানে রঙ বা নান্দনিকতার যে প্রয়োগ, তার কোনোটাই সে অর্থে শাহানির ত্রিভঙ্গ: তেড়ি-মেড়ি-ক্রেজিতে খুঁজে পাই না।
সময় পাল্টাচ্ছে, সঙ্গে প্লাটফর্মও। বড় পর্দায় দর্শক গ্রহণ করতে নারাজ এমন ছবি অনায়াসে ওটিটি প্লাটফর্মে দেখতে পাচ্ছি আমরা। নব্বইয়ের দশকের ‘সেক্রিফাইসিং’
নারী, দেবী নারী মাতৃমূর্তি দেখে অভ্যস্ত চোখ গত দশক থেকে নারীর কণ্ঠস্বর শোনা যায় এমন ছবির চল দেখতে পাচ্ছে। স্বল্প পরিসরে, তবু পাচ্ছে। নারীর বেছে নেয়ার স্বাধীনতার কথা বলছেন অনেকেই।
প্রগতিশীল-প্রতিক্রিয়াশীল বাইনারি থেকে বেরিয়ে শাহানি বেছে নেয়ার স্বাধীনতার পরিসর আরেকটু বিস্তৃত করেছেন। সেজন্যই শাহানি তার চলচ্চিত্রে ৯০-এর দশকের ‘হাম আপকে হ্যায় কউন’কে খারিজ করেন না। বরং এ ধরনের পরিবারের ধারণার সঙ্গে আরো অনেক ধরনের পরিবারের ধারণা এবং ‘পছন্দ’
বা ‘বেছে নেয়ার স্বাধীনতা’কে যুক্ত করেন। যেমন আনুর পরিবার, নয়নতারার পরিবার। বরং প্রচলিত ধারণার বাইরের মা মানেই ‘খারাপ মা’
এ ধারণাকে তিনি খারিজ করেছেন। খুব স্পষ্টভাবে বুঝিয়েছেন পরিবারের জন্য, সন্তানের জন্য খারাপ মা বলে কিছু নেই। তার ভাষায় যা কিছু ত্রুটিপূর্ণ, তাই আদতে সুন্দর ও স্বাভাবিক।
মনিরা শরমিন
শিক্ষক, জার্নালিজম অ্যান্ড মিডিয়া কমিউনিকেশন বিভাগ
গ্রিন ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ