বর্তমান সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি ঘোষণা করায় আমি অভিনন্দন জানিয়ে অনুরোধ করেছিলাম সত্যি সত্যিই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সর্বশক্তি নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা হোক। কিন্তু সরকারের মেয়াদের দুই বছর অতিক্রান্ত হওয়ার পর আমার এ প্রত্যাশা ফিকে হয়ে গেছে। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে ১০ শতাংশ কর দিয়ে কালো টাকা সাদা করার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি কালো টাকার মালিকদের জন্য অভূতপূর্ব আরো কয়েকটি নতুন সুবিধা দেয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে আশ্বাস দেয়া হয়েছে, সরকার কালো টাকার উৎস সম্পর্কে কোনো প্রশ্নই করবে না। বলা হচ্ছে, এরই মধ্যে সৃষ্ট কালো টাকাকে ‘মেইনস্ট্রিমে’ নিয়ে আসা প্রয়োজন। নইলে নাকি এ টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাবে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, এ উদ্যোগগুলো পুঁজি পাচার মোটেও শ্লথ করতে পারবে না। করোনাভাইরাস মহামারী আঘাত হানার আগের ১০ বছরে বাংলাদেশ থেকে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা (৭৫ বিলিয়ন ডলার) বিদেশে পাচার হয়েছে বলে মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি’র গবেষণায় উদ্ঘাটিত হয়েছে। করোনাভাইরাস মহামারী পুঁজি পাচারকে সাময়িকভাবে শ্লথ করে দেয়ায় দেশের অর্থনীতি হয়তো এর সাময়িক সুফল ভোগ করছে। মহামারী নিরসনের পর আবারো পুঁজি পাচার চাঙ্গা হতে মোটেও বিলম্ব হবে না। সুবিধা দিলেই যে কালো টাকার মালিকরা ছুটে এসে তাদের টাকা সাদা করে নেবে এমন প্রত্যাশা অবশ্য সরকারও করে না, কিন্তু এ সুবিধা এতৎসত্ত্বেও প্রতি বাজেটে ঘোষণার মর্মার্থ হলো প্রধানত দুর্নীতিবাজদের জন্য সম্ভাব্য দুর্নীতি দমনের জাল থেকে পলায়নের পথ খুলে দেয়া। এ ব্যবস্থা রাখার মাধ্যমে কালো টাকার মালিকদের সিগন্যাল দেয়া হচ্ছে যে এ সুবিধা নিলে তাদের দুর্নীতিকে দমন করা হবে না।
আমাদের নীতিপ্রণেতারা কি জানেন না সামান্য কিছু অর্থ এসব দুর্নীতিবাজ ১০ শতাংশ কর দিয়ে বৈধ করে নিলে ওই বৈধকরণের নথিপত্রগুলো তাদের হাজার হাজার কোটি কালো টাকা নিরাপদে রেখে দেয়ার ভালো দালিলিক সুরক্ষা দেয়। কারণ টাকার গায়ে তো কালো-সাদা লেখা থাকে না? আর, ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কালো টাকা আড়াল করার ভালো ব্যবস্থা তো এ দেশে গেড়ে বসে রয়েছে যুগ যুগ ধরে! দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকতা অর্জনের মানেই হলো একটা সুনির্দিষ্ট সমঝোতা-নেটওয়ার্কের সহায়তায় দুর্নীতিবাজরা নিজেদের সুরক্ষা-ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সমর্থ হচ্ছে।
কালো টাকাকে ‘কর প্রদানের সময় অপ্রদর্শিত অর্থ’ সংজ্ঞা দিয়ে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড এ গুরুতর অপরাধটিকে হালকা করার যে অবস্থান নিয়েছে, তা সংবিধানসম্মত নয়। দেশের সংবিধানের ২০(২) ধারা বলছে, ‘রাষ্ট্র এমন অবস্থা সৃষ্টির চেষ্টা করিবেন, যেখানে সাধারণ নীতি হিসাবে কোন ব্যক্তি অনুপার্জিত আয় ভোগ করিতে সমর্থ হইবেন না’। সংবিধানের এ বিধানমতে ‘অনুপার্জিত আয়’ যদি কালো টাকা হয় তাহলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড কালো টাকার সংজ্ঞা ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ আইনি দৃষ্টিকোণ থেকে দিতে পারে কিনা সেটা আইনবেত্তাদের ভেবে দেখতে বলি। উপরন্তু, এনবিআরের এ সংজ্ঞা দুর্নীতির সঙ্গে কালো টাকার যে ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে সেটাকে অনেকটাই গৌণ বা লঘু করে দিচ্ছে কিনা তা-ও ভেবে দেখা প্রয়োজন। এটা অনস্বীকার্য যে অনেক সময় বৈধভাবে অর্জিত অর্থের ওপর ধার্য কর ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা সমাজে গেড়ে বসে থাকে। যেমন জমিজমা, অ্যাপার্টমেন্ট, প্লট, দোকান ইত্যাদি রিয়েল এস্টেট ক্রয়-বিক্রয়ে প্রকৃত দাম না দেখিয়ে কম দাম দেখালে রেজিস্ট্রেশন খরচ, স্টাম্প খরচ, সম্পদ কর ও ক্যাপিটাল গেইন ট্যাক্স ফাঁকি দেয়া যায়। অতএব, প্রায় সব ক্ষেত্রে এগুলোর মাধ্যমে কালো টাকার জন্ম হওয়াই স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এক্ষেত্রে কালো টাকাকে ‘অপ্রদর্শিত অর্থ’ বলাই সংগত। কিন্তু দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণাকারী সরকারের প্রধান লক্ষ্য তো হওয়া উচিত ‘দুর্নীতিজাত অনুপার্জিত আয়’ বন্ধ করা। দুদক অবৈধভাবে অর্জিত বা আয়ের জ্ঞাত সূত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন যেকোনো অর্থ-বিত্তকে কালো টাকা অভিহিত করার যে আইনি অবস্থানে রয়েছে সেটাকেই সাংবিধানিকভাবে আমার কাছে বেশি যৌক্তিক মনে হয়। এ সংজ্ঞা মোতাবেক মার্জিনখোর রাজনীতিবিদ, ঘুষখোর আমলা এবং মুনাফাবাজ/কালোবাজারি/চোরাকারবারি/ব্যাংকঋণ লুটেরা ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের অপরাধী সাব্যস্ত করা গেলে তাদের আইনের আওতায় এনে তাদের অপরাধের শাস্তি বিধান না করা হলে সেটা গুরুতর অসাংবিধানিক পদক্ষেপ হবে না? অর্থনীতিতে ‘নৈতিক বিপদ’ বলে একটা সাড়া জাগানো কনসেপ্টের প্রচলন করেছেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিত্জ। সৃষ্টিকর্তার কাছে কবিগুরুর প্রার্থনা ছিল, অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে, তব ঘৃণা তারে যেন তৃণসম দহে। দুর্নীতির মতো অনৈতিকতা লালনকারী কোনো সরকার নাগরিকদের কাছে কি ঘৃণার পাত্র হবে না?
বিশ্বের অনেকগুলো দেশের সাম্প্রতিক নজির থেকে দেখা যাচ্ছে, নির্বাচনী পালাবদলের মাধ্যমে তুলনামূলক সুশাসন প্রতিষ্ঠার সুযোগ পাওয়ার পর উন্নয়নের মহাসড়কে শামিল হয়েছে অনেক দেশ। হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, ফিলিপাইন, ইরান, নিকারাগুয়া, বলিভিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নের গতিপ্রকৃতি বিবেচনা করলে এর সত্যতা মিলবে। সত্তর দশক পর্যন্ত হংকং কালো টাকাকে সাদা করার নীতিতে বিশ্বাসী ছিল, কিন্তু আশির দশকে তারা সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান ইউকে অনুসরণ করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি গ্রহণ করার পর হংকংয়ের অর্থনৈতিক উন্নয়নে চমকপ্রদ গতিসঞ্চার হয়েছিল। ইন্দোনেশিয়ার সুহার্তোর ১৯৬৫-৯৮ সালের ৩৩ বছরের শাসনকে উন্নয়নতত্ত্বে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজম’ আখ্যায়িত করা হয়েছে। গত দুই দশকে তারা এ সর্বগ্রাসী দুর্নীতিকে অনেকখানি কমিয়ে আনতে সমর্থ হওয়ায় এখন ইন্দোনেশিয়ার উন্নয়নের পালেও প্রবল হাওয়া লেগেছে। স্বৈরাচারী এরশাদ আশির দশকে সুহার্তোর ওই মডেলটিকে অনুসরণ করে এ দেশে দুর্নীতিকে সর্বনাশা স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন। এরশাদ আমলের তুলনায় জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার বাড়তে বাড়তে তখনকার সাড়ে ৪-৫ শতাংশ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮ দশমিক ২ শতাংশে পৌঁছলেও এ প্রবৃদ্ধির সুফল প্রধানত কয়েক হাজার ধনাঢ্য ব্যক্তিদের কাছে পুঞ্জীভূত হয়ে চলেছে। সেজন্যই মার্কিন গবেষণা সংস্থা ‘ওয়েলথ এক্স’-এর গবেষণা প্রতিবেদনে ২০১২ থেকে ২০১৭ সাল—এই পাঁচ বছরে বাংলাদেশে ৩০ মিলিয়ন ডলার বা ২৫০ কোটি টাকার বেশি সম্পদের মালিক ব্যক্তিদের বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার নির্ণীত হয়েছে ১৭ দশমিক ৩ শতাংশ, যা বিশ্বের মধ্যে সর্বোচ্চ। এক বছর আগে একজন মন্ত্রীকে আয় ও সম্পদ বণ্টনের এ ক্রমবর্ধমান বৈষম্যকে অপরিহার্য দেখানোর জন্য এরই মধ্যে ভুল প্রমাণিত ‘কুজনেৎস কার্ভ তত্ত্ব’ আউড়াতে শুনলাম। এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো, উন্নয়ন অর্জনে সফল হওয়ার পরও আয় ও সম্পদবৈষম্য কমে না—টমাস পিকেটির সাড়া জাগানো সাম্প্রতিক গবেষণা গ্রন্থ ‘ক্যাপিটাল ইন দ্য টোয়েনটি ফার্স্ট সেঞ্চুরি’র এ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত। দুর্নীতিজাত কালো টাকা লালন থেকে সরে না এলে আয় ও সম্পদ বণ্টনের ক্রমবর্ধমান বৈষম্য থেকে বাংলাদেশের মুক্তি মিলবে না। কালো টাকা সাদা করার মতো অনৈতিক কর্মকাণ্ডকে যৌক্তিকতা দেয়ার চেষ্টা না করাই সমীচীন মনে করি।
ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ
অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়