সময়ের ভাবনা

দক্ষিণ এশিয়ায় বিনিয়োগ ও পর্যটন শিল্পে সম্ভাবনা

ড. মো. নেয়ামুল ইসলাম

বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধিষ্ণু অঞ্চল হয়েও দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনীতি প্রায়ই পুঁজি অন্তঃপ্রবাহ সংকোচন, মূল্যস্ফীতির প্রসার, রেমিট্যান্স আগমন হ্রাসের মতো নানা কারণে সমস্যায় পড়ে। অর্থনীতির এসব অভিঘাত সামলে উঠতে পারস্পরিক বাণিজ্য বিনিয়োগ সহযোগিতা জোরদারে গুরুত্বারোপ করা জরুরি। আঞ্চলিক বাণিজ্য সহযোগিতা বৃদ্ধির লক্ষ্য ছুঁতে হলে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর করাই যথেষ্ট নয়; বরং অঞ্চলের দেশগুলোর মধ্যে যৌথ উদ্যোগ গ্রহণকে প্রাধিকার দিতে হবে। এজন্য ব্যবসা বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু বৈশ্বিক ব্যবসা সহজীকরণ সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থান তলানিতে। ২০১১ সালে সার্ক দেশগুলো পুঁজিপ্রবাহ জোরদার দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিল। South Asian Trade In Services (SATIS) স্বাক্ষরের সুবাদে এখানকার দেশগুলোর জন্য পরস্পরের সেবা খাতে বিনিয়োগের পথ তৈরি হয়েছে। চুক্তিতে বাজার প্রবেশাধিকার, উত্তরোত্তর উদারীকরণ, অভ্যন্তরীণ নীতি প্রণয়ন, পারস্পরিক স্বীকৃতি, বিরোধ মীমাংসা, সুরক্ষা ব্যবস্থা ভর্তুকি-সংক্রান্ত বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অনুকূল এফডিআই নীতিমালা ভ্যালু চেইনের উপস্থিতি আন্তঃআঞ্চলিক বিনিয়োগের লক্ষ্যপূরণের চাবিকাঠি হতে পারে।  

দক্ষিণ এশিয়ায় বৈশ্বিক এফডিআইয়ের মাত্র শতাংশের গন্তব্য। হতাশাজনক অবস্থা থেকে উত্তরণে সার্ক দেশগুলোয় বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ নিশ্চিতের পাশাপাশি আঞ্চলিক ভ্যালু চেইন অথবা আসিয়ানের মতো আঞ্চলিক ভ্যালু প্লাটফর্ম প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজনীয় ভূমি না পাওয়া অথবা অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যে বিধিনিষেধ আরোপের মতো যেসব নীতিগত বাধা এফডিআই নিরুৎসাহিত করে, সেগুলো দূর করতে হবে। দুর্নীতি, আমলাতান্ত্রিক দীর্ঘসূত্রতা, সম্পত্তির মালিকানা-সংক্রান্ত জটিলতা বিনিয়োগে বাধা হিসেবে কাজ করে। সমস্যাগুলো নিরসনেও সার্কের সদস্য দেশগুলোকে কাজ করতে হবে। এফডিআই আকর্ষণের স্বার্থে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো বিভিন্ন উচ্চ প্রাধিকারমূলক খাতে করপোরেট ব্যক্তিগত আয়কর কমাতে পারে, তবে করহার কমানো নিয়ে প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে যাতে নেতিবাচক আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা না হয়, সেদিকে যত্নবান হতে হবে। 

জ্বালানি, অবকাঠামো খাতে আঞ্চলিক উপ-আঞ্চলিক প্রকল্পের গুরুত্বের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সার্ক দেশগুলো ধরনের প্রকল্পে সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব উৎসাহিত করতে পারে। ধরনের পদক্ষেপ তৈরি পোশাকসহ বিভিন্ন শিল্প সেবা খাতে আঞ্চলিক ভ্যালু চেইন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে। বিদ্যমান ভ্যালু চেইন একরৈখিক জোরদার করার পাশাপাশি নতুন ভ্যালু চেইন গড়ে তুলতে সার্ক দেশগুলোকে মনোযোগী হতে হবে। নতুন ভ্যালু চেইন গড়ার ক্ষেত্রে অনুকরণীয় অনুপ্রেরণা হতে পারে কোস্টারিকা। ২৫ বছর ধরে দেশটিতে আন্তর্জাতিক ব্যবসা বলতে কেবল কফি কলা রফতানিকেই বোঝাত। সময় অর্থনৈতিক উল্লম্ফনকে কাজে লাগিয়ে দেশটি ব্যাপকভিত্তিক ভ্যালু চেইন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হয় এবং এক পর্যায়ে দেড়শর বেশি দেশে প্রায় সাড়ে চার হাজার পণ্য রফতানি করতে থাকে। কোস্টারিকা চমত্কারিত্ব দেখাতে পেরেছে বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের সুবাদে, যার মূলে ছিল বাণিজ্যনীতি প্রণয়ন এবং বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদনে অগ্রসর উদ্ভাবনী দৃষ্টিভঙ্গি। বিনিয়োগসংক্রান্ত নীতিমালা একরৈখিক সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে হলে প্রাগ্রসর উদ্ভাবনী চিন্তাধারা প্রয়োজন। আঞ্চলিক বিনিয়োগ প্রক্রিয়াকরণে দ্রুততা আনা জরুরি। বাণিজ্যসংক্রান্ত সেবা কার্যক্রমেও গতি আনা দরকার। বিনিয়োগসংক্রান্ত নীতির হালনাগাদ তথ্য এবং সেবা প্রকল্পের দরপত্রে অংশগ্রহণ সম্পর্কিত হালনাগাদ তথ্যের সহজ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। অন্তঃবাণিজ্য, এফডিআই, ভ্যালু চেইন, বিনিয়োগ সুরক্ষা, বিরোধ নিষ্পত্তি, চুক্তি বলবত্করণ, দ্বৈত করারোপ রোধের ব্যবস্থাসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করে একটি আঞ্চলিক বিনিয়োগ চুক্তি হলে আন্তঃআঞ্চলিক বিনিয়োগে বাড়তি গতিসঞ্চার হবে। 

এছাড়া পর্যটনে বিরাট সম্ভাবনা রাখে প্রাকৃতিক সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর দক্ষিণ এশিয়া। বিশ্বের উচ্চতম পর্বতমালা হিমালয়ের অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ায় আবার সমুদ্রপৃষ্ঠের খুব কাছাকাছি অনিন্দ্যসুন্দর দ্বীপপুঞ্জ মালদ্বীপ রয়েছে অঞ্চলে। বরফাবৃত শৈলশিখর আর ঊষর মরুভূমি দুটোই দেখা যায় অঞ্চলে। পাহাড়-পর্বতে ট্রেকিং আর বেড়ানোর অসংখ্য জায়গা রয়েছে নেপাল, ভুটান, ভারত পাকিস্তানে। আবার উপকূলের কাছে বা সমুদ্রবিহারে যেতে চাইলে অবারিত সুযোগ রয়েছে ভারত, বাংলাদেশ, মালদ্বীপ শ্রীলংকায়। ভারত এরই মধ্যে মেডিকেল ট্যুরিজমে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ গন্তব্য হয়ে উঠছে। একইভাবে ইকো ট্যুরিজমকে তুলে ধরে এগিয়ে চলেছে নেপাল। সার্বিক পর্যটক অন্তঃপ্রবাহের হিসাবে ভারত, শ্রীলংকা আর বাংলাদেশের অবস্থাও আশাব্যঞ্জক। ২০১৪ সালের হিসাবমতে, সার্ক দেশগুলোয় আসা মোট বিদেশী ভ্রমণকারীর ২০ শতাংশ আন্তঃসার্ক পর্যটক। জীববৈচিত্র্য উদ্ভিদ বৈচিত্র্যের অনন্য সমাহার সার্ক অঞ্চলে জাতিগত-সাংস্কৃতিক-ধর্মীয়-ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং প্রত্নতাত্ত্বিক ঐশ্বর্যও কম নয়। আকর্ষণীয় এসব উপাদানকে কাজে লাগিয়ে ভৌগলিক নৈকট্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক-ঐতিহাসিক যোগসূত্র তুলে ধরার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে পর্যটন যোগাযোগ শক্তিশালী করার দারুণ সুযোগ রয়েছে। যৌথ সংযুক্ত ভ্রমণ প্যাকেজ, ভিসা সহজীকরণ, পারস্পরিক প্রণোদনা প্রবর্তনের মতো বিভিন্ন উপায়ে অঞ্চলের দেশগুলো পর্যটন প্রসারে আঞ্চলিক সহযোগিতার উদ্যোগ নিলে দক্ষিণ এশিয়া হতে পারে সারা বিশ্বের ভ্রমণেচ্ছু মানুষের মিলনকেন্দ্র। অঞ্চলের মানুষের মিথস্ক্রিয়া বোঝাপড়া বৃদ্ধির মাধ্যমে দক্ষিণ এশীয় সংহতি সমন্বয়ের পথ প্রশস্ত করতে হবে। কাজটি এগোতে পারে আন্তঃআঞ্চলিক পর্যটনের প্রসার ঘটলে। আন্তঃআঞ্চলিক পর্যটন বাড়লে কমে যাবে নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ অবিশ্বাস, যা কিনা বাণিজ্য বিনিয়োগের অন্যতম বাধা। 

দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলে মোট জিডিপির অর্ধেকের বেশি সেবা বাণিজ্যের অবদান। ম্যানুফ্যাকচারিং বাণিজ্যের চেয়ে দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে সেবা খাত। জিডিপিতে গুরুত্বপূর্ণ উপস্থিতির কারণে অঞ্চলের অর্থনীতির সার্বিক সমন্বয়ে সেবা খাতের তাত্পর্য অপরিসীম। সার্কের লক্ষ্য হলো সদস্য দেশগুলোর জাতীয় নীতি, অর্থনীতির আকার উন্নয়নের মাত্রা অনুযায়ী সেবা খাতের উত্তরোত্তর উদারীকরণ। তবে ঘোষিত লক্ষ্য অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়নি সার্কভুক্ত দেশগুলো। আন্তঃসীমান্ত সেবা প্রদানে বিধিনিষেধ, ভিসা জটিলতা, যোগাযোগ পরিবহন সুবিধার অপর্যাপ্ততা অঞ্চলে জনমানুষের চলাচল সীমিত করছে।

দক্ষিণ এশিয়ার বাণিজ্য সম্ভাবনা অপরিসীম। আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পেলে জোরদার হবে জনকল্যাণ প্রবৃদ্ধি। অঞ্চলের সম্ভাবনা পূর্ণ রূপায়ণের পথে কিছু বাধা রয়ে গেছে। বাণিজ্য উদারীকরণ প্রক্রিয়ায় সবসময় লাভ ক্ষতির বিষয় থাকে। চূড়ান্তভাবে সব পক্ষের জন্য লাভজনক উদ্যোগেও স্বল্পকালীন বিচারে কোনো পক্ষ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। ব্যবসায়িক কার্যক্রম বৃদ্ধি পেলে উৎপাদনশীলতায় গতি আসে, আর চূড়ান্তভাবে লাভবান হয় ভোক্তা সাধারণ নাগরিক। অনেকটা ভীরু পায়ে যাত্রা শুরু করে সাফটা। তার পরও সংস্থাটি এলডিসি নন-এলডিসি সদস্যদের জন্য পৃথক সময়সীমা নির্ধারণ করে শুল্ক হ্রাসের কর্মসূচি প্রবর্তন করেছে। সাফটার মতো সার্কের সূচনাও ঘটেছে এমন পরিপ্রেক্ষিতে, যেখানে ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে সদস্য দেশের ঐতিহাসিক বৈরিতা, অসামঞ্জস্য অর্থনৈতিক ভারসাম্য অন্যান্য সমস্যা। সাফটার বাণিজ্য উদারীকরণ কর্মসূচি (টিএলপি) বস্তুত সঠিক পথেই পদক্ষেপ। নির্ধারিত সময়সীমা অক্ষুণ্ন রেখেই টিএলপি বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। কাস্টমস পর্যায়ে সমন্বয়ের লক্ষ্যটি এখনো দূরবর্তী মনে হলেও সিইটি নির্ধারণে বাস্তবানুগ পদক্ষেপের মাধ্যমে কাজটি সহজ করা যায়। 

 

. মো. নেয়ামুল ইসলাম: অতিরিক্ত কমিশনার

কাস্টম হাউজ, বেনাপোল

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন