জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউট স্থাপনের উদ্যোগ

মেধাসম্পদ সুরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ুক

অনেক দেশেই মেধাসম্পদ সংরক্ষণে আলাদা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান আছে। বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত -সংক্রান্ত স্বতন্ত্র কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। ফলে আমরা দেশের মেধাসম্পদ ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের মালিকানা সুরক্ষায় অনেকটা পিছিয়ে। তদুপরি ২০২৬ সালে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটলে বাংলাদেশ পেটেন্ট-সম্পর্কিত নানা সমস্যারও মুখোমুখি হবে। প্রেক্ষাপটে জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউট নামে আলাদা প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেয়ার খবর মিলছে। কিছুটা দেরি হলেও ধরনের উদ্যোগ নিঃসন্দেহে অভিনন্দনযোগ্য। এখন প্রতিষ্ঠানটির দ্রুত বাস্তবায়নই জরুরি।

বিশ্ববাণিজ্য সংস্থার ট্রেড রিলেটেড প্রপার্টি রাইটস (ট্রিপস) চুক্তি এবং ১৯৯৯ সালের জিআই আইন অনুযায়ী সদস্যদেশগুলো তার দেশের ঐতিহ্যবাহী জনপ্রিয়, অনন্যসাধারণ স্বতন্ত্র পণ্যগুলোর মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের অধিকার রাখে। অধিকারবলে প্রতিটি দেশই নিজস্ব মেধাসম্পদগুলো  সুরক্ষায় বেশ তত্পর। বিশেষ করে প্রতিবেশী ভারত জিআই আইনের শুরু থেকে শত শত পণ্যের পেটেন্ট নেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করে। আমাদের দেশেও বিভিন্ন জেলা প্রত্যন্ত অঞ্চলে নানা ধরনের জিআই পণ্য ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এগুলো আমাদের রাষ্ট্রের স্বাতন্ত্র্যিক মূল্যবান মেধাসম্পদ। এসব পণ্যের কোনো কোনোটি দেশের সীমা ছাড়িয়ে রফতানিও হচ্ছে এবং ব্যাপক বাণিজ্যিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রয়েছে। অথচ প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা সংশ্লিষ্ট আইন সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞানের অভাবে আন্তর্জাতিকভাবে আমরা জিআই পণ্যগুলোর মেধাস্বত্ব নিশ্চিত করতে পারছি না। এত বছর অতিক্রান্ত হলেও মাত্র তিনটি পণ্য বাংলাদেশের জিআই পণ্য বলে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এটি হতাশাজনক। নিজস্ব মেধাসম্পদগুলোর সুরক্ষায় জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ গ্রহণ করা না হলে অনেক পণ্যের মেধাস্বত্ব হারাব আমরা। অন্য দেশ তার স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টা করবে। এর আগে জামদানির ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটেছিল। ভারতের অন্ধ্র প্রদেশের দুটি তাঁতি সংগঠন জামদানিকে তাদের বলে দাবি করেছিল। কিন্তু যথেষ্ট তথ্যপ্রমাণ দেখাতে না পারায়  পরে তা বাংলাদেশের বলে স্বীকৃতি পায়। কাজেই নতুন মেধাসম্পদ সৃষ্টির পাশাপাশি বিদ্যমান সম্পদগুলোর নিবন্ধন কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। শুধু নিবন্ধন বা স্বীকৃতি নয়, স্বীকৃত নিজস্ব পণ্যগুলোও বিশ্ববাজারে তুলে ধরতে হবে। নইলে প্রতিযোগিতা সক্ষমতায় পণ্যগুলো পিছিয়ে পড়বে। অন্যদিকে, উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হলে বিশেষ করে বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নিয়ম অনুযায়ী পেটেন্ট লাইসেন্স ছাড়া ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে না। করলেও নির্ধারিত ফি প্রদানপূর্বক করতে হবে। এতে ভোক্তাদের সাশ্রয়ী দামে ওষুধ পৌঁছে দেয়া চ্যালেঞ্জিং হবে। শুধু ওষুধ নয়, সফটওয়্যার, বইসহ নানা ক্ষেত্রে পেটেন্ট-সম্পর্কিত সমস্যায় পড়বে দেশের প্রতিষ্ঠানগুলো। সুতরাং চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় এখন থেকেই নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবনের পাশাপাশি কাঠামোগত প্রস্তুতি নিতে হবে। অবস্থায় জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ। এটিকে একটি সুপরিচালিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে সর্বতো প্রচেষ্টা নিতে হবে।

উন্নত দেশগুলো দূরে থাক, দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, শ্রীলংকা পাকিস্তানে মেধাসম্পর্কিত স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান রয়েছে। ভারতে এটি ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব পেটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক, শ্রীলংকায় দ্য ন্যাশনাল ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অফিস এবং পাকিস্তানে ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন নামে পরিচিত। বিশেষ করে ভারত শ্রীলংকা আলোচ্য প্রতিষ্ঠান কীভাবে বিন্যাস করেছে, কী ধরনের এখতিয়ার দেয়া হয়েছে, কী ধরনের নীতিমালা নেয়া হয়েছে, জনবল কাঠামো কেমন, কীভাবে পরিচালনা করছে প্রভৃতি বিষয় পর্যালোচনা করা যেতে পারে।

সত্য যে প্রতিষ্ঠান গড়ার ক্ষেত্রে আমাদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর নয়। ভালো উদ্দেশ্যে কোনো প্রতিষ্ঠান তৈরি করা হলেও পরবর্তী সময়ে এখতিয়ারগত সীমাবদ্ধতা কিংবা দক্ষতার অভাবে পরবর্তী সময়ে তা একটি অকার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউটের ক্ষেত্রে এটি বিশেষভাবে খেয়াল রাখা চাই। অতীতের প্রাতিষ্ঠানিক ত্রুটিগুলো যেন এখানে পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেই চেষ্টা করতে হবে। বৈশ্বিক দৃষ্টান্তগুলো অনুসরণ এক্ষেত্রে আমাদের জন্য সুফলপ্রদায়ী হবে বৈকি। দেখা যাচ্ছে, ভারতে সরকারি অভিভাবক প্রতিষ্ঠানটির বাইরেও মেধাসম্পদ-সম্পর্কিত বিষয়গুলো পঠন-পাঠন  এবং সংশ্লিষ্টদের দক্ষতা বাড়াতে ব্যক্তি উদ্যোগেও কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। আমাদের ব্যক্তি উদ্যোক্তাদেরও এক্ষেত্রে এগিয়ে আসা উচিত। নতুন নতুন পণ্য উদ্ভাবন তা সংরক্ষণে সরকারি-বেসরকারিভাবে গবেষণা বাড়ানোও প্রয়োজন। একইভাবে সামনের পেটেন্ট-সংক্রান্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং আগ্রহী বিদেশী বিনিয়োগকারীদের বিবেচনায় রেখে আন্তর্জাতিক বিধিব্যবস্থার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কারের কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। এটি আমলে নেয়া চাই। 

বিশ্বায়নের যুগে নিজস্ব মেধাসম্পদ জাতীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত পণ্যের অধিকার সুরক্ষায় নিস্পৃহ থাকার সুযোগ নেই। স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রতিটি পণ্যের অর্থনৈতিক সাংস্কৃতিক মূল্য বিপুল। ভবিষ্যতে একটি উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের সমৃদ্ধ বৈচিত্র্যময় প্রাণ-প্রকৃতি পণ্যসম্ভার বিশ্বের কাছে গর্বের সঙ্গে তুলে ধরতে হবে। গৃহীত উদ্যোগের মাধ্যমে মেধাসম্পদ সুরক্ষায় প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়বে বলে প্রত্যাশা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন