বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ চুক্তিভিত্তিক ইলেকট্রনিকস নির্মাতা এবং অ্যাপল ইনকরপোরেশনের অন্যতম পণ্য সরবরাহকারী পেগাট্রন করপোরেশন। তাইওয়ানভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি ভারতে আইফোন উৎপাদন কার্যক্রম শুরুর লক্ষ্যে চেন্নাইয়ের একটি শিল্প পার্কে ৫০ হাজার বর্গফুট জায়গা ভাড়া নিয়েছে। খবর ফাইন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস।
মার্কিন প্রযুক্তি কোম্পানি অ্যাপলের অন্যতম দুই পণ্য সরবরাহকারী ফক্সকন ও পেগাট্রন। উভয় প্রতিষ্ঠান তাইওয়ানভিত্তিক হলেও চীনে স্থাপিত কারখানায় আইফোনসহ অন্যান্য অ্যাপল ডিভাইস চুক্তিভিত্তিতে তৈরি করে আসছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। এ পরিস্থিতিতে চীনে অ্যাপল পণ্য উৎপাদন নিয়ে চাপে রয়েছে ফক্সকন ও পেগাট্রন।
গত নভেম্বরে ভারতে ১৫ কোটি ডলার বিনিয়োগের পরিকল্পনা প্রকাশ করেছে পেগাট্রন। ধারণা করা হচ্ছে, দেশটিতে নিজস্ব আইফোন উৎপাদন কারখানা স্থাপনে এ অর্থ ব্যয় করা হবে। পেগাট্রন যে পরিমাণ জায়গা ভাড়া নিয়েছে, তার পুরোটাই বিভিন্ন অ্যাপল পণ্য উৎপাদনে কাজে লাগানো হবে।
ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্য সরকারের একটি সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়েছে, প্রাথমিকভাবে চেন্নাইয়ের একটি শিল্প পার্কে উল্লেখিত অর্থ বিনিয়োগে পরিচালনা পর্ষদের অনুমোদন পেয়েছে পেগাট্রন। এ বিনিয়োগের অর্থ দেশটিতে উৎপাদন কারখানা নির্মাণে ব্যয় করবে প্রতিষ্ঠানটি।
ভারতের তামিলনাড়ু এখন গুরুত্বপূর্ণ মোবাইল ডিভাইস উৎপাদন হাব হয়ে উঠেছে। নকিয়া করপোরেশন, স্যামসাং, লেনোভো গ্রুপ লিমিটেড, মটোরোলা ও ফক্সকনসহ আরো বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান চেন্নাইয়ে নিজস্ব মোবাইল ডিভাইস উৎপাদন কারখানা পরিচালনা করছে।
পেগাট্রনের একটি সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের দ্বিতীয়ার্ধ কিংবা আগামী বছরের শুরুর দিকে পেগাট্রনের ভারতীয় কারখানায় পুরোদমে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হবে। এছাড়াও আগামী দুই বছরে ভারতে তাদের আরো বিনিয়োগের পরিকল্পনা রয়েছে।
পেগাট্রন গত বছর জুলাইয়ে ভারতে কারখানা স্থাপনের নিবন্ধন পায়। কিন্তু নভেল করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট কভিড-১৯ মহামারীর কারণে বিষয়টি দীর্ঘদিন স্থগিত ছিল। করোনাভাইরাসের উত্পত্তিস্থল চীন হলেও শুরুর দিকে তাইওয়ানেও বিপুলসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। গত জুলাইয়ের দিকে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করে। যে কারণে স্বাস্থ্য নিরাপত্তা এবং ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞার কারণে তাইওয়ান থেকে পেগাট্রনের কর্মকর্তাদের ভারত সফর করা অনেকটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার দেশীয় উৎপাদনে উৎসাহ দিতে প্রডাকশন লিংক ইনসেনটিভ (পিএলআই) উদ্যোগের ঘোষণা দিয়েছে। পিএলআই সুবিধা নিয়ে ভারতে উৎপাদন কার্যক্রম জোরদারের ঘোষণা দিয়েছে পেগাট্রনসহ আরো দুই অ্যাপল সরবরাহকারী ফক্সকন ও উইস্ট্রন। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের পিএলআই সুবিধা কার্যকর হয়েছে গত বছর আগস্টের শুরু থেকে। এরপর থেকে বহুজাতিক কয়েক ডজন কোম্পানি দেশটিতে উৎপাদন কার্যক্রম জোরদারে কাজ শুরু করেছে। একই সুবিধার আওতায় অ্যাপল আগামী পাঁচ বছরে ভারতে ৫ হাজার কোটি ডলার মূল্যমানের আইফোন উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। এসব ডিভাইস স্থানীয় চাহিদা পূরণের পর বৈশ্বিক বাজারে সরবরাহের পরিকল্পনা রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির, যা ভারতের অর্থনীতিকে দৃঢ় করবে বলে মনে করা হচ্ছে।
অ্যাপলের গুরুত্বপূর্ণ তিন চুক্তিভিত্তিক পণ্য সরবরাহকারীর মধ্যে ফক্সকন ও উইস্ট্রনের ভারতে উৎপাদন কার্যক্রম আগে থেকে চালু থাকলেও একমাত্র পেগাট্রনের কোনো কার্যক্রম ছিল না। এবার পেগাট্রনও মোদি সরকারের পিএলআই সুবিধার আওতায় দেশটিতে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে।
গত নভেম্বরে শিক্ষার্থীদের দ্বারা রাতের শিফটে কাজ করানোর মাধ্যমে শিক্ষার্থী শ্রম আইন ভঙ্গ করায় পেগাট্রনের সঙ্গে ব্যবসা কার্যক্রম স্থগিত করার ঘোষণা দিয়েছিল অ্যাপল। শুধু শিক্ষার্থী শ্রম আইন লঙ্ঘনই নয়; আইফোন উৎপাদন কারখানায় শিক্ষার্থীদের রাতের শিফটে ওভারটাইম কাজ করিয়ে অ্যাপল পণ্য সরবরাহকারীদের জন্য প্রযোজ্য নীতিমালাও অমান্য করার অভিযোগ করা হয়েছিল। যে কারণে ব্যবসা স্থগিত করার পাশাপাশি পেগাট্রনকে পর্যবেক্ষণে রেখেছে অ্যাপল।
ওই সময় অ্যাপলের বিবৃতিতে বলা হয়, শিক্ষার্থী কর্মীদের ভুলভাবে শ্রেণীভুক্ত করেছে পেগাট্রন এবং নীতিমালা অমান্য করার বিষয়টি আড়াল করতে মিথ্যা নথি তৈরি করেছে। কিছু ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মূল পাঠ্যবিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন কাজও তাদের দিয়ে করানো হয়েছে। যে কারণে পেগাট্রনকে পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে এবং কর্মক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠানটির অভ্যন্তরীণ নীতিমালায় কার্যকর পরিবর্তন না আনা পর্যন্ত অ্যাপলের কাছ থেকে নতুন কোনো ব্যবসায় চুক্তিতে যেতে পারবে না পেগাট্রন। বাস্তবে অ্যাপলের সঙ্গে নতুন চুক্তিতে যেতে ব্যর্থ হলে ভারতে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করে খুব একটা ব্যবসায় ফায়দা নিতে পারবে না পেগাট্রন।
অ্যাপল জানায়, তারা কয়েক সপ্তাহ আগে জানতে পারে চীনে সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান পেগাট্রন শিক্ষার্থীদের কাজে অংশ নেয়ার প্রকল্পে অ্যাপলের ‘কোড অব কনডাক্ট’
অমান্য করেছে। শিক্ষার্থীদের রাতের শিফটে কাজ করানো এবং ওভারটাইম করানোর মতো তথ্য-প্রমাণ তাদের হাতে রয়েছে। তবে পেগাট্রনের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বাধ্যতামূলক কোনো কাজ করানো কিংবা অপ্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের দ্বারা কাজ করানোর কোনো প্রমাণ মেলেনি।
শিক্ষার্থী শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অ্যাপল ব্যবস্থা নেয়ার তথ্য প্রকাশের পর পেগাট্রন ‘শিক্ষার্থী ওয়ার্কার’
প্রকল্পের প্রধানকে চাকরি থেকে অব্যাহতি দিয়েছে। এছাড়া পেগাট্রনে কর্মরত শিক্ষার্থীদের যথাযথ আর্থিক ক্ষতিপূরণসহ বাসায় পাঠানোর ব্যবস্থা করেছে। বলা হচ্ছে, অ্যাপলের পর্যবেক্ষণ কার্যক্রম ফাঁকি দিতে পেগাট্রন শিক্ষার্থী ওয়ার্কার প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা ব্যক্তিকে সরিয়ে দিয়েছে।