গত এক দশক ধরে ট্র্যাক ও ফিল্ডে আধিপত্য করে এসেছেন জ্যামাইকার শেলি-অ্যান ফ্রেজার-প্রাইস ও যুক্তরাষ্ট্রের অ্যালিসন ফিলিক্স। এ দুই নারী অলিম্পিক ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে দুর্দান্ত সফলতা পেয়েছেন। দুই পেশাদার অ্যাথলিটই এখন অন্য ভূমিকায়ও—মা। সন্তান সামলানোর প্রচণ্ড চাপের মধ্যেও ট্র্যাকের স্বপ্ন বিসর্জন দেননি। টোকিও অলিম্পিকে আবারো উঠতে চান পদকমঞ্চে। এ দুজন সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে কথা বলেছেন তাদের মাতৃত্ব, লিঙ্গবৈষম্য ও স্থগিত হয়ে যাওয়া টোকিও অলিম্পিক গেমস নিয়ে।
উসাইন বোল্টের দেশের মেয়ে ফ্রেজার-প্রাইসের ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ড বিশ্বে ধুমকেতুর মতো আবির্ভাব ২০০৮ সালে। সেবার বেইজিং অলিম্পিকে বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামের ট্র্যাকে ঝড় তুলে জ্যামাইকার প্রথম নারী হিসেবে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে অলিম্পিক স্বর্ণ জয় করেন ফ্রেজার-প্রাইস। ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকেও স্বর্ণ জয় করেন। ইনজুরির সঙ্গে লড়াই করা ফ্রেজার-প্রাইস ২০১৬ সালের রিও অলিম্পিকে ব্রোঞ্জ জয় করে প্রথম নারী হিসেবে টানা তিনটি অলিম্পিকে ১০০ মিটারে পদক জয়ের ইতিহাস গড়েন।
১০০ মিটারে তিনি দুবারের অলিম্পিক ও চারবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন। এছাড়া ২০০ মিটার স্প্রিন্টে অলিম্পিকে একবার রৌপ্য জিতেছেন, বিশ্ব শিরোপা জেতেন ২০১৩ সালে। সব মিলিয়ে, অলিম্পিকে পদক জিতেছেন ছয়টি, আর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে পদক ১১টি। বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ১১ পদকের মধ্যে নয়টিই স্বর্ণ। অলিম্পিকে দুটি ও বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে চারটি স্বর্ণ ফ্রেজার-প্রাইসের, সব মিলিয়ে স্প্রিন্ট ইতিহাসে অন্য যেকোনো নারীর চেয়ে বেশি স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন তিনি।
ফ্রেজার-প্রাইসের বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারে উত্থান-পতন যেমন রয়েছে, তেমনি ঘটনাবহুলও। পুত্র সন্তান জিওনের জন্মের কারণে দুই বছর ট্র্যাকের বাইরে ছিলেন তিনি। ফেরার পর ২০১৯ সালে বিশ্বচ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারে নিজের চতুর্থ স্বর্ণ জয় করেন। এখন তিনি আরেকটি অলিম্পিক স্বর্ণের আশায় বুক বেঁধে আছেন। সামনেই টোকিও অলিম্পিক গেমস, সেখানে জিততে চান ১০০ মিটারে তৃতীয় শিরোপা।
তবে ফ্রেজার-প্রাইস একাই শুধু মাতৃত্বের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি অ্যাথলিট হিসেবেও অনুশীলন করছেন না, এ তালিকায় রয়েছেন ছয়বারের অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন অ্যালিসন ফিলিক্সও।
আমেরিকান গ্রেট ফিলিক্স ১০০, ২০০ ও ৪০০ মিটার ছাড়াও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন দলগত রিলেতে। ২০০ মিটারে ২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিক চ্যাম্পিয়ন, তিনবারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (২০০৫ থেকে ২০০৯), দুবারের অলিম্পিক রৌপ্যজয়ী। ৪০০ মিটারে তিনি ২০১৫ সালের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন, ২০১১ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রৌপ্যজয়ী, ২০১৬ অলিম্পিকে রৌপ্যজয়ী এবং ২০১৭ বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ব্রোঞ্জজয়ী। যুক্তরাষ্ট্র নারী রিলে দলের হয়ে তিনি আরো পাঁচটি অলিম্পিক স্বর্ণ জয়ের কৃতিত্ব দেখিয়েছেন। একমাত্র নারী হিসেবে ট্র্যান্ড অ্যান্ড ফিল্ডে ছয়টি স্বর্ণ জয়ের গৌরব দেখিয়েছেন ফিলিক্স, এছাড়া নয়টি অলিম্পিক পদক জিতে মার্লিন ওটির রেকর্ডে ভাগ বসিয়েছেন। ১৮টি পদক নিয়ে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ ইতিহাসেও নারী-পুরুষ মিলিয়ে সবচেয়ে সফল অ্যাথলিট তিনি। বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সর্বোচ্চ ১১টি স্বর্ণ জয়ের গৌরবও তার।
২০১৯ সালে দোহা বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে রিলেতে দুটি স্বর্ণ জয়ের মধ্য দিয়ে সর্বকালের সবচেয়ে সফল অ্যাথলিটের গৌরব অর্জন করেন ৩৫ বছর বয়সী ফিলিক্স। কিন্তু এর মাত্র ১২ মাস আগেই তার জীবনে আসে বিরাট এক পরিবর্তন। ২০১৮ সালের নভেম্বরে জন্ম হয় তার কন্যা ক্যামরিনের। যদিও খানিকটা অস্বাভাবিকতার মধ্য দিয়ে। গর্ভকালীন উচ্চরক্তচাপজনিত জটিলতার কথা জানতে পেরে জরুরিভিত্তিকে সিজার করে তার সন্তানকে ভূমিষ্ট করাতে হয়, নইলে দুজনেরই জীবনের ঝুঁকি ছিল।
দীর্ঘ ছয় মাস পর ইনটেনসিভ কেয়ার থেকে বের করা হয় ক্যামরিনকে। যদিও এরপর নতুন লড়াইয়ে অবতীর্ণ হতে হয় ফিলিক্সকে। মাতৃত্বকালীন পাওনা নিয়ে নাইকির সঙ্গে সংকট তৈরি হয় তার। ২০১৯ সালে নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় তিনি লেখেন, মা হওয়ার পর তাকে ৭০ শতাংশ অর্থ দিতে চায় নাইকি। অবশ্য তিন মাস পর নাইকি তাদের অবস্থান থেকে সরে আসে।
এরপর কৃষ্ণাঙ্গ নারীদের মাতৃত্বকালীন মৃত্যুর বিষয় নিয়ে কাজ করেন ফিলিক্স। একজন অ্যাথলিট, একজন মা আর এমন সমাজকর্মীর ভূমিকায় দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে তিনি অনুভব করলেন যে ‘দিনে আর খুব একটা সময় হাতে থাকে না’।
ফিলিক্স বলেন, আরো পরিপক্ক একজন অ্যাথলিট হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জিং অংশ আসলে বাস্তব জীবনের দায়িত্ব। আমি একজন মা। আমি মনে করতে পারি না যে কখন আমি শুধুই অনুশীলন করতে পেরেছি। একদা আমি অনুশীলন করতাম, বিশ্রাম নিতাম...এভাবেই ছিল সবকিছু। এখন একজন মা হিসেবে অনুশীলনের পর পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ মেলে না। আমি নিশ্চিত, অনেক মানুষ এটা নিজেদের ক্ষেত্রেও ভাবতে পারেন। এটা তো আর অন্য কাজগুলোর চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়।
ফিলিক্স জানালেন, তিনি কখনই ভাবেন নি যে মা হওয়ার কারণে তার অ্যাথলিট জীবন শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু ফ্রেজার-প্রাইস সব সময়ই ভাবতেন, ট্র্যাকের জীবন শেষের পরই তিনি সন্তান নেবেন কিংবা পরিবার নিয়ে ভাববেন।
২০১৭ সালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ১০০ মিটারের খেতাব ধরে রাখার মিশনে যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তখন অনুভব করলেন, তার খুব ‘দুর্বল’ লাগছে। তিনি বলেন, গর্ভধারণের বিষয়টি আমার মাথায়ই ছিল না। বেশ কয়েকটি পরীক্ষার পর দেখতে পেলাম, আমি অন্তঃসত্ত্বা। আমি দুদিন বাসতেই কাটালাম। সত্যি বলতে কী, আমি গভীরভাবে মর্মাহত হই, কেননা আমি পরিবার শুরুর আগে ট্র্যাক ও ফিল্ডের ক্যারিয়ার শেষ করতে চেয়েছিলাম।
কিন্তু এখন জিয়নের জিয়নকাঠিতে বদলে গেছে তার জীবন। ফ্রেজার-প্রাইস জানালেন, তিন বছর বয়সী জিয়নই বাড়িটিকে মাতিয়ে রাখে। তার কথায়, আপনাকে তো এখনো অনুশীলন করতে হবে, কাজেই এখানে সৃষ্টিশীল উপায় বের করে কাজ সারতে হবে। তিন বছর বয়সী সন্তানকে নিয়ে কাজটি করা তো আসলেই দুরূহ।
লিঙ্গবৈষম্য কমছে, তবে খুব দ্রুতগতিতে নয়:
সমতার জায়গা চিন্তা করলে পুরুষ ও নারী অ্যাথলিটরা অনেক ‘দূরে’ রয়েছেন। ফিলিক্স ও ফ্রেজার-প্রাইজ উভয়ই স্বীকার করলেন, নারী অ্যাথলিটদের ভালো পারফর্ম করার চাপ যেমন রয়েছে, তেমনি কাজটি করা সময় তাদের ভালো দেখানোর বিষয়টিও বাড়তি চাপ তৈরি করে।
ফিলিক্স বিশ্বাস করেন, নারী ও পুরুষ অ্যাথলিটের আয় বৈষম্য কমানো কঠিন, কেননা কে কত আয় করেন তা প্রকাশ্যে বলা আসলে ভদ্রোচিত নয়। তিনি বলেন, আমরা কখনো কখনো অন্য উপায়ে বৈষম্য দেখি। আমরা হয়তো ভাবি, এটা বর্তমান। কিন্তু এটা পাল্টে দেয়ার আগে এখনো অনেক কাজ বাকি রয়েছে। বিভিন্ন সেক্টরের অ্যাথলিটদের দিকে তাকালে দেখব, সমতা থেকে এখনো অনেক দূরে আছি আমরা।
ফ্রেজার-প্রাইসও স্বীকার করলেন যে, বৈষম্যটা অনেক বেশি। পাশাপাশি তিনি এ-ও বললেন, ব্যবধান ক্রমেই কমে আসছে, যদিও এটি যথেষ্ট দ্রুতগতিতে হচ্ছে না। এ জ্যামাইকানের কথায়, আমাকে ভ্রুটা ঠিক করতে হয়, লিপস্টিক নিতে হয়, কেননা এভাবেই আপনাকে সবাইকে দেখতে চায়। একজন নারী হিসেবে আপনি আশা করবেন, শুধু এভাবেই যেন আমাদের দেখা না হয়। বরং আমরা কেমন পারফর্ম করি সেই বিচারেও যেন আমাদের দেখা হয়।
তিনি আরো বলেন, একজন নারীর জন্য প্রতিদিন একইভাবে সেজেগুছে থাকাটা কঠিনই। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম, আচ্ছা আমাকে এখনো যথেষ্ট ভালো দেখায় না। আরো কিছু কাজ করতে হবে। একজন পুরুষ কিন্তু একই জামাটি টানা এক সপ্তাহ ধরে পরতে পারেন এবং ট্র্যাকে নেমে দৌড়াতে পারেন। এটা বিরাট একটি সুবিধা।
অলিম্পিক স্বপ্ন থেকে এখনো বিচ্যুত হননি কেউই:
টোকিও অলিম্পিক গেমসটা ২০২০ সালে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও করোনা মহামারীর কারণে পিছিয়ে যায় এক বছর, যা আগামী ২৩ জুলাই শুরুর কথা রয়েছে। মহারারীর কারণে বিশ্বজুড়ে শোকের মাতম। স্বজন হারানোর বেদনা, সম্পদ হারানোর বেদনা কিংবা চাকরি হারানোর বেদনা—চারিদিকে হাহাকার। গেমস এক বছর পিছিয়ে যাওয়ায় বেদনা আছে ফিলিক্সেরও। তার কথায়, আমি তো লস অ্যাঞ্জেলেস-ভিত্তিক এবং সেখানে খুব কম সেন্টারই খোলা ছিল যেখানে অনুশীলন করা যায়। আমাকে রাস্তায় অনুশীলন করতে হয়েছে। আমি সর্বোচ্চ পর্যায়ে লড়াই করার মতো ফিট আছি কিনা কিংবা পদক জয়ের আশা করতে পারি কিনা, এটা বুঝতে পারাই চ্যালেঞ্জের বিষয় হয়ে ওঠে। যদিও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হইনি, কিন্তু সবকিছু ভিন্নভাবে হচ্ছে।
দুজনের জন্যই এটা শেষ অলিম্পিক গেমস। টোকিও গেমস পিছিয়ে যাওয়ায় বিরক্ত হওয়ার পেছনে বয়স একটা কারণ বলে জানালেন ফ্রেজার-প্রাইস। তিনি বললেন, দিন দিন তো আর ‘তরুণী’ হচ্ছি না! কিন্তু জ্যামাইকান স্প্রিন্টারের দৃঢ় বিশ্বাস, টোকিও অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটারে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা থেকে বয়স তাকে থামিয়ে রাখতে পারবে না।
‘পকেট রকেট’ খ্যাত এই স্ট্রিন্টার বলেন, আমি যদি সন্তানের জন্মের পর ফিরে আসতে পারি এবং এরপরও পদকমঞ্চে দাঁড়াতে পারি, তবে বয়স আমাকে থামাতে পারছে না। সম্ভবত এই প্রতিযোগিতায় আমি অন্যতম বয়োজ্যেষ্ঠ নারী, কিন্তু তাতে কী আসে যায়? আমি স্রেফ নিজের কাজটি করা ও সুখী থাকা নিয়েই ভাবছি।