সানোফি বাংলাদেশের ৫৪.৬ শতাংশ কিনছে বেক্সিমকো ফার্মা

নিজস্ব প্রতিবেদক

ব্যবসা গুটিয়ে বাংলাদেশ ছাড়ার ঘোষণা ২০১৯ সালের অক্টোবরেই দিয়েছিল ওষুধ খাতের বৈশ্বিক জায়ান্ট সানোফি। ওই সময় সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেডে থাকা শেয়ার হস্তান্তরের জন্য ক্রেতা খোঁজার কথাও জানায় প্রতিষ্ঠানটি। ঘোষণার ১৪ মাস পর শেয়ার হস্তান্তরের জন্য বেক্সিমকো ফার্মার সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। চুক্তি অনুযায়ী সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেডের ৫৪ দশমিক শতাংশ শেয়ার অধিগ্রহণ করবে বেক্সিমকো।

১৯৫৮ সালে মে অ্যান্ড বেকার নামে বাংলাদেশে ব্যবসা শুরু করে সানোফি। শুরু থেকেই বাংলাদেশে বেশ সুনামের সঙ্গে ব্যবসা করে আসছে সানোফি। ঢাকার অদূরে টঙ্গীতে রয়েছে তাদের একটি অত্যাধুনিক ওষুধ তৈরির কারখানা। তাছাড়া আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের বিভিন্ন ভ্যাকসিন, ইনসুলিন কেমোথেরাপির নানা ওষুধ বাংলাদেশে আমদানি করে থাকে সানোফি। হূদরোগ, ডায়াবেটিস, টিউমার চিকিৎসা, চর্মরোগ সিএনএসে সানোফির ওষুধ বহুলভাবে ব্যবহূত হয়। কোম্পানিটির বহুল প্রচলিত ব্র্যান্ডগুলোর মধ্যে লান্টাস, এপিড্রা, ফিমোক্সিল, ফ্লাজিল, এভিল এন্টারোজারমিন বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

দীর্ঘ ছয় দশকের পথচলায় বেশ কয়েকবার নাম বদল করেছে বাংলাদেশে সানোফির এই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ২০০৪ সালে তিনটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান অ্যাভেন্টিস বাংলাদেশ লিমিটেড, ফাইসন্স (বাংলাদেশ) লিমিটেড এবং হোয়েস্ট বাংলাদেশ ম্যারিয়ন রোজেল লিমিটেড একীভূত হয়ে সানোফি-অ্যাভেন্টিস বাংলাদেশ নাম নেয় প্রতিষ্ঠানটি। এরপর ২০১৩ সালে কোম্পানিটির নাম বদলে সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেড রাখা হয়।

দেশের ওষুধ শিল্পে একটি আস্থাশীল প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্যবসা চালিয়ে এলেও ২০১৯ সালে হঠাৎ বাংলাদেশ ছাড়ার ঘোষণা দেয় সানোফি। তখন থেকেই মালিকানা হস্তান্তরের জন্য সানোফি এমন একটি বিশ্বস্ত প্রতিষ্ঠানের সন্ধানে ছিল, যারা নৈতিক এবং বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে সানোফির পণ্য প্রচারে প্রতিষ্ঠানটির সুদীর্ঘ ঐতিহ্যের ধারা দীর্ঘ সময়ের জন্য সমুন্নত রাখতে পারবে এবং পাশাপাশি রোগী সানোফি বাংলাদেশের কর্মীদের কল্যাণে কাজ করে যাবে। অবশেষে কাঙ্ক্ষিত সেই অংশীদার হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মাকে বেছে নিল তারা। গতকাল বেক্সিমকো ফার্মা সানোফি পৃথক বিবৃতিতে শেয়ার হস্তান্তরে চুক্তিবদ্ধ হওয়ার কথা জানিয়েছে।

আগামী তিন থেকে নয় মাসের মধ্যে চুক্তিটি সম্পন্ন হবেএমন প্রত্যাশা জানিয়ে বেক্সিমকো এক বিবৃতিতে বলেছে, বেক্সিমকোর প্রস্তাবিত চুক্তিটি বাংলাদেশ সরকারের ছাড়পত্র (ফরেন এক্সচেঞ্জ ইনভেস্টমেন্ট ডিপার্টমেন্ট বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ক্রয়-বিক্রয়ের অর্থ লেনদেনের অনুমতিসহ) এবং চূড়ান্ত ক্রয় চুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। চুক্তির মাধ্যমে কোম্পানির টেকসই প্রবৃদ্ধির ভিত মজবুত হবে আন্তর্জাতিক বাজারে কোম্পানির সুনাম বৃদ্ধি পাবে। অধিগ্রহণের ফলে বেক্সিমকো হূদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার, চর্মরোগ চিকিৎসার ওষুধ ভ্যাকসিন বাজারজাতের মাধ্যমে নিজেদের উপস্থিতি অবস্থান আরো সুদৃঢ় করতে পারবে।

চুক্তির আওতায় বেক্সিমকো ফার্মা তাদের টঙ্গীর কারখানার কাছে ২৫ একর জায়গাজুড়ে অবস্থিত পিআইসি/এস অনুমোদনযোগ্য একটি সেফালোস্পিরিন অ্যান্টিবায়োটিক তৈরির কারখানাসহ অন্যান্য ওষুধ তৈরির কারখানার মালিকানা পাবে। সানোফির ভবিষ্যৎ আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডগুলো বাংলাদেশে বিপণনের ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার সুনিশ্চিত হবে চুক্তির মাধ্যমে। সানোফির সুষম ক্রমবর্ধমান পোর্টফোলিও বেক্সিমকোর বর্তমান পোর্টফোলিওকে আরো শক্তিশালী প্রসারিত করবে, যা ভবিষ্যতে কোম্পানির বিকাশ, সহজলভ্য ওষুধ অত্যাধুনিক চিকিৎসার প্রতিশ্রুতিকে জোরদার করবে।

বিবৃতিতে বেক্সিমকো ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক নাজমুল হাসান এমপি বলেন, আমরা সানোফি বাংলাদেশের প্রস্তাবিত অধিগ্রহণ সম্পর্কে জানাতে পেরে খুবই আনন্দিত। এটি আমাদের কোম্পানির ইতিহাসে দ্বিতীয় অধিগ্রহণ। এর আগে ২০১৮ সালে বেক্সিমকো ফার্মা নুভিস্তা ফার্মা (আগের অরগানন বাংলাদেশ) লিমিটেড অধিগ্রহণ করে। সানোফি বাংলাদেশের অধিগ্রহণ সানোফির শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে এমন সব থেরাপিতে কোম্পানির অবস্থান মজবুত করবে, যা ভবিষ্যতে কোম্পানির টেকসই প্রবৃদ্ধির ভিত হিসেবে কাজ করবে। আমরা বিশ্বাস করি, সানোফির অনন্য বৈচিত্র্যময় পোর্টফোলিও আমাদের বিদ্যমান পণ্য পরিসীমাকে বিস্তৃত পরিপূর্ণ করবে এবং কোম্পানির জন্য উল্লেখযোগ্য পরিমাণে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি করবে।

প্রসঙ্গত, বেক্সিমকো ফার্মা দেশের শীর্ষস্থানীয় ওষুধ প্রস্তুতকারক রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান। আমেরিকা, ইউরোপ অস্ট্রেলিয়াসহ বর্তমানে বেক্সিমকো ফার্মা বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে ওষুধ রফতানি করে। বেক্সিমকো ফার্মার শেয়ার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে লেনদেন হয় এবং এর জিডিআর শেয়ার লন্ডন স্টক এক্সচেঞ্জের অল্টারনেটিভ ইনভেস্টমেন্ট মার্কেটে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।

অন্যদিকে সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেড ফ্রেঞ্চ ফার্মাসিউটিক্যালস জায়ান্ট সানোফির একটি অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। ২০১৯ সালে সানোফি বিশ্ববাজারে ৩৬ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য বিক্রয় করে। সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেডে বর্তমানে সানোফি গ্রুপের ৫৪ দশমিক শতাংশ শেয়ার রয়েছে। অবশিষ্ট প্রায় ২৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে শিল্প মন্ত্রণালয় এবং ১৯ দশমিক ৯৬ শতাংশ বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনসের অধীনে রয়েছে।

এদিকে সানোফির পক্ষ থেকে পাঠানো বিবৃতিতে সব ধরনের শর্ত পূরণের মাধ্যমে অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া আগামী তিন থেকে নয় মাসের মধ্যে শেষ হবে বলে প্রত্যাশার কথা জানানো হয়েছে। বিবৃতিতে সানোফি বাংলাদেশ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুইন উদ্দিন মজুমদার বলেন, বিশ্বজুড়ে গ্রাহকদের সর্বোত্তম উপায়ে সেবা প্রদানের বিষয়টি প্রতিনিয়তই মূল্যায়ন করে সানোফি। তাই আমরা সবকিছু বিবেচনা করে বেক্সিমকো ফার্মাকে নির্বাচিত করেছি, যারা দেশজুড়ে আরো বেশিসংখ্যক রোগীর কাছে সানোফির পণ্য পৌঁছে দিতে বিনিয়োগ ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি বজায় রেখে সানোফির ঐতিহ্যকে বহন করে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে। একসঙ্গে আমরা আমাদের কর্মী, ক্রেতা এদেশের রোগীদের জন্য হস্তান্তর প্রক্রিয়া সুন্দরভাবে সম্পন্ন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

শেয়ার হস্তান্তর প্রক্রিয়া শেষ হলে সানোফি বাংলাদেশ একটি পৃথক বৈধ প্রতিষ্ঠান (লিগ্যাল এনটিটি) হিসেবেই থাকবে এবং কর্মীরা তাদের এখন পর্যন্ত বিদ্যমান শর্তাবলি অনুযায়ী চাকরিতে বহাল থাকবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন