স্থাপন করা হচ্ছে জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউট

মেধাসম্পদ সৃষ্টি ও বাজারজাতে দুর্বলতা দূর করার উদ্যোগ

মেসবাহুল হক

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য রয়েছে মাত্র তিনটি। এগুলো হচ্ছে জামদানি শাড়ি, ইলিশ চাঁপাইনবাবগঞ্জের ক্ষীরশাপাতি আম। রেজিস্ট্রেশনের অপেক্ষায় রয়েছে বেঙ্গল গোট, শীতলপাটি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, শতরঞ্জি, পোড়াবাড়ীর চমচমসহ আরো ১৫ পণ্য। কিন্তু -সংক্রান্ত আইন-কানুন বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান না থাকা এবং সঠিক সময়ে উদ্যোগ গ্রহণ না করায় অনেকটাই পিছিয়ে রয়েছে দেশ। এমনকি তিনটি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেলেও বিশ্বব্যাপী সেগুলোর তেমন কোনো প্রচার নেই। তবে বিষয়ে দুর্বলতা দূর করতে এবার উদ্যোগী হয়ে উঠেছেন নীতিনির্ধারকরা।

উন্নয়নশীল দেশের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধির অংশ হিসেবে মেধাসম্পদ সৃষ্টি, সংরক্ষণ বাণিজ্যিকীকরণ নিশ্চিত করতে জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউট গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। এজন্য নতুন একটি আইন প্রণয়নেরও উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইনস্টিটিউটের উদ্দেশ্য হচ্ছে মেধাসম্পদের সঙ্গে জড়িত সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা। এতে করে দেশে নতুন নতুন মেধাসম্পদ সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি এসব সম্পদ সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা হবে বলে প্রত্যাশা তাদের।

তারা বলছেন, কোনো একটি দেশের মাটি, পানি, আবহাওয়া জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি যদি নির্দিষ্ট পণ্য উৎপাদনের জন্য অনন্য ভূমিকা রাখে, তাহলে ওই পণ্যকে ওই দেশের ভৌগোলিক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। সেক্ষেত্রে পণ্যটিকেও দেশটির অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনে সক্ষম হতে হয়। ধরনের পণ্যের ভৌগোলিক স্বীকৃতি পেতে প্রথমে শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন ট্রেডমার্কস অফিসে রেজিস্ট্রেশন করতে হয়। তারপর মেধাস্বত্ব বিষয়ক বৈশ্বিক সংস্থা ওয়ার্ল্ড ইন্টেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন (ডব্লিউআইপিও) ওই পণ্যের চূড়ান্ত স্বীকৃতি দেয়। তবে শুধু স্বীকৃতি পেলেই হবে না, নিজস্ব পণ্য হিসেবে ওই পণ্যটিকে বিশ্ববাজারে পরিচিত করানোর জন্য প্রচুর প্রচার চালাতে হয়। কিন্তু -সংক্রান্ত যথাযথ জ্ঞান না থাকায় বাংলাদেশ এতদিন সে অর্থে কোনো প্রচারই চালায়নি। আবার ঐতিহ্যবাহী অনেক পণ্য থাকলেও সেগুলোকে নিবন্ধনেরও কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া অন্যতম পণ্য জামদানি শাড়ি। পণ্যটিকে ভারত নিজেদের দাবি করে বাংলাদেশের আগেই নিবন্ধন করেছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দেশটি প্রয়োজনীয় তথ্যপ্রমাণ দেখাতে না পারায় তা বাংলাদেশের পক্ষে রায় আসে। ধরনের পণ্যকে বাংলাদেশের নিজস্ব ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা দীর্ঘদিন ধরেই অনুভূত হচ্ছিল। এরই বাস্তবায়ন হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউট।

বিষয়ে শিল্প সচিব কেএম আলী আজম বণিক বার্তাকে বলেন, জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউট আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। আগামী দু-এক সপ্তাহের মধ্যেই এটি অনুমোদনের জন্য মন্ত্রিসভায় পাঠানো হবে। ধরনের কোনো প্রতিষ্ঠান বর্তমানে দেশে নেই। তবে আমরা এখন উন্নয়নশীল দেশে রূপান্তরিত হতে যাচ্ছি। সুতরাং আমাদের গবেষণা, উদ্ভাবন, মেধাস্বত্ব ধরে রাখাসহ -সংক্রান্ত অন্যান্য কাজে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। তাই ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বিষয়ে বলেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নিয়ম অনুযায়ী ফার্মাসিউটিক্যালসের ক্ষেত্রে পেটেন্ট থাকা সত্ত্বেও এলডিসি তালিকাভুক্ত দেশগুলো আগামী ২০৩৩ সাল পর্যন্ত পেটেন্টকৃত কোম্পানির অনুমোদন ছাড়াই ওষুধ উৎপাদন করতে পারবে। তবে আমরা ২০২৬ সালে যখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে চলে যাব, তখন সুবিধা আর পাব না। তখন সংশ্লিষ্ট কোম্পানির কাছ থেকে নির্দিষ্ট ফি প্রদান করে পেটেন্ট লাইসেন্স নেয়ার পর ওষুধ উৎপাদন করতে পারব অথবা নিজেদের সক্ষমতা অর্জনে ওষুধ আবিষ্কার করতে হবে। তবে সব ওষুধ পেটেন্টের আওতাভুক্ত নয়। ২০-২৫ শতাংশ ওষুধ পেটেন্টের আওতাভুক্ত। ২০২৬ সালের পর ভোক্তাদের সুলভে এসব ওষুধ পৌঁছে দেয়া নিয়ে চ্যালেঞ্জে পড়তে যাচ্ছে দেশ। এদিকে ২০২৬ সালের মধ্যে আমরা সে সক্ষমতা অর্জন করতে পারব কিনা, সে বিষয়ে সন্দেহ রয়েছে। তাই এলডিসি থেকে গ্র্যাজুয়েশনের পর বাংলাদেশ যাতে অন্তত ১২ বছর এলডিসিভুক্ত দেশের সুবিধা পায়, সেজন্যও বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) চিঠি দেয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, শুধু ওষুধ নয়, আমাদের দেশের প্রায় ৯৯ শতাংশ সফটওয়্যারই পাইরেসি হয়। বিদেশী লেখকদের দামি দামি বইও ফটোকপি করে বিক্রি করা হয়। এলডিসি দেশ হওয়ায় এসব ক্ষেত্রে তেমন কোনো সমস্যা হয় না। তবে এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে এসব ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপ করা হবে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার মাধ্যমে বাজারে তল্লাশি হওয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। তাই এসব ক্ষেত্রেও সরকার সুবিধার সময় বাড়িয়ে নেয়ার পাশাপাশি নিজেদের সক্ষমতা বাড়ানোর দিকে নজর দিচ্ছে। জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউট স্থাপনের উদ্যোগও সক্ষমতা অর্জনেরই একটি অংশ।

জাতীয় মেধাসম্পদ ইনস্টিটিউট আইন, ২০২১-এর খসড়ায় বলা হয়েছে, ইনস্টিটিউটটি একটি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হবে। শিল্প সচিবকে চেয়ারম্যান করে গঠিত এর পর্ষদে সদস্য হবেন ২১ জন। ইনস্টিটিউটের নিজস্ব একটি তহবিল থাকবে। ইনস্টিটিউটটির মাধ্যমে মেধাসম্পদ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দপ্তর, সংস্থা বা অন্যান্য সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশীজনদের মেধাসম্পদ-সংক্রান্ত বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।

বিষয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের সম্মাননীয় ফেলো . মুস্তাফিজুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, এখন এসব উদ্যোগ গ্রহণ করা খুবই প্রয়োজন। বাংলাদেশ এলডিসি থেকে বেরিয়ে গেলে এলডিসি তালিকাভুক্ত হওয়ায় এতদিন আমরা যেসব সুযোগ-সুবিধা পেতাম, সেগুলো আর থাকবে না। তাই এসব আইন ডব্লিউটিও এবং ডব্লিউআইপিওর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রয়োজনে নতুন নতুন আইনও করতে হবে। এসব না করতে পারলে পরে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।

তিনি আরো বলেন, আমরা যদি বৈদেশিক বিনিয়োগ দেশে আনতে চাই, তাহলেও তারা এসব আইন আছে কিনা, এগুলো বাস্তবায়িত হচ্ছে কিনা তা খেয়াল করবে। বিদেশী বিনিয়োগ আকর্ষণে আমরা স্পেশাল ইকোনমিক জোন করছি। এখানে যেসব বিনিয়োগকারী আসবে তারাও জানতে চাইবে আমাদের এসব আইন আছে কিনা। সব দিক বিবেচনায় নিলে আমি মনে করি, সরকারের এমন উদ্যোগ খুবই সময়োপযোগী।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন