শিল্পায়ন

উন্নয়ন ডিসকোর্সে ‘দক্ষতা’ বিতর্ক কেন ম্রিয়মাণ হচ্ছে

রবার্ট স্কিডেলস্কি

অর্থনীতি হলো সবচেয়ে কম সময় প্রচেষ্টা বিনিয়োজনের মাধ্যমে সর্বোচ্চ পরিমাণ উপযোগ-সন্তুষ্টি উৎপাদনের কৌশল সম্পর্কে জানার শাস্ত্র। বিরাজমান সীমিত সম্পদের ব্যবহার যত পরিমিত করতে পারব, নিজেদের চাহিদাগুলো পরিপূরণে তত আমরা দক্ষ হয়ে উঠব। আমাদের জীবনে দক্ষতা একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য। কারণ সত্যিকার অর্থেই এটি জীবনযাত্রার ব্যয় কমায়। আমাদের চাহিত পণ্য সেবাগুলো অর্জনে ব্যয়-সাশ্রয় এভাবে একটি অধিকতর ভালো, সচ্ছল জীবনযাপনের প্রধান চাবিকাঠি হিসেবে কাজ করে।

সত্যি বলতে কি, দক্ষতা বাণিজ্য তত্ত্বের কেন্দ্রে নিহিত। উনিশ শতকের গোড়ার দিকে অর্থনীতিবিদ ডেভিড রিকার্ডো বলেছিলেন, সর্বনিম্ন আপেক্ষিক ব্যয়ে উৎপাদন করতে পারা পণ্যগুলোর ওপর প্রতিটি দেশেরই সর্বাধিক মনোযোগ দেয়া উচিত। নোবেলজয়ী প্রয়াত অর্থনীতিবিদ পল স্যামুয়েলসন রিকার্ডোর আপেক্ষিক সুবিধা তত্ত্বকে অর্থনীতিতে সবচেয়ে চমত্কার বিষয় হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন, যা মানুষ, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এবং দেশগুলোর মধ্যকার শ্রম বিভাজনে সমানভাবে প্রযোজ্য। সৌভাগ্যক্রমে আপেক্ষিক সুবিধা তত্ত্বটি বিশ্বায়নের অন্তর্নিহিত তাত্ত্বিক মানদণ্ড হিসেবে এখনো রয়ে গেছে।

উন্নত দেশের অর্থনীতিবিদরা অনেক দিন ধরে যে শ্রম উৎপাদনশীলতা বিষয়ে বাতচিৎ করে আসছেন, তার পেছনেও দক্ষতা ইস্যুটি যুক্ত। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাজ্যে কর্মীরা প্রতি ঘণ্টায় ২০০৭ সালে যত পণ্য উৎপাদন (আউটপুট) করতেন তার চেয়ে এখনো খুব একটা বেশি করেন না। কাজেই সেখানে দক্ষতার দিক থেকে কোনো অর্জন নেই বললেই চলে। তার মানে ১৩ বছর ধরে দেশটিতে জীবনমান স্থবির। এটি শিল্প বিপ্লবের পর থেকে সবচেয়ে প্রলম্বিত স্থবিরতা। জীবনমানের স্থবিরতার প্রেক্ষাপটে উৎপাদনশীলতা-বিষয়ক ধাঁধা ব্যাখ্যার চেষ্টার অংশ হিসেবে অর্থনীতিবিদরা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গবেষণা জার্নালগুলোয় কয়েকশ প্রবন্ধ প্রকাশ করেছিলেন।

তবে উল্লিখিত বৃহত্তর দৃশ্যপটটি অনেকখানি বদলে গেছে। গুগলের এনগ্রাম ভিউয়ারস (যেটি মিলিয়ন মিলিয়ন বই কিংবা গবেষণা জার্নালে কোন কোন শব্দগুলো বেশি সামনে আসছে তার তথ্যভিত্তি ব্যবহার করে) ইঙ্গিত দেয় যে ১৯৮২ সাল থেকে দক্ষতা (ইফিশিয়েন্সি) উৎপাদনশীলতা (প্রডাক্টিভিটি) শব্দের ব্যবহার কমে এসেছে। অন্যদিকে স্থায়িত্বশীলতা (রেজিলিয়েন্স) বজায়ক্ষমতা (সাসটেইনেবিলিটি) শব্দের ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। এখন আমরা অর্থনৈতিক জীবনের বজায়ক্ষমতা সম্পর্কে বেশি কথা বলি। এর অর্থ হলো অভিঘাত মোকাবেলায় আমাদের অর্থনীতিগুলোর স্থায়িত্বশীলতা আসলে কেমন, সেটি বুঝতে আমরা এখন অধিক আগ্রহী। সুতরাং সংগতকারণেই দক্ষতায় অধিক নজর প্রদানকারী অর্থনীতিবিদরা প্রভাব বিস্তারের জায়গা থেকে বর্তমানে বেশ পিছিয়ে রয়েছে বৈকি।

উন্নয়ন ডিসকোর্সে চিন্তাগত স্থানান্তরের পেছনে মনে হয় তিনটি নিয়ামক দায়ী। প্রথমটি হলো সম্পদ ব্যবহারের কেবল বর্তমান ব্যয়ে মনোযোগ দেয়ার বেড়ে চলা উদ্বেগ, যা ভবিষ্যৎ মানবপ্রজন্মের জন্য ধরিত্রীর লভ্য সম্পদের বিলয় ঘটাবে। যেহেতু আজকে যা সস্তা তা আগামী দিনে অসম্ভব ব্যয়সাধ্য হতে পারে, সেহেতু আমাদের টেকসই প্রযুক্তিগুলোয় বিনিয়োগ করতে হবে, যেগুলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ভোক্তাদের কেবল স্বল্পমেয়াদির পরিবর্তে মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদি সুফল বয়ে আনতে পারে।

দ্বিতীয়ত, কভিড-১৯ আমাদের বৈশ্বিক সরবরাহ নিগড়ের ভঙ্গুরতা সম্পর্কে আরো বেশি সজাগ করেছে। রিকার্ডোর চমত্কার তত্ত্বটি বিভিন্ন দেশের জন্য আবশ্যকীয় পণ্যের প্রবেশাধিকার হারানো সরবরাহ ব্যাহত হওয়া-বিষয়ক একটি দুঃস্বপ্ন সৃষ্টির হুমকি তৈরি করে। কারণ তারা সবচেয়ে সস্তা বাজারগুলো থেকে পণ্য ক্রয়-সংগ্রহের যুক্তি গ্রহণ করেছে। আমরা দেখেছি মহামারীকালে পশ্চিমা দেশগুলোর অধিকাংশ নাগরিকই আবশ্যিক পণ্যের জন্য চীনের অত্যধিক নির্ভরতার কারণে ব্যাপকভাবে ভুগেছে।

শেষত, বিষয়টি ব্যাপকভাবে উপলব্ধ হয়েছে যে যেকোনো মূল্যে দক্ষতা অর্জনের পথ সন্ধান (হোক তা বিশ্বায়ন কিংবা স্বয়ংক্রিয়তার মাধ্যমে) নিরাপত্তা কর্মসংস্থানের স্থায়িত্বশীলতা হুমকিতে ফেলে। অ্যাডাম স্মিথ অনবদ্য যুক্তি দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে উৎপাদনের সমাপ্তি হলো ভোগ কিন্তু টেকসই ভোগের জন্য প্রয়োজন টেকসই আয়, যা প্রধানত আসে মজুরি থেকে। বাস্তবতা হলো, মজুরি ছাড়া ভোগের সুযোগ আছে এমন কোনো ব্যবস্থা আমাদের সামনে নেই। প্রকৃতপক্ষে, দক্ষতার নামে আমরা এতদিন বিপুল সম্পদ আয় অসমতা বাড়ার সুযোগ দিয়েছি।

অর্থনীতিবিদরা সাধারণত সুযোগ ব্যয়গুলো নিয়ে বলতে আগ্রহী। কিন্তু তারা বজায়ক্ষমতার জন্য দক্ষতা-বিষয়ক সুযোগ ব্যয়ের প্রয়োজনীয়তা বিষয়ে অদ্ভুতভাবে অন্ধ থেকেছে, বিশেষ করে সময়ান্তরে দক্ষতা ধারণা বিস্তৃত করার ক্ষেত্রে। এটি প্রধানত কারণে যে সমসাময়িক অর্থনীতিবিদদের ভারসাম্য মডেলগুলো (ইকুইলিব্রিয়াম মডেল) সময়ের কোনো প্রবিধান তৈরি করে না এবং ভবিষ্যেক নিছকই বর্তমানের সম্প্রসারণ হিসেবে বিবেচনা করে। তারা মনে করে যে আজকে যা দক্ষ সেটিই আগামীকাল এবং সারা জীবন দক্ষ থাকবে।

তবে জন মেইনার্ড কেইনস যেমনটা উল্লেখ করেছিলেন যে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ নেই যে যেসব শর্তের কারণে আজকে মুক্ত বাণিজ্য, বৈশ্বিক সরবরাহ নিগড়, স্বয়ংক্রিয়তা এবং ন্যূনতম মজুরি (পভার্টি ওয়েজ) দক্ষ প্রমাণ হয়েছে, তা অব্যাহত থাকবে। ইকোনমেট্রিসিয়ান (ভবিষ্যৎ নোবেলজয়ী) জ্যান টিনবারজেনের একটি প্রতিক্রিয়ার বিপরীতে কেইনস যেমনটা প্রশ্ন তুলেছিলেন, ভবিষ্যৎ কি অতীত পরিসংখ্যানের নির্দিষ্ট কাজ মাত্র? ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত প্রত্যাশা আত্মবিশ্বাসের আদৌ কতটা জায়গা আছে? বিভিন্ন ধরনের হস্তক্ষেপ, রাজনীতি, শ্রম অসন্তোষ, যুদ্ধ, ভূমিকম্প আর্থিক সংকটের মতো নিয়ামকগুলোর জন্য কতটা সুযোগ আছে? বর্তমান প্রেক্ষাপটের আলোকে আমরা সমকালীন ঝুঁকির ধরনের একটি তালিকা তৈরি করতে পারি।

বলা হয়ে থাকে, অর্থনৈতিক নীতিনির্ধারকদের পূর্বসতর্কতামূলক নীতি বা ন্যূনতম ক্ষতির নীতি-তে অধিক মনোযোগ দেয়া জরুরি, যা সর্বোচ্চ সুফলের চেয়ে নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যেই প্রণীত হয়। অর্থনীতিবিদ ভ্লাদিমির মাশ অ্যাপ্রোচকে ঝুঁকি প্রশমন সর্বোচ্চকরণ (রিস্ক কনস্ট্রেইনড অপটিমাইজেশন) আখ্যা দেন এবং এটিকে এই শতাব্দীর ব্যাপকভাবে বিপজ্জনক, অনিশ্চিত জটিল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। আংকিক মডেলিং ব্যবহার করে মাশ ধরনের কয়েকটি ঝুঁকি প্রশমন কৌশল বিনির্মাণ করেছিলেন।

অবশ্য ধরনের আগামদর্শী সিদ্ধান্ত গ্রহণ নীতিগুলো আমাদের চিন্তার কিছু অস্বস্তিকর রেখায় পরিচালিত করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বিশ্ব জনসংখ্যার বিষয়টি উল্লেখ করা যেতে পারে। বিশ্ব জনসংখ্যার অনিয়ন্ত্রিত বৃদ্ধি আসলে কতটা টেকসই? যথাসময়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখতে আমাদের অবশ্যই বিজ্ঞান শিক্ষার ওপর আস্থা রাখতে হবে, কিন্তু আমরা জানি না যে তার জন্য আমাদের কতটা সময় আছে। কাজেই ম্যালথুসীয় উদ্বেগের নিশ্চিতভাবে ভিত্তি আছে যে জনসংখ্যার অব্যাহত বৃদ্ধি বিশ্বে বিরাজমান সম্পদের প্রাপ্যতা সংকুচিত করে। এর পরিণাম হলো বড় মাত্রায় প্লেগ, দুর্ভিক্ষ, বন্যা যুদ্ধ সংঘটন, যা ঐতিহাসিকভাবে অতিজনসংখ্যা হ্রাস করে এসেছে।

একইভাবে একটি টেকসই প্রযুক্তি নিশ্চিতভাবে কেবল আমাদের অভিযোজনক্ষমতার তীব্র চাহিদা সৃষ্টি করে তা নয়, বরং অর্থনৈতিক সামাজিক প্রাচুর্য হুমকিতে ফেলে এবং অনুমানযোগ্য রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়াও তৈরি করে। আমরা বর্তমানে প্রযুক্তিগত অগ্রগতিকে এককভাবে দক্ষতার লেন্স দিয়ে দেখি এবং ব্যয়-সাশ্রয়ী বাজার প্রতিযোগিতা দ্বারা এর গতিবেগ নির্ধারণের সুযোগ দিই। ভবিষ্যতদর্শী নীতিগুলো অন্য উপায়গুলোর চেয়ে মানুষের প্রযুক্তি অভিযোজনে বেশি জোর দেয়।

চূড়ান্তভাবে, ঝুঁকি সামলানোয় দক্ষ যুক্তিতে পর্যায়ক্রমিকভাবে তার আর্থিক ব্যবস্থাকে ক্রাশ করতে অবশ্যম্ভাবীভাবে সুযোগ দেয়া পুঁজিবাদী রাজনৈতিক অর্থনীতি আসলে কতটা টেকসই?

যত দূর দেখা যাচ্ছে, আমরা কেবল এসব প্রশ্নের উপরিতলে হাতড়িয়েছি। কিন্তু দক্ষতা বজায়ক্ষমতার ভাষা যেহেতু রূপান্তরিত হচ্ছে, সেহেতু নতুন বিন্যাসে অবশ্যই সেগুলোকে অর্থনৈতিক চিন্তায় ধরতে হবে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

রবার্ট স্কিডেলস্কি: ব্রিটিশ হাউজ অব লর্ডসের সদস্য ওয়ারউইক বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনৈতিক অর্থনীতির ইমেরিটাস অধ্যাপক

ভাষান্তর: হুমায়ুন কবির

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন