যুক্তরাষ্ট্র

উদারপন্থী বাইডেনের জন্য বলছি

কৌশিক বসু

যেকেনো দেশে কর্তৃত্ববাদী সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠার প্রথম ধাপ বা পদক্ষেপটি হচ্ছে নাগরিকদের ভুল পরিসংখ্যানের দিকে ঠেলে দেয়া। কাজটি করা কিন্তু খুব একটা কঠিন কিছু না। আর বাকিটা হচ্ছে পাল উড়িয়ে শান্তভাবে বসে থাকার মতো সহজ। যুক্তরাষ্ট্রের সৌভাগ্য যে হোয়াইট হাউজ ছেড়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু বিদায় নেয়ার আগে অঘটনঘটনপটীয়সীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে যে কাণ্ডগুলো তিনি ঘটিয়েছেন সেসবের রেশ কিন্তু সহজে কাটবে না। ট্রাম্প প্রশাসন যে উপায়ে কভিড-১৯ মহামারী বিজ্ঞান পরিসংখ্যানগুলো সামলিয়েছে তাতে জনস্বাস্থ্য অর্থনীতির ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। তাই জো বাইডেনকে ঘিরে স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে যে তিনি ট্রাম্পের বিপরীত পথেই হাঁটবেন এবং অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবেন। স্বভাবতই ট্রাম্পের মতো বোকামিগুলো তিনি করবেন না। তিনি তার কাজের শুরুটা করতে পারেন কভিডের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত নিম্ন আয়ের মানুষদের সাহায্য করার মধ্য দিয়ে।

তবে বাইডেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসের সামনে আমি আরো বৃহৎ কর্মযজ্ঞ তুলে ধরতে চাই। উগ্র জাতীয়তাবাদী আত্মরতিতে ভরপুর ট্রাম্প তার ক্ষমতায় থাকা দিনগুলোতে শুধু গোটা আমেরিকার মেরুকরণই ঘটাননি, বরং বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী কর্তৃত্ববাদ উত্থানের ইন্ধন জুগিয়েছেন। তিনিসহ তার সমর্থকেরা বস্তুগত সম্পদ ভোগে ঘোরগ্রস্ত। তারা মৌলিক মানবিক শিষ্টাচার, সহানুভূতি পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে উপেক্ষাস্বরূপ বহিরাগত বা অপর-এর প্রতি মনে মনে এক ধরনের বিদ্বেষ পোষণ করেন। বিশ্বায়নের দুনিয়ায় তাদের আখ্যায়িত অপর-দের যেন কোথাও জায়গা দিতে নেই।

উগ্র জাতীয়তাবাদী বোধে আক্রান্ত নাগরিকদের বেশির ভাগই উপলব্ধি করে না যে তারা লোভী, অসাধু রাজনীতিবিদ বিত্তবান নেতাদের দুর্দান্ত আহার। আগেও আমি বিভিন্ন জায়গায় যুক্তি দিয়ে বলেছি, জীবনে আমরা যেসব লক্ষ্য অর্জনের জন্য লড়াই করি সেগুলো কিন্তু আমাদের সহজাত ব্যাকুলতা নয়যেমনটা মূলধারা অর্থনীতিতে ধরা হয়। বরং এগুলো অনেকটা খেলোয়াড়সুলভ লক্ষ্য তৈরি করে তা পূরণের মতো। জাতীয়তাবাদও অনেকটা তালিকায় পড়ে।

তাই আপনার রাষ্ট্রের ধনী ব্যক্তিদের অন্য রাষ্ট্রের বিত্তবানদের নিয়ে করা চিন্তাগুলোকে পুঁজি করে উত্তেজনা উসকে দেয়ার এক ধরনের ব্যবসায়িক স্বার্থ থাকতে পারে। বিজ্ঞাপন, বিনয়ী প্রতিবেদন উগ্র জাতীয়তাবাদীদের মাধ্যমে প্রতিযোগিতাগুলোকে ছড়িয়ে দিয়ে দম বন্ধ করে দেখার অপেক্ষা করতে হবে যে বৈশ্বিক তালিকার শীর্ষে আপনার দেশের ধনীদের নাম আছে কিনা।

এরপর উত্তেজনাগুলো একটি নির্দিষ্ট স্তরে পৌঁছার পর নিজ দেশের জাতীয় চ্যাম্পিয়নের সুযোগ বৃদ্ধির জন্য এমন একটি তহবিল গঠনের কাজ শুরু করুন, যেখানে রাষ্ট্রের সব নাগরিক অংশ নিতে পারে। তারা প্রতিযোগিতায় জয়ী হোক বা না হোক, নিজ দেশের জাতীয়তাবাদীদের বোকামির দ্বারা এই ধনী ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কয়েকজন ব্যক্তি অবশ্যই আরো ধনী হতে সক্ষম হবেন।

-জাতীয় প্রচারণাগুলো এরই মধ্যে সূক্ষ্ম উপায়ে কাজ করছে এবং বৈশ্বিক দুশ্চিন্তা তৈরি করছে। যদি এর উল্টোটা না হয় বা প্রক্রিয়াগুলোকে থামানো না যায়, তাহলে তা যথেষ্ট ক্ষতির কারণ হতে পারে। তাই আমেরিকা গোটা পৃথিবীর স্বার্থেই বাইডেন প্রশাসনকে -বিষয়ক চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করতে হবে। আর কাজে অবশ্যই আবারো আমেরিকাকে সেরা বানানো লক্ষ্য নিয়ে তারা অগ্রসর হবেন না (যদিও চার বছর ধরে কাজটি করার অনেক সুযোগ ট্রাম্প তৈরি করে দিয়ে গেছেন) আমেরিকান প্রেসিডেন্টকে বৈশ্বিক উচ্চতায় পৌঁছে শোভন কাজ করতে হলে বিশ্বের অসুখগুলোকে চিহ্নিত করতে হবে। আর এজন্য বাইডেনের অবশ্যই আন্তর্জাতিকতাবাদী মনোভাবাপন্ন হওয়া জরুরি।

প্রাচীন অর্থনীতি ছিল শিকার অন্বেষণভিত্তিক। মানুষের জীবন সংজ্ঞায়িত হতো তাদের গোত্রের প্রতি আনুগত্য দিয়ে। পদ্ধতিটি ভালোভাবেই টিকে গিয়েছিল। একসময় আমাদের পূর্বপুরুষরা কৃষিকাজ শেখার সঙ্গে সঙ্গে আরো অনেক কাজে দক্ষ হয়ে উঠলেন। তারা তাদের সংকীর্ণ আনুগত্য থেকে মুক্ত হয়ে প্রবেশ করলেন জাতি-ধর্মের বিস্তৃত গণ্ডিতে। নতুন নতুন উদ্ভাবন উৎপাদনের মাধ্যমে অর্থনীতির আকার বাড়তে শুরু করল। গোটা অঞ্চল বিভিন্ন ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে বিশেষায়িত হয়ে উঠল। আমাদের আনুগত্য বশ্যতার পরিধি আবারো আরো বড় হলো। শেষমেশ আমাদের মূল পরিচয় হয়ে দাঁড়াল জাতীয়তা। একদা আমরা আমাদের গোত্র, জাতি কিংবা পরিচয় আর স্বীকৃতির অন্যান্য যে নিদর্শন নিয়ে অহংকার করতাম, ঠিক একইভাবে আমরা আমাদের নিজ রাষ্ট্র জাতীয়তা নিয়ে গর্ব করতে শিখলাম।

আজ আমরা জাতি বর্ণের আধিপত্যকে লজ্জাজনক হিসেবে মনে করছি। আমি বিশ্বাস করি, নিকট ভবিষ্যতে এমন একটি সময় আসবে, যখন জাতিগত অহংকারের বিষয়টি নিয়ে আমরা ঠিক এমনটাই বিব্রত হতে শুরু করব। যেমনটা আমরা এখন শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদ, জাত কিংবা ধর্মভিত্তিক চক্রগুলো যা অন্যকে বাদ দেয় শোষণ করে তাদের ঘিরে বিব্রত হচ্ছি।

বর্তমানে আমরা এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছেছি, যেখানে আমাদের মানব পরিচয়কে অবশ্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা জরুরি। সৌভাগ্যবশত দার্শনিক, কয়েকজন সুশীল রাজনীতিবিদ, এমনকি কিছু ধর্মীয় নেতা ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছেন যে জাত-পাত, ধর্ম জাতীয় আধিপত্যের ধারণাগুলো নৈতিকভাবেই অগ্রহণযোগ্য।

বৃহত্তর পরিচয় উন্নয়নের নৈতিক জরুরত বাদ দিয়ে আমরা আমাদের ইতিহাসের এমন একটি পর্যায়ের কাছাকাছি পৌঁছেছি, যেখানে সীমিত জাতীয়তাবাদ আর কার্যকর হবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে বিশ্বায়ন দ্রুতগতিতে এগিয়েছে। গত তিন-চার দশকে ডিজিটাল প্রযুক্তির উত্থান বিশ্বকে আরো বেশি সমান্তরাল করেছে। তাই বর্তমানের অর্থনৈতিক বিশ্বায়ন আর কোনোভাবেই রাজনৈতিক ভলকানাইজেশনের অন্তর্ভুক্ত উগ্র জাতীয়তাবাদের সঙ্গে খাপ খায় না।

অবশ্য আমেরিকার বৈদেশিক নীতির ইতিহাস কোনোভাবেই ত্রুটিমুক্ত নয়। তবে তারা যদি সক্রিয়ভাবে আবারো বিশ্বের সঙ্গে সংযুক্ত হয় এবং শুধু নিজ স্বার্থ আগ্রহের দিকে দৃষ্টি না দেয়, তবে অনুঘটকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে। জো বাইডেন কমলা হ্যারিসের বিষয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ার পাশাপাশি অনেক ওপরে দৃষ্টি স্থাপন জরুরি। শুধু নিজেদের স্বার্থে নয়, বরং গোটা বিশ্বকে একটি শোভন জায়গায় পরিণত করার লক্ষ্যে আমেরিকার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের প্রয়োজন রয়েছে।

[স্বত্ব:
প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
]

 

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ আমেরিকার কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক

ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন