কভিডেও ‘ক্যাশ কিং’ স্কয়ার ফার্মা

বদরুল আলম ও মেহেদী হাসান রাহাত

কভিড-১৯ মহামারীর সময়ে নগদ অর্থের হাহাকার চলছে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোয়। পরিস্থিতিতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ কোম্পানিগুলোকে ব্যবসায় টিকিয়ে রাখতে প্রণোদনা সহায়তা দিয়েছে। বাংলাদেশেও করোনার ক্ষত থেকে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে লাখ ২০ হাজার কোটি টাকার বেশি প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে সরকার। এর মধ্যে ৪০ হাজার কোটি টাকাই দেয়া হয়েছে বৃহৎ শিল্প সেবা খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে।

নগদ অর্থ সংকটে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর যখন নাকাল অবস্থা, তখন দেশের একটা কোম্পানি নিয়ে একেবারেই নিরুদ্বেগ। পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত ওষুধ খাতের শীর্ষ কোম্পানিতে কয়েক বছর ধরেই নগদ অর্থের ভাণ্ডার স্ফীত হচ্ছে। করোনার মধ্যেও নগদ উদ্বৃত্ত ছিল স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালস লিমিটেডে। প্রতিষ্ঠানটির নগদ প্রবাহ এতটাই সবল যে স্বল্প দীর্ঘমেয়াদি ঋণ তো দূরে থাক, চলতি মূলধনের জন্যও ব্যাংকের দ্বারস্থ হওয়ার প্রয়োজন পড়ছে না তাদের।

স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের পাঁচ বছরের আর্থিক প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, সময়ে কোম্পানিটির নগদ অর্থের পরিমাণ প্রায় চার গুণ বেড়েছে। ২০১৫-১৬ হিসাব বছরে কোম্পানিটির নগদ অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৫২ কোটি টাকা। ২০১৬-১৭ হিসাব বছরে এর পরিমাণ বেড়ে হাজার ৫৭৭ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। এটি আরো বেড়ে ২০১৭-১৮ হিসাব বছরে হাজার ৬৯৮ কোটি, ২০১৮-১৯ হিসাব বছরে হাজার ৭০০ কোটি এবং ২০১৯-২০ হিসাব বছরে হাজার ২৫৬ কোটি টাকায় উন্নীত হয়। এমনকি কভিডের সময়েও চলতি ২০২০-২১ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের নগদ অর্থ বেড়ে হাজার ৬৮৩ কোটি টাকায় দাঁড়িয়েছে।

কোম্পানিটির কাছে এত বেশি নগদ অর্থ রয়েছে যে অনায়াসেই তাকে ক্যাশ কিং হিসেবে অভিহিত করা যায়। অবারিত নগদ অর্থের কারণে গত পাঁচ বছর ধরেই ব্যবসা চালাতে কোনো ধরনের ঋণের প্রয়োজন পড়ছে না স্কয়ারের। এতে ঋণের বিপরীতে সুদ বাবদ ব্যয় থেকেও মুক্তি পেয়েছে কোম্পানিটি। এমনকি কভিডের সময়ে যেখানে দেশের অধিকাংশ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ঋণের কিস্তি বিলম্বে পরিশোধ নগদ প্রণোদনার জন্য সরকারের কাছে ধরনা দিয়েছে, সেখানে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসকে অর্থের জোগান নিয়ে কোনো চিন্তাই করতে হয়নি। উদ্বৃত্ত নগদ অর্থের মাধ্যমে ধারাবাহিকভাবে ব্যবসা সম্প্রসারণ করে যাচ্ছে কোম্পানিটি। কোম্পানিটির আর্থিক স্বাস্থ্য সবল রাখার ক্ষেত্রেও বড় ভূমিকা রাখছে নগদ অর্থের প্রবাহ।

নগদ অর্থের উদ্বৃত্তে স্কয়ারের সফলতার বিষয়গুলো একবাক্যে বলা কঠিন। তবে কোম্পানি সংশ্লিষ্টরা বলেন, পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে টাকায় টাকা হয় (মানি জেনারেটস মানি) স্কয়ার যে অর্থ জেনারেট করে, সেটা তিন ভাগে ভাগ হয়। আয়ের একটা অংশ যায় সরকারের কাছে রাজস্ব হিসেবে। একটা অংশ যায় কর্মীদের বেতন হিসেবে। আরেকটা অংশ ডিভিডেন্ড এবং রিটেইন আর্নিং হিসেবে থাকে, যেটা ভবিষ্যৎ মানি জেনারেশনকে গতিশীল করতে ভূমিকা রাখে।

কঠিন সময়েও নগদ অর্থের উদ্বৃত্ত কীভাবে জানতে চাইলে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তপন চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, প্রথম কথা হচ্ছে, অবশ্যই এটা আমাদের একটা কৌশলগত সিদ্ধান্ত। আমরা ঋণের ওপর নির্ভরশীল হইনি। চেষ্টা করেছি কোম্পানি যেন হেলদি থাকে। কোম্পানি শেয়ারহোল্ডারদের ওপর অতিরিক্ত চাপ যেন সৃষ্টি না হয়। দ্বিতীয় যে বিষয়টি উল্লেখ করা প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, পরিস্থিতির মধ্যেও আমরা ধারাবাহিকভাবে বিনিয়োগ করে যাচ্ছি। শুধু দেশের মধ্যে না, দেশের বাইরেও বিনিয়োগ করতে চাই। সরকারকে বলেছি, আমাদের অর্জিত বিদেশী মুদ্রার বিপরীতে দেশের বাইরে পুঁজি বিনিয়োগের সুযোগ করে দিতে। সুযোগ কাজে লাগিয়ে আমরা এরই মধ্যে কেনিয়াতে বিনিয়োগ করেছি। আশা করছি, বছরের তৃতীয় প্রান্তিক নাগাদ সেখানে উৎপাদন শুরু করতে পারব। সব বিনিয়োগই আমাদের নিজস্ব উদ্যোগ। আমরা সরকার বা প্রণোদনার দিকে তাকাচ্ছি না।

ব্যয় করার ক্ষেত্রে স্কয়ার খুবই সচেতন বলেও জানান তপন চৌধুরী। তিনি বলেন, অনেক কোম্পানি কার্যালয় থেকে শুরু করে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় করে। কিন্তু আমাদের ব্যয়গুলো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নতুন পণ্য বাজারে আনার লক্ষ্যে করে থাকি। অনেক সময় ব্যাংকাররা আমাদের ঋণ সাধেন, কিন্তু আমাদের তা প্রয়োজন পড়ে না। এটার একটা সুবিধাও আছে। তা হলো সুদ হার নিয়ে দরকষাকষি করতে পারি আমরা। এক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান অনেক শক্তিশালী। সুবিধাটা খুব কম কোম্পানিই ভোগ করতে পারে। নগদ অর্থে কোম্পানির শক্তি ধরে রাখার বিষয়টি আমাদের দীর্ঘমেয়াদি দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম চর্চা আমরা করে আসছি। চর্চা আমাদের বাবার সময় থেকেই। দিন শেষে দেনার মধ্যে না থাকার চেষ্টা করে যাওয়াই তিনি আমাদের শিখিয়েছেন। চর্চা ধরে রাখতে পারার কারণেই ব্যাংক আমাদের নয়, বরং আমরাই ব্যাংককে ডিকটেট করার সক্ষমতা রাখি। এটা আমাদের অনেক বড় স্ট্রেনথ। শক্তি আমাদের আরো বড় প্রবৃদ্ধি অর্জনেও সহায়তা করছে।

দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঋণ দিতে মুখিয়ে থাকে ব্যাংকগুলো। তবে পর্যাপ্ত নগদ অর্থ থাকায় স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসে ঋণ দিতে পারছে না কোনো ব্যাংকই। নিয়ে ব্যাংকারদের মধ্যে আক্ষেপও রয়েছে। ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ না নিলেও নিজেদের কাছে থাকা উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকে জমা রেখে বড় অংকের সুদ আয় হচ্ছে স্কয়ার ফার্মাসিউটিক্যালসের। ২০১৯-২০ হিসাব বছরে ২৬১ কোটি এবং চলতি ২০২০-২১ হিসাব বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৬০ কোটি টাকা সুদ আয় হয়েছে কোম্পানিটির।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সেক্রেটারি জেনারেল সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসরুর আরেফিন বণিক বার্তাকে বলেন, অবশ্যই স্কয়ারকে ক্যাশ কিং বলা যায়। চিত্র যে শুধু যে কভিডকালে, তা নয় কিন্তু। ঐতিহাসিকভাবেই প্রতিষ্ঠানটি নগদ প্রবাহে খুব শক্তিশালী। কখনই দেখিনি তাদের বড় লোন নিতে। তারা সাধারণত ট্রেড ফাইন্যান্স বা এলসি সংক্রান্ত সুবিধাই নেয়। নন-ফান্ডেড এলসি ছাড়া কোনো ব্যাংক থেকেই ফান্ডেড লোন নেয় না। খুবই হিসাবি একটা কোম্পানি স্কয়ার। যথেষ্ট আর্থিক শৃঙ্খলা আছে। করোনার সময়ে স্কয়ার ফার্মা অনেক ভালো ব্যবসা করেছে। বাংলাদেশে ক্যাশ ভালো এমন বড় করপোরেট সর্বোচ্চ ১০টি, স্কয়ার তাদের মধ্যে একটি। কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করতে ব্যাংকের টানাটানি তো থাকবেই।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন