পর্যালোচনা

খাদ্য উৎপাদন বাড়ানো কেন প্রয়োজন

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল

কৃষিমন্ত্রী . মো. আবদুর রাজ্জাক জানুয়ারি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইংরেজি নববর্ষ উপলক্ষে মতিবিনিময় সভায় মূল্যবান বক্তব্য রেখেছেন। তিনি বলেছেন, প্রয়োজনীয় খাদ্য আমাদেরই উৎপাদন করতে হবে। চলমান করোনার কারণে যদি খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তাহলে আমাদের হাতে টাকা থাকলেও খাদ্য পাওয়া কঠিন হবে, অনেক ক্ষেত্রে পাওয়াই যাবে না। তিনি আরো বলেছেন, খাদ্যনিরাপত্তায় মূল চ্যালেঞ্জ হলো, আমাদের জনসংখ্যা প্রতি বছর ২২-২৩ লাখ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অথচ নানা কারণে চাষের জমি কমছে। স্বল্প জমি থেকেই মানুষের খাদ্য এবং প্রাণী পোলট্রি ফিডের জোগান দিতে হবে। সেজন্য কৃষি বিভাগের সবাইকে আরো আন্তরিকতা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে (বণিক বার্তা, জানুয়ারি) বক্তব্য দেয়ার সময় ২০০৭ সালে দেখা ঘটনা সম্ভবত কৃষিমন্ত্রীর স্মরণে এসেছে। ২০০৭ সালে আমরা দেখেছি, একাধিক প্রলয়ংকরী বন্যা সাইক্লোন সিডর কীভাবে আমন ফসলের মারাত্মক ক্ষতি করেছিল। আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কোটি ৩০ লাখ টনের বিপরীতে উৎপাদিত আমনের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল কোটি টনের নিচে। ২০০৭-০৮ সালে বিশ্বব্যাপী মন্দা, খাদ্যশস্যের উৎপাদন হ্রাস মূল্যবৃদ্ধি এবং চাল রফতানিকারক একাধিক দেশের চাল রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কারণে দেশের চাহিদা মেটাতে চাল আমদানি করতে গিয়ে তত্কালীন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে বড় ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল।

এটা অনস্বীকার্য যে স্বাধীনতার পর থেকে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সব সরকারই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি এবং দেশকে খাদ্যে স্বনির্ভর করার ওপর জোর দিয়েছে। স্বাধীনতার পর প্রণীত এবং ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত বাস্তবায়িত সাতটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনের ওপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়। গত ডিসেম্বরে অনুমোদিত অষ্টম পঞ্চম বার্ষিক পরিকল্পনায়ও বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রায় পাঁচ দশকে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দ্বিগুণের কিছুটা বেশি হলেও সব সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ এবং কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমে প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনের পরিমাণ তিন গুণের বেশি বৃদ্ধি পেয়ে সাড়ে তিন কোটি টন ছাড়িয়ে গেছে। তবে পণ্যটি উৎপাদনে এখনো আমরা পুরোপুরি স্বনির্ভর হতে পারিনি। দেশে চাল উৎপাদনে বড় সমস্যা হলো প্রবৃদ্ধি হারে ধারাবাহিকতার অভাব। যেসব কারণে চাল উৎপাদনে ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে না, সেগুলোর মধ্যে রয়েছে প্রাকৃতিক দুর্যোগে পণ্যটির উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং কৃষিজমি অকৃষি খাতে ব্যবহারের ফলে কৃষিজমির পরিমাণ হ্রাস পাওয়া। সরকারের খাদ্যশস্য ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতার কারণে ধান কাটার মৌসুমে পণ্যটির ন্যায্য দাম না পাওয়ায় কোনো কোনো সময় ধান আবাদে কৃষক আগ্রহ হারিয়ে ফেলছেন। উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ার এটি আরেকটি কারণ। গত পাঁচ অর্থবছরে দেশে প্রধান খাদ্যশস্য ধান থেকে তৈরি চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হারের ধারাবাহিকতা পর্যালোচনা করলেই সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগ থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা অন্যান্য রিপোর্টে দেখা যায়, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কোটি ৪৭ লাখ ১০ হাজার টন। এর আগের অর্থবছরে (২০১৪-১৫) একই পরিমাণ চাল উৎপাদিত হওয়ায় চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল শূন্য। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে চাল উৎপাদনের পরিমাণ ছিল কোটি ৩৮ লাখ টন। অর্থাৎ বছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল নেতিবাচক। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চালের উৎপাদন দাঁড়ায় কোটি ৬২ লাখ ৭৯ হাজার টন। অর্থবছর চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধির হার ছিল অতি উৎসাহজনক দশমিক শতাংশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে চাল উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা কোটি ৬৪ লাখ টন পূরণ হয়। অর্থাৎ চাল উৎপাদনের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ইতিবাচক। ২০১৯-২০ অর্থবছরের শেষ দিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, চাল উৎপাদন কোটি ৭০ লাখ টনে দাঁড়াতে পারে। তবে গত নভেম্বর মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বাংলাদেশে মোট কোটি ৫৮ লাখ ৫০ হাজার টন চাল উৎপাদিত হয়। সরকার ইউএসডিএর তথ্যের প্রতিবাদ করেছে বলে জানা নেই। ওই প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, আগস্ট-সেপ্টেম্বর সময়ে উপর্যুপরি বন্যা এবং নভেল করোনাভাইরাসের কারণে চলতি অর্থবছরে আমন চালের উৎপাদন গত বছরের তুলনায় বেশ কিছুটা হ্রাস পাবে। তাছাড়া চলতি অর্থবছরে বোরোর উৎপাদন গত অর্থবছরের কোটি ৯৪ লাখ টনের তুলনায় এক লাখ টন কমতে পারে। তবে আউশের উৎপাদন গত বছরের ২৪ লাখ ৫০ হাজার টন থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২৭ লাখ টনে পৌঁছতে পারে। সাকল্যে গত অর্থবছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরে চাল উৎপাদন হ্রাস পেতে পারে সাড়ে লাখ টন। এদিকে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক দফা বন্যার কারণে গত অর্থবছরে উৎপাদিত কোটি ৫৫ লাখ আমন চালের তুলনায় চলতি অর্থবছরে আমন চালের উৎপাদন ১৫ লাখ টন কমে কোটি ৩৯ লাখ ৮০ হাজার টনে দাঁড়াতে পারে  (বণিক বার্তা, ২৩ ডিসেম্বর)

আমাদের খাদ্যশস্যের তালিকায় চালের পরই দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে গম। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, দেশে খাদ্যপণ্যটির উৎপাদন নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকের ১৯ লাখ টনের তুলনায় বর্তমানে ১২-১৩ লাখ টনে দাঁড়িয়েছে। এদিকে একাধিক কারণে দেশে পণ্যটির চাহিদা ক্রমে বাড়ছে। যেসব কারণে পণ্যটির চাহিদা বেড়ে চলেছে, সেগুলোর মধ্য রয়েছে সব শ্রেণীর ভোক্তার খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন স্বাস্থ্য সচেতনতা এবং মোটা চালের তুলনায় আটার কম দাম।

শুধু খাদ্যশস্যে (চাল, গম) নয়, সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সার্বিক কৃষি খাতে (শস্য, বন, মত্স্য প্রাণিসম্পদ নিয়ে সার্বিক কৃষি খাত গঠিত) উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার হ্রাস পেয়েছে। সরকারি তথ্যে দেখা যায়, নব্বইয়ের দশকে সরকার থেকে বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়ার ফলে ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার দাঁড়ায় দশমিক শতাংশে (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০০৫) এরপর কৃষি খাতে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেতে থাকলেও ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে দশমিক ৫৫ শতাংশে দাঁড়ায়। এরপর কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার কমতে থাকে। সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত তার ২০১৮-১৯ অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় বলেন, গত ১০ বছরে কৃষি খাতে গড় প্রবৃদ্ধি হয়েছে গড়ে দশমিক শতাংশ; যা ১৯৯৯-২০০০ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধি হারের অর্ধেকের সামান্য বেশি। ২০১৯-২০ অর্থবছরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার জানা যায়নি। তবে মে মাসে উপকূলীয় জেলাগুলোয় এবং উপকূলীয় নয় এমন ১৭টি জেলায় ঘূর্ণিঝড় আম্পানের আঘাতে ৪৭ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান নষ্ট হওয়া, জোয়ারের পানিতে হাজার হাজার পুকুর ঘেরের মাছ ভেসে যাওয়া, শত শত খামারের মুরগি মরে যাওয়া, মুগ ডাল, মরিচ, আলু, তরমুজ, বাঙ্গিসহ রবিশস্যের ক্ষতি হওয়া এবং দীর্ঘ খরায় আউশের উৎপাদন হ্রাস পাওয়া ইত্যাদি কারণে ওই অর্থবছরে কৃষিতে প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

একদিকে খাদ্যশস্যের (চাল, গম) উৎপাদন কমে যাওয়া এবং অন্যদিকে বছরে জনসংখ্যা ২২-২৩ লাখ বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব পণ্য আমদানি করা ছাড়া উপায় থাকছে না। দেশে চালের চাহিদা মেটাতে সরকারি বেসরকারি খাতে চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার এবং এরই মধ্যে তা শুরু হয়েছে। বেসরকারি খাতকে চাল আমদানিতে উৎসাহ জোগাতে আমদানি শুল্ক অর্ধেকের কমে অর্থাৎ ২৫ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়েছে। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্রের বরাত দিয়ে পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, সরকারি বেসরকারি খাত মিলে চলতি অর্থবছরে ২০ লাখ টন চাল আমদানি করা হবে। অথচ গত অর্থবছরে শুধু বেসরকারি খাতে মাত্র হাজার টন চাল আমদানি হয়েছিল। অবশ্য ভোক্তাদের এর খেসারত দিতে হচ্ছে। দেশের গরিব-নিম্নবিত্তসহ বেশির ভাগ মানুষের প্রধান খাদ্য মোটা চালের দাম প্রতি কেজি ৫০ টাকা ছুঁই ছুঁই করছে। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সরু মাঝারি চালের দাম। আর বছরের ছয় মাস বাকি থাকতে জানুয়ারির ১২ তারিখ পর্যন্ত গম আমদানির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২৭ লাখ হাজার টন। গত অর্থবছরে আমদানীকৃত গমের পরিমাণ ছিল ৬৪ লাখ ৩৪ হাজার টন।

আমিষের প্রধান উৎস মাছ উৎপাদনে স্বনির্ভরতা অর্জনের দোরগোড়ায় পৌঁছেছে দেশ। জাতিসংঘের খাদ্য কৃষি সংস্থার (এফএও) দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০১৮-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে অভ্যন্তরীণ মুক্ত জলাশয়ে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান এবং বদ্ধ জলাশয়ে চাষকৃত মাছ উৎপাদনে পঞ্চম স্থান অধিকার করেছে। আমিষের আরেক উৎস ডিম উৎপাদনেও বাংলাদেশ স্বনির্ভরতা অর্জনের পথে। মাছ ডিমে স্বনির্ভরতা অর্জনের কাছাকাছি পৌঁছলেও মাংস, দুধ, ভোজ্যতেল, ডাল, ফল, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, আদাসহ বিভিন্ন ধরনের মসলা উৎপাদনে দেশ অনেক পিছিয়ে আছে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশে দশমিক ৯৫ মিলিয়ন টন মাংসের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের পরিমাণ দশমিক ৮৬ মিলিয়ন টন। বছরে ১৪ দশমিক ৪৮ মিলিয়ন টন দুধের চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের পরিমাণ দশমিক ৯৭ মিলিয়ন টন। অন্যান্য সূত্রে জানা যায়, দেশ ভোজ্যতেলে বহুলাংশে আমদানি নির্ভরশীল। দেশে ভোজ্যতেলের বার্ষিক চাহিদা ১৯-২০ লাখ টন। চাহিদার বিপরীতে তেলজাতীয় শস্য উৎপাদন হচ্ছে ১০ লাখ টন। এখান থেকে ভোজ্যতেল পাওয়া যাচ্ছে চার থেকে পাঁচ লাখ টন। ফলে দেশে ঘাটতি থেকে যাচ্ছে প্রায় ১৪ থেকে ১৫ লাখ টন। দেশে যখন ডালের উৎপাদন আট-নয় লাখ টন, তখন পণ্যটির চাহিদা ২৫ লাখ টন। আমদানির মাধ্যমে ডালের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। দেশের চিনি কলগুলোয় উৎপাদন হচ্ছে কম বেশি এক লাখ টন। আর দেশে চিনির চাহিদা ১৪ লাখ টন। প্রয়োজন মেটাতে আমদানি করতে হচ্ছে ১২-১৩ লাখ টন চিনি। দেশে বছরে পেঁয়াজের চাহিদা ২৪ লাখ টন। দেশে উৎপাদিত পেঁয়াজে চাহিদা না মেটায় পণ্যটি আমদানি করতে হয়। ২০১৮ ২০১৯ সালে পেঁয়াজ আমদানির পরিমাণ ছিল যথাক্রমে লাখ ৯৬ হাজার টন এবং লাখ ৭৪ হাজার টন। দেশে তিন লাখ টন আদার চাহিদার বিপরীতে উৎপাদনের পরিমাণ দুই থেকে সোয়া দুই লাখ টন। আর রসুনের উৎপাদন যখন কম বেশি পাঁচ লাখ টন, তখন চাহিদা ছয় লাখ টনের ওপরে। আমদানির মাধ্যমে এসব খাদ্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে হচ্ছে। দেশে খাদ্যপণ্য উৎপাদনের অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের অনেকে দাবি করছেন দেশ খাদ্য উৎপাদনে স্বনির্ভর। দেশে খাদ্য উৎপাদনের প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরে উৎপাদন বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে।  

কৃষিমন্ত্রী খাদ্যনিরাপত্তার চ্যালেঞ্জগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করেছেন। তিনি ক্রমবর্ধমান হারে অর্থাৎ প্রতি বছর ২২-২৩ লাখ জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে খাদ্যনিরাপত্তার জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখেছেন। উল্লেখ্য, স্বাধীনতার সময়ের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সংখ্যা এখন দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ কোটিতে। সরকারি হিসাবে দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দশমিক ৩৭ শতাংশ (বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৯) জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আমাদের প্রধান খাদ্য চাল উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হারের চেয়ে বেশি। আশির দশকের মাঝামাঝি আমি স্বাস্থ্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ মন্ত্রণালয়ে কর্মরত ছিলাম। যতদূর মনে পড়ে তখন দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল প্রায় শতাংশ। বর্তমানে তা দশমিক ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। এটা প্রশংসনীয় অর্জন। তবে এক্ষেত্রে আমাদের আরো অনেক পথ এগিয়ে যেতে হবে। খাদ্য, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণগুলোর জোগান দিতে যত দ্রুত সম্ভব জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার সার্বিক ব্যবস্থা নিতে হবে। তারপর আমাদের লক্ষ্য হবে জনসংখ্যার শূন্য বৃদ্ধি হার অর্জন।  

খাদ্যনিরাপত্তায় কৃষিমন্ত্রী আর যে চ্যালেঞ্জটির উল্লেখ করেছেন তা হলো, কৃষিজমির অকৃষি খাতে স্থানান্তর। বাড়িঘর নির্মাণ, শিল্প স্থাপন, রাস্তা নির্মাণ ইত্যাদি কারণে দেশে কৃষিজমির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। সবচেয়ে বেশি কৃষিজমি চলে যাচ্ছে আবাসন খাতে, বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে বাড়িঘর নির্মাণে। তাই ২০১৪ সালে সমবায়ভিত্তিক ভবন নির্মাণে নেয়া পরীক্ষামূলক পল্লী জনপদ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করে সারা দেশের গ্রামাঞ্চলে এটির বিস্তার ঘটাতে হবে। শিল্প স্থাপন, রাস্তা নির্মাণ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নির্মাণ ইত্যাদি উন্নয়নমূলক কাজে ব্যবহারের জন্য অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে কৃষিজমির বরাদ্দ প্রদান করতে হবে।

বিশ্বব্যাপী কৃষি খাতে উৎপাদন বৃদ্ধিতে অন্য যে চ্যালেঞ্জটি বড় হয়ে দেখা দিয়েছে, তা হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব। জলবায়ু পরিবর্তনে যেসব দেশ সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ একটি। জলবায়ুু পরিবর্তনের কারণে দেশের ঋতুচক্র বদলে যাচ্ছে। এর নেতিবাচক প্রভাব কৃষি উৎপাদনের ওপর পড়তে শুরু করেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ুর বিরূপ পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য বিশেষ করে বিভিন্ন অভিযোজন কলাকৌশল রপ্ত করতে হবে, যাতে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে কৃষিকে মুক্ত রাখা বা ঝুঁকি কমানো যায়।

বৈশ্বিক করোনা মহামারীর প্রাদুর্ভাব দেশে খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তাকে আরো অর্থবহ করে তুলেছে। বিশ্বে এক বছরের বেশি সময় ধরে করোনার প্রাদুর্ভাব বৈশ্বিক অর্থনীতিক অবস্থার মারাত্মক ক্ষতিসাধন করেছে। মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছে কোটি কোটি মানুষ। সারা বিশ্বে ২০ লাখের বেশি মানুষ মহামারীতে এরই মধ্যে প্রাণ হারিয়েছে। অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যুদস্ত হয়ে পড়েছে। দেশে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ মহামারীতে আক্রান্ত হয়েছে এবং ১৬ জানুয়ারি পর্যন্ত মারা গেছে হাজার ৮৮৩ জন। কেউ জানে না কবে মহামারীর অবসান হবে। মহামারী প্রাদুর্ভাব আরো দীর্ঘায়িত হলে, বৈশ্বিক যোগাযোগ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হলে খাদ্যপণ্যের সাপ্লাই চেন ভেঙে পড়তে পারে। এসব দিক বিবেচনায় নিয়ে কৃষিমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, চলমান  করোনার কারণে যদি খাদ্য সংকট বা দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, তাহলে আমাদের হাতে টাকা থাকলেও খাদ্য পাওয়া কঠিন হবে, অনেক ক্ষেত্রে পাওয়াই যাবে না। তাই খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। আর এজন্য মুহূর্তে যা দরকার তা হলো, অধিক পরিমাণে খাদ্য উৎপাদনে উৎসাহ জোগাতে বীর কৃষকদের সর্বাত্মক সহায়তা প্রদান। মনে রাখতে হবে তারা করোনা  মহামারীর ভয়কে অগ্রাহ্য করে খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের খাদ্যাভাব থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন।

 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক খাদ্য সচিব

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন